শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে বিএনপি মহাসচিবের শোক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ যেসব সুপারিশ সংস্কার কমিশনের বাংলাদেশিদের সুখবর দিলো ইতালি, পুনরায় ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা ও তার দোসরদের পুনর্বাসনে কোনো সাফাই নয়: সারজিস মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে সিলেট মহানগর জমিয়তের শোক পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৩ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু দাবি পূরণে ৭ দিনের আল্টিমেটাম ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের শীতে পুরুষের চুলের যত্নে করণীয় পুরনো প্রেমের ঘটনা জানাজানিতে নববধূর আত্মহত্যা

তালাকের মহামারি; সমাজের দুই বাহুর ভাবনা!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম

আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে নির্যাতিত সংগঠনের নাম পরিবার। পৃথিবীতে নগরসভ্যতার বিকাশের পর প্রথম আঘাত আসে পরিবার ব্যবস্থার উপর। নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙ্গে ক্ষুদ্র পরিবার ব্যবস্থার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।

আধুনিক সভ্যতা যতো বেশি বিকশিত হচ্ছে পরিবার ব্যবস্থা ততোটাই মূল্য হারাচ্ছে সমাজ থেকে। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ, ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণায় পরিবর্তন, স্বনির্ভরতা, আত্মমুখিতা ইত্যাদি কারণে মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে বিয়ে, সংসার ও পরিবারিক ব্যবস্থা থেকে।

বিশ্বব্যাপী এ পারিবারিক বিপর্যয়ের প্রভাব প্রকট হচ্ছে বাংলাদেশেও। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে দেশে গত ৭ বছরে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ ভাগ। আর নারীরাই দিচ্ছে ৭০ ভাগ তালাক

প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে বেশি তালাক হচ্ছে ঢাকা সিটিতে। ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় তালাক হচ্ছে ১টি করে। ঢাকার অভিজাত অঞ্চলখ্যাত উত্তর সিটিতে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে ৭৫ ভাগ।

তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের এ হারকে উদ্বেগজনকই মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজন। তারা মনে করছেন, এতে মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে শিশুর বিকাশ। একই সঙ্গে বিচ্ছেদের শিকার নারী-পুরুষরাও আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক ক্ষতির মুখোমখি হচ্ছে। নিঃসঙ্গ নারী-পুরুষ জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে।

সামাজিক এ বিপর্যয়ের কারণ ও সংকট উত্তরণের পথ-পদ্ধতি অনুসন্ধানে মুখোমুখি হয়েছিলাম দেশের দু’ধারার দু’জন শিক্ষাবিদ ও সমাজসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বের। একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লিমা হক। অপরজন মাদরাসা দারুর রাশাদ-এর মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, সিনিয়র সাংবাদিক মাওলানা লিয়াকত আলী

নিজ নিজ অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্ধারিত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তারা।

আওয়ার ইসলাম : বিবাহ বিচ্ছেদের ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে কিভাবে দেখছেন?

মাওলানা লিয়াকত আলী : ইসলামি জীবনব্যবস্থায় পরিবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পরিবারের ওপর নির্ভর করে মানব শিশু তথা মানব সমাজের বিকাশ। পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে পুরো সমাজেই বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে।

এজন্য তালাককে ‘নিকৃষ্টতম বৈধ বিষয়’ বলা হয়েছে। আমি বিষয়টিকে উদ্বেগে বলেই মনে করছি।

ড. লিমা হক : ডিভোর্স অবশ্যই ভালো কিছু নয়। যেকোনো বিচ্ছেদই অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে আমি মনে করি, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এর সঙ্গেই আমাদের মানিয়ে নিতে হবে। কারণ, সমাজ যখন কোনো পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায় তখন সেটা ধারণ করে নিতে হয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে এটা শুধু আমাদের সমাজে না সারা বিশ্বেই হচ্ছে। আমরা বিশ্বব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সমাজ নই।

আওয়ার ইসলাম : ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে কেনো?

মাওলানা লিয়াকত আলী : মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ কমে যাওয়াই প্রধান কারণ। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে।

বস্তুবাদী ও ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা মানুষকে বল্গাহীন এক জীবনের প্রতি ঠেলে দিচ্ছে। ফলে তারা স্বার্থপর, আত্মমুখী ও অবাধ স্বাধীনতা নামক ভোগবাদে ডুবে যাচ্ছে। এখন তাদের জীবনের নিজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। ব্যাপারটি ভয়ানক।

ড. লিমা হক : ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে। সামাজিক ব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কারণেই এটা হচ্ছে।

আমার মনে হয়, সমাজ বিষয়টি সহজভাবে গ্রহণ করার কারণেই ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে। এক সময় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নারী ও পুরুষ কেউ ডিভোর্স চাইতো না। সমাজে তার স্বীকৃতি না থাকায় তাদের সম্মানহানি হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।

সিভিলাইজেশনের অংশ হিসেবেই ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে।

আওয়ার ইসলাম : পরিসংখ্যান অনুযায়ী নারীরাই বেশি ডিভোর্স দিচ্ছে। অথচ এক সময় নারীরা ডিভোর্স ভয় পেতো?

মাওলানা লিয়াকত আলী : ইসলাম তালাকের অধিকার পুরুষকে দিয়েছে। নারীকে দেয় নি। হ্যাঁ, নারীর ইচ্ছের প্রতি লক্ষ্য রেখে ‘খোলা তালাক’ (আপোষ-রফার মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ) ও বুদ্ধি-বিবেচনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ‘তালাকে তাফবিজ’ (অর্পিত তালাক) এর বিধান রেখেছে।

ইসলাম তালাকের বিধান কেনো পুরুষের হাতে ছেড়ে দিয়েছে? কারণ, এতে পুরুষ আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অন্যদিকে নারীকে আবেগী ও তরিৎ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী মনে করা হয়। আজকের পরিসংখ্যান তারই প্রমাণ।

বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র নারীকে তালাকের অধিকার দেয়ায় তালাকের পরিমাণ বেড়ে গেছে।

আমাদের সমাজের একটি শ্রেণি নারীকে স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলে বলে পরিবারের প্রতি ভীত করে তুলছে। তারা সামাজিক জীবন থেকে পরিবারের ধারণাটাই বিলীন করে দিতে চায়।

তবে এটাও ঠিক যে, তালাকপ্রাপ্ত নারীর প্রতি আমাদের সমাজের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো তা ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলাম মনে করে, সঙ্গত কারণে তালাক হতে পারে। ইসলামের সোনালি যুগে এক নারীর চার থেকে পাঁচটি বিয়েরও প্রমাণ পাওয়া যায়।

ড. লিমা হক : ডিভোর্স বেশি দিচ্ছে নারীরা। কেনো দিচ্ছে? আগে তারা ভালো ছিলো আর এখন ভালো নাই; বিষয়টি কি এমন? না, আগে নারীরা ডিভোর্স দেয়ার সুযোগ পেতো না। এখন পাচ্ছে।

ডিভোর্সের আগে সামাজিক স্বীকৃতি ছিলো না তাই তারা ডিভোর্স ভয় পেতো, এড়িয়ে যেতো। এখন সামাজিক স্বীকৃতি হয়েছে।

আমার মনে হয়, অর্থ, স্বাধীনতা বা অন্য যেকোনো কারণেই নারীরা ডিভোর্স বেছে নিচ্ছে তাদের প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ার কারণে। শিক্ষিত ও অভিজাত নারীদের মধ্যেই ডিভোর্সের পরিমাণ বেশি। তাদের তো অর্থ ও স্বাধীনতার অভাব নেই। তারা সম্মানের জন্যই আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

এখন ব্যবসার হিসাব হবে সফটওয়ারে – বিস্তারিত জানুন

আওয়ার ইসলাম : দম্পতিদের মধ্যে বিচ্ছেদ প্রবণতা বাড়ার কারণে শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাদের জন্য করণীয় কী?

মাওলানা লিয়াকত আলী : পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাই তার জন্য কাজ করবে। পরিবার সাথে আশ্রয় দিবে, সমাজ তাকে সম্মান ও সহযোগিতা করবে এবং রাষ্ট্র তার সু-নাগরিক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করবে।

শিশুর যেনো ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেদিকে মা-বাবা উভয়-ই নিজ নিজ জায়গা থেকে চেষ্টা করবে।

ড. লিমা হক : ডিভোর্সের কারণে শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাদের সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এটা যেনো না হয়, শিশু যেনো তার বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হয় সে ব্যাপারে পরিবারকেই ভূমিকা রাখতে হবে।

পরিবারে যদি নারী ও পুরুষ উভয়ে তাদের প্রাপ্য সম্মান লাভ করে, পারস্পারিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাস যদি বৃদ্ধি করা তবে পরিবার স্থায়ী হবে। আমার মনে হয় না এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কিছু করার আছে।

একটা দীর্ঘ পক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সমাজ আজকের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে আবার একটা সময় পার হলে সমাজ এ পরিস্থিতি মোকাবেলার পদ্ধতিও শিখে যাবে। এখন তা যাচ্ছেও।

এতোদিন শিশু যেভাবে বেড়ে উঠতো এখন তারা ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠছে। ভিন্ন পরিবেশই এক সময় তাদের কাছে স্বাভাবিক পরিবেশ মনে হবে।

আওয়ার ইসলাম : এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?

মাওলানা লিয়াকত আলী : নীতি, নৈতিকতা ও ইসলামের পথে ফিরে আসা। স্বামী ও স্ত্রী উভয় যখন আল্লাহর বিধা মেনে চলবে, নৈতিক জীবনযাপন করবে কেবল তখনই পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হওয়া সম্ভব। সমাজ ইসলাম থেকে যতোটা দূরে যাবে তার বিপদ ততো বাড়বে।

ড. লিমা হক : পরস্পরের প্রতি সম্মান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ বাড়াতে হবে যেনো এক সাথে থাকা যায়। বিশেষত নারীকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হবে।

আওয়ার ইসলাম : অনেক বিশ্লেষক বলছেন, আমাদের সমাজের নারীরা স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার এক নতুন জীবনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তাই হঠাৎ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলো বিচ্ছেদের পরিমাণও কমে যাবে। আপনি কী মনে করেন?

মাওলানা লিয়াকত আলী : তারা নতুন জীবন বলতে যা বোঝাচ্ছে তাহলো পারিবারিক বন্ধনহীন ব্যক্তি জীবনকে। তাদের ধারণা, মানুষ এক সময় পরিবারের প্রয়োজন অনুভব করবে না।

কিন্তু আমার বিশ্বাস, পারিবারিক বন্ধনহীব সমাজব্যবস্থা বেশি দিন টেকার নয়। মানুষ এক সময় বিতৃষ্ণ হয়েই পারিবারিক জীবনে ফিরে আসবে। তখন পরিস্থিতির পরিবর্তনও হবে।

ড. লিমা হক : হয়তো বা হবে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে, অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। অথবা আমাদের মূল্যবোধই পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমরা তাকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিই হয়তো ভাববো না। আমাদের মন-মানসিকতাই পরিবর্তন হয়ে যাবে।

‘ইসলামে একসঙ্গে তিন তালাক নেই; সমাজ ভুল ধারণায় বসে আছে’

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ