এম ওমর ফারুক আজাদ
কর্মের উৎস মানুষের চিন্তা। চিন্তা যেমন হবে মানুষের কর্মের পরিবেশনটা হবে তেমনই। উন্নত চিন্তা মানুষকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যায় আর নীচ চিন্তা মানুষকে অধপতনের গহ্ববরে নিক্ষিপ্ত করে।
আল্লাহ প্রদত্ত ঐশী জ্ঞাণই কেবল মানুষকে উন্নত চিন্তার খোরাক যোগায়। এ জন্য ইসলাম প্রাক্কালে আরবের মানুষের চিন্তায় ছিলো দৈন্যতা। দীর্ঘদিন আসমানি জ্ঞানের যোজনতার কারণে ততকালীন সমাজে মানুষের মাঝে চলে এসেছিলো পশুবৃত্তি। মানুষ উন্নত চিন্তার কল্পনা করতে পারতোনা। তাই চিন্তার এই প্রভাব পড়েছিলো তাদের কর্মে।
জীবন্ত হত্যা করা হতো কন্যাশিশুকে, মেষ ছড়ানো নিয়ে বছর বছর ধরে লেগে থাকতো যুদ্ধ, ছেলে সন্তানের আশায় নিজের স্ত্রীকে অন্যের শয্যাশায়ী হওয়াকে বৈধ জ্ঞাণ করা হতো।
এমন ছিলো আরবের সামাজিক চিত্র।
৫৭০ঈসায়ীতে মুহাম্মাদে আরাবি সা. এর কাছে ঐশী বাণী পবিত্র কুরআন মাজিদের জ্ঞান আসার পর ঘুণে ধরা সমাজের চিন্তায় এলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
ওহীর ছোঁয়ায় মানুষ বুঝতে পারলো কোনটা মনুষত্ব আর কোনটা পষুত্ব। যারা বুঝেছিলো তারা হয়েছেন সোনার মানুষ, কান-নুযুম।
যে মানুষেরা সামান্য কুপের পানি তোলা নিয়ে যুগ যুগ যোদ্ধে লেগে থাকতো ইসলামের উন্নত চিন্তায় তাদের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী উদয় হয়েছিলো শাসনতান্ত্রিক নতুন দিগন্তের। লাগামহীন ও অনুগত্যহীন বিশ্বে অর্ধ পৃথীবিজুড়ে প্রতিষ্টা করেছিলেন এক খলিফার আনুগত্যের বিরাট খিলাফত ব্যবস্থার।
৬৩০ থেকে কিছু কিছু সময়কাল বাদ দিয়ে ১৯২৩ পর্যন্ত চলেছিলো এই ধারার। দীর্ঘ এই সময়ে খলিফাগণ বিশ্বব্যাপী রেখেছেন জ্ঞাণ-বিজ্ঞাণ, শিক্ষা-আবিস্কার ও উন্নত জাতি গঠনে অনবদ্য অনদান।
এসব একমাত্র ইসলামের উন্নত চিন্তার ফসল। তারপর পতন হলো খেলাফতের। চালু হলো ভাষা, গোষ্টি, ধর্ম ও বর্ণের নানান জাতিয়বাদের ধারণা। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার উপর পরিচালিত হতে লাগলো নতুন এক যুদ্ধ, চিন্তা যুদ্ধ।
এর পর সংকোচিত হয়ে পড়লো বিশ্ব মানচিত্রের রাষ্ট্র ধারণার। দেশে দেশে পড়ে গেলো বিভিন্ন জাতিয়তাবাদের কাঁটাতার। রচিত হলো জাতিয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের নতুন রাষ্ট্র ধারণার।
কিছু দেশ আবার বিস্তৃত হয়েছে মানুষ মারার যন্ত্র প্রয়োগে। খিলাফতের পতনের পর মুসলিম তরুণদের চিন্তার দুয়ারটা এক প্রকার রুদ্ধ হয়ে গেলো। খিলাফতহীন পৃথীবিতে আজ মুসলমানরা অসহায়। চারিদিকে জুলুম নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞ। প্রতিরোধের জন্যে কোন ওমর ইবনুল খাত্তাব নেই।
মুসলমানদের এই অভাব পূরণের জন্য খিলাফতের প্রয়োজনিয়তা বুঝতে পারছে তরুণরা। কিন্তু কিভাবে বিবাদমান ইসলাম বিরোধী চক্রান্ত ও মতবাদের মুকাবিলা করে এ পথে এগুবে তার জন্য প্রয়োজন বিস্তর আলোচনা -পর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনারও।
এই আবেদনকে উপলব্ধি করে ২০১৭ এর শেষের দিকে ছাত্র সংগঠন ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন শুরু করে ‘চিন্তাঙ্গণ’ নামের পাঠচক্রের। এটিকে সংগঠনও বলা যায় কারণ পাঠচক্র ছাড়াও রয়েছে বেশি কিছু কাজ।
সংগঠনের বর্তমান সভাপতি, ঢাবি’র মেধাবি ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল করীম মারুফ এ পাঠচক্রের উদ্যোক্তা। মূলত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, ঘটে যাওয়া ও ঘটমান বিভিন্ন বিপ্লব ও তার সফলতা-ব্যার্থতা, সমকালীন বিশ্বে ইসলামি রেনেসাঁর সম্ভাবনা, পথ ও পদ্ধতি নিয়ে উন্মুক্ত পাঠচক্রের উদ্দেশ্যে চিন্তাঙ্গণের আত্মপ্রকাশ।
এর পরিচালনা ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করে থাকেন ইশা ছাত্র আন্দোলনের তথ্য ও যোগাযোগ সম্পাদক।
কার্যক্রমের মধ্যে আছে ১. পাঠচক্র, ২.সেমিনার ও ৩.লোক বক্তৃতা।
প্রতি মাসেই পাঠচক্র হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত হয়েছে ৫টি। এছাড়াও একটি সেমিনার ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে একটি লোক বক্তৃতার আয়োজনও করেছে তারা।
পাঠচক্রের আলোচনায় থাকে জাতিয়তাবাদ, রুশ বিপ্লবের চুলচেরা বিশ্লেষণ, কমুনিজম ও খেলাফত। এতে অতিথি করা হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ গবেষক, অধ্যাপক, দার্শনিক, আলেম ও রাষ্ট্র চিন্তকদের।
নির্দিষ্ট বিষয়ের আলোচনা ও পর্যালোচনা, তর্ক বিতর্কের পর পৌঁছা হয় একটি সিদ্ধান্তে। আলোচনার নির্যাস থিসিস হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এটি অনেকটা টকশোর মতো, নতুন নামে বলা যায় ‘চিন্তা শো’।
তবে পাঠচক্রের আলোচনাগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত না হলেও লোক বক্তৃতা ও সেমিনারগুলো থাকে উন্মুক্ত। এতে যেকোন শিক্ষার্থী ও জনতা অংশগ্রহণ করতে পারে।
আলোচনাগুলো ইউটিউব ও সোস্যাল মিডিয়াতেও প্রচারিত হয়ে থাকে। পাঠচক্রের এই আড্ডাটি অনুষ্ঠিত হয় চিন্তাঙ্গণ এর অস্থায়ী কার্যালয় পুরানা পল্টনের নোয়াখালী টাওয়ারের ৫ম তলায়। দুই থেকে তিন ঘন্টাব্যাপী চলে আড্ডা।
এ ব্যাপারে চিন্তাঙ্গণের বর্তমান সভাপতি নুরুল করীম আকরাম আওয়ার ইসলামকে বলেন, থিসিসগুলো বই আকারে প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া চিন্তাঙ্গণ থেকে প্রকাশ হয় গবেষণা ম্যাগাজিন। নাম নবচিন্তা।
আকরাম বলেন, ইসলামের ইতিহাস, খেলাফত, ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশেরও পরিকল্পনা আছে তাদের।
চিন্তাঙ্গণের সফলতা কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এতে প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। অনেক দার্শনিক ও গবেষক পাঠচক্রে অংশগ্রহণের পাশাপাশি আমাদের উৎসাহ দিচ্ছেন। কারণ দেশে এ ধরনের উদ্যোগ নেই বললেই চলে। তাছাড়া লোক বক্তৃতা ও সেমিনারে আমরা চিন্তাশীল তরুণদের যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, আগামীকাল ৭জুন পুরানা পল্টনের পঞ্চম তলায় অবস্থিত চিন্তাঙ্গণ কার্যালয়ে ষষ্টবারের মতো ‘খিলাফত পতনের শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে বিশ্বব্যাপী ইসলামের পুণর্জাগরণ; আশা-শঙ্কা’ বিষয়ের উপর পাঠচক্র অনুষ্টিত হতে যাচ্ছে।
এ চক্রে আলোচনায় অংশ নেবেন ছাত্রনেতা, গবেষক ও রাষ্ট্র চিন্তক মুজাহিদ সগীর আহমদ চৌধুরী ও ইশা ছাত্র আন্দোলন এর কেন্দ্রীয় সভাপতি, লোক প্রশাসনের মেধাবী ছাত্র শেখ ফজলুল করীম মারুফ।
তারুণ্যের চিন্তার উন্মেষণে এগিয়ে যাক চিন্তাঙ্গণ। এই প্রত্যাশায় আমাদের।
তুরস্কে বাংলাদেশের সুনাম ছড়াচ্ছেন আহমদ আমীন
-আরআর