শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

সাভার তাবলিগে সঙ্কট; আলেমদের ওপরই এমপি এনামের আস্থা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু

তাবলিগ জামাতের চলমান সংকটকে কোনোভাবেই যেনো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে সংকট। মনমালিণ্য, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ থেকে এখন তা মোড় নিচ্ছে দখল-সংঘাতে। উভয় বলয়-ই চেষ্টা করছে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।

তারই ধারাবাহিকতায় চলছে সারা দেশের তাবলিগি মারকাজগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। এ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত।

সম্প্রতি সাভার কলমা মারকাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় উলামায়ে কেরামের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন নিজামুদ্দিনের অনুসারী তাবলিগি সাথীরা। তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততায় বিষয়টির জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কারণ, তাদের ভূমিকা দ্বিধান্তিত। তারা কখনো মাওলানা সাদ তথা নেজামুদ্দীনের অনুসারীদের পক্ষ নিচ্ছেন আবার কখনো উলামায়ে কেরামের কথায় সায় দিচ্ছেন।

গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সাংসদ ডা. এনামুর রহমান ও চেয়ারম্যান সোহেল নিজামুদ্দিনের অনুসারীরা মারকাজ পরিচালনা করবেন ঘোষণা করলেও ৯ জুলাই উলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে আলেমরাই মারকাজ পরিচালনা করবেন বলে নতুন ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

তবে তাদের নতুন ঘোষণাকে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে রাজি নন নিজামুদ্দিনের অনুসারীগণ। এমপি এনাম বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন- এমনটিই বলছেন তারা।

যেভাবে ঘটনা শুরু

তাবলিগ জামাত নিয়ে চলমান সংকট শুরুর পর থেকেই উভয়পক্ষের প্রভাব বিস্তারের সূচনা হয় সাভার কলমা মারকাজে। একদিকে দিল্লির নেজামুদ্দীনের পক্ষে কাজ করেন মুফতি জিয়া বিন কাসেম এবং মাওলানা আশরাফ আলী।

অন্যদিকে উলামায়ে কেরাম তথা আলমি শুরার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন মাশওয়ারার সাথী মাওলানা বাহাউদ্দিন, মাওলানা ওহিদুজ্জামান, মাওলানা আতাউর রহমান প্রমুখ।

পারস্পারিক বনাবনি না হওয়ায় এক পর্যায়ে কমলা মারকাজ সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব দেন মুফতি জিয়া বিন কাসেমসহ নিজামুদ্দিনের অনুসারীগণ। কিন্তু তাতে রাজি হন নি মাওলানা বাহাউদ্দিনরা।

ভাগ হয়ে গেলো সাভার মারকাজ

গত রমজানের এক মাস পূর্বে নিজামুদ্দিনের অনুসারী আলেম ও তাবলিগের সাথীরা কমলা মারকাজের বাইরে কাজ শুরু করেন। তারা নিজ অনুসারীদের সংঘবদ্ধ রাখতে সাভারের তিনটি পৃথক মসজিদে কাজ শুরু করেন।

এগুলো হলো, সাভার বাসস্ট্যান্ডের মসজিদে আর রহমান, বাইপাইল মসজিদ ও গোয়াইন বাড়ি মসজিদ।

নিজামুদ্দিনের অনুসারীগণ কলমা মারকাজ ত্যাগ করার পর মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই কাজ করে যাচ্ছিলেন উভয়পক্ষ। মারকাজের ভেতরে কাজ করতে থাকেন উলামায়ে কেরাম ও তাদের অনুসারী সাথীগণ এবং নিজস্ব পয়েন্টে নিজামুদ্দিনের অনুসারীরা।

নেজামুদ্দীনের অনুসারীদের মারকাজে ফেরা

গত ৫ জুলাই বৃহস্পতিবার স্থানীয় সাংসদ ডা. এনামুর রহমানের সহায়তায় বিপুল সংখ্যক লোক নিয়ে মারকাজে ফেরেন নিজামুদ্দিনের অনুসারীগণ। ডা. এনামের উপস্থিতে মসজিদে বয়ান করেন মুফতি জিয়া বিন কাসেম প্রমুখ।

এমপি ডা. এনামুর রহমান আলোচনা শেষে ঘোষণা দেন এ মারকাজ নিজামুদ্দিনের অনুসারীগণই পরিচালনা করবেন।

শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রেখে আবার মারকাজে ফিরলেন কেনো জানতে চাইলে মুফতি জিয়া আওয়ার ইসলাম বলেন, ‘স্থানীয় পুরান সাথী আদম আলীসহ অন্যান্যদের অনুরোধেই আমরা ফিরেছি। তাদের উদ্যোগ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় আমাদের এখানে আসা।’

নেজামুদ্দীনের অনুসারীরা মারকাজ ত্যাগ করার পর মারকাজের কাজ স্থবির হয়ে পড়ে বলেও দাবি করেন মুফতি জিয়া।

তবে তার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন কমলা মারকাজের অন্যতম সাথী মাওলানা হাদিউজ্জামান।

তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘একদম শুরু থেকে সাভারের সাধারণ সাথী ও আলেমদের অধিকাংশ কাকরাইল তথা আলমি শুরার আনুগত্যের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। বরং মাওলানা নেজামুদ্দীনের সাথীদের তৎপরতায় বিরক্ত অধিকাংশ সাথী। এলাকার সাথীরা প্রথম থেকেই আমাদের সাথে আছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডা. এনামুর রহমানকে ভুল বুঝিয়ে চর-দখলের মতো মারকাজ দখল করেন। কিন্তু আল হামদুলিল্লাহ! তিনি প্রকৃত বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন।’

ডা. এনামের ঘোষণা এবং উলামায়ে কেরামের প্রতিবাদ

গত বৃহস্পতিবার নেজামুদ্দীনের অনুসারীরা কলমা মারকাজে ফেরার পর উলামায়ে কেরামের মধ্যে অস্বস্তি এবং সাধারণ সাথীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। সংবাদ পেয়ে উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ সাথীরা উপস্থিত হন এবং ডা. এনামের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন।

এতে বিব্রত হন তিনি। ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এ মসজিদে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হবে আর কিছু হবে না। এ সময় উলামায়ে কেরাম তার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তিনি তাদের সময় দেন।

সাংসদের নতুন ঘোষণায় আলেমদের মনে স্বস্তি

রোববার (৮ জুলাই) সকালে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজের সামনে কয়েক হাজার তাবলিগি সাথীসহ উলামায়ে কেরাম দেখা করেন ডা. এনামুর রহমানের সঙ্গে। এ সময় স্থানীয় চেয়ারম্যান সোহেলও উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে আলেমরা নিজেদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন।

আলেমদের বক্তব্য শেষে ডা. এনামুর রহমান কলমা মারকাজ আলেমরা পরিচালনা করবেন ঘোষণা দেন। আগামী বৃহস্পতিবার তিনি নিজে উপস্থিত থেকে আলেমদের হাতে মারকাজের দায়িত্ব তুলে দিবেন বলেও আশ্বস্ত করেন। এতে স্বস্তি ফিরে আসে আলেমদের মনে।

সাংসদ এনামের সঙ্গে সাক্ষাৎকারী আলেমদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন, মাওলানা আশিকুর রহমান কাসেমী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মাওলানা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবরাহিম, মাওলানা আবদুল মান্নান পাটওয়ারী, মাওলানা আবদুল্লাহ, মাওলানা আলী আকবর, মাওলানা আমিনুল ইসলাম কাসেমী, মাওলানা মাসুম বিল্লাহ, মাওলানা আবদুল ওয়াহাব, মাওলানা হারুন প্রমুখ।

মাওলানা আশিকুর রহমান কাসেমীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনারা ডা. এনামকে কী বলছেন এবং উত্তরে তিনি কী বললেন?

আওয়ার ইসলামকে তিনি বলেন, আমরা সাংসদকে একটি কথাই বলেছি আপনার মাধ্যমে তারা তাবলিগের কল্যাণ নয়; বরং মাওলানা সাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যা দীনি এ কাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে।

দাওয়াত ও তাবলিগের স্বার্থেই মারকাজ পরিচালনার ভার আলেমদের হাতে তুলে দেয়া উচিৎ। তিনি আমাদের কথা শুনেছেন এবং উলামায়ে কেরামের পক্ষে মত দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ! আমরা খুশি।

মাওলানা কাসেমীকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাবলিগের কাজের জন্য মারকাজ কতোটা জরুরি যে এমপির হস্তক্ষেপ নিয়ে হলেও তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছেন?

তিনি বলেন, মারকাজ হলো একটি কেন্দ্র। এখান থেকে মানুষ কাজ শেখে এবং এখান থেকেই কাজ পরিচালিত হয়। সুতরাং মারকাজ যদি ভুল পথে চলে তাহলে সাধারণ সাথী– যাদের চূড়ান্ত ভালো-মন্দ বিচারের যোগ্যতা নেই- তারা বিপদগ্রস্থ হবে। আর উম্মতকে দীনি সমস্যার হাত থেকে রক্ষা করা উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব।

এখনও কাটে নি শঙ্কা

এমপি এনামুর রহমান আলেমদের মজলিসে মারকাজ পরিচালনার ভার তাদের হাতে তুলে দেয়ার ঘোষণা দিলেও শঙ্কা কাটে নি এখনও। কেননা নিজামুদ্দিনের অনুসারীদের দাবি এমপি তাদের বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন নি। তিনি তাদের ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর অনুরোধ করেছেন।

সাভারের মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারী হিসেবে পরিচিত মুফতি জিয়া বিন কাসেম আওয়ার ইসলামকে এমনটিই বলেছেন।

এমপি এনামের সঙ্গে আজ বা কাল যে কোনো সময় এ বৈঠক হতে পারে।

অন্যদিকে এমপি তার ঘোষণা বাস্তবায়ন করবেন কি না তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। ততোদিন সংশয় ও শঙ্কার ভেতর কাটবে উভয়পক্ষের সময়।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ