মুমিনুল ইসলাম: পুরো এক মাস সংযমী থেকে পরিশুদ্ধ হৃদয়ে কলুষমুক্ত জীবন, পরিবার ও সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে একে অপরকে পরম আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরার নামই ঈদ। আর সেই ঈদ উদযাপন করতে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সাধ্যমতো প্রস্তুতি নিয়েছেন। নাড়ির টানে শহর নগর ছেড়ে অধিকাংশ মানুষ ছুটে গেছেন প্রিয়জনের কাছে। প্রিয়জনের মুখের হাসি দেখাও যেন আরেক ঈদ। পবিত্র এ দিনটি উপলক্ষে মুসলিম জাহানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঈদ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করায়। এটি কেবল আনন্দের বার্তাই নিয়ে আসে না, বরং এর মধ্য দিয়ে প্রসারিত হয় ইসলামে বর্ণিত সাম্যের জয়গান।
ঈদ সমাজে ভেদাভেদ দূর করে বলে মন্তব্য করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘ঈদ এমন একটি উৎসব, যা সমাজের সব মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসে। এখানে ধনী গরিব, উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন বলে কিছু নেই। সবার মুখে হাসি ফোটায়। আমাদের সমাজ জীবনে এই উৎসব সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে বন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখে।’
বড় কাটারা আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর মুসলিম জাহানের জন্য আনন্দ ও শান্তির বার্তা নিয়ে এবারও আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদ আমাদের শান্তি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম শিক্ষা দেয়। মানুষের আনন্দময় সত্তার জাগরণ ঘটায়। মুসলিম উম্মাহকে সাম্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে। ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দেয়।’
চাঁদ দেখার পর শুরু ঈদের আনন্দ
শুক্রবার (১৫ জুন) সন্ধ্যায় পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার পর থেকেই ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যায় দেশজুড়ে। আজ শনিবার পালিত হবে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ইসলামি পরিভাষায় ঈদের অর্থ হলো পুরস্কারের দিবস। দীর্ঘ একমাস সংযম পালনের পর মুসলমানরা এ দিনে আনন্দ করেন। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী রমজান শেষ হলেই শুরু হয় শাওয়াল। উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতর পালন করা হয় এ মাসের প্রথম দিনে। অযুত নিযুত কণ্ঠে শুক্রবার থেকেই বাজছে সাম্য ও মানবতার, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’।
শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা
শুক্রবার চাঁদ দেখার পরও দেশজুড়ে শপিং মল, মার্কেট ও বাজারে ছিল রাতভর মানুষের ভিড়। শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিলেন তারা। অনেকেই চাঁদরাতে বের হয়েছেন ঘুরতে। কেউ দিয়েছেন দল বেঁধে আড্ডা। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি, নিউ মার্কেট, যমুনা ফিউচার পার্ক এবং গুলশান, বনানী, উত্তরা ও মিরপুরসহ সব এলাকায় ছিল গভীর রাত পর্যন্ত উৎসবমুখর মানুষের ভিড়।
মেহেদি রাঙা হাত
ঈদের আনন্দ হাত রাঙানো মেহেদি ছাড়া অপূর্ণ থেকে যায়। তাই চাঁদরাতে কেউ যান পার্লারে, কেউ আবার ঘরে বসে নিজেই মেহেদিতে হাত রাঙিয়ে ফেলেন। মেহেদি পাতা বেটে হাত রাঙানোর দিন এখন আর নেই বললেই চলে। বাজারে পাওয়া যায় টিউব আকারের মেহেদি, যা দিয়ে সহজেই ডিজাইন করা যায়। সঙ্গে নানা ধরনের নকশার বই ফ্রি।
ঈদ জামাতে সব বয়সী মানুষের ঢল থাকছেই
সকালে ঈদের জামাতে সমবেত হবেন দেশের মুসলমান সম্প্রদায়। ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে সকাল সাড়ে ৮টায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। জঙ্গিদের নাশকতার বিষয়টি মাথায় রেখেই এবার ঈদগাহকেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যুহ গড়ে তুলেছে পুলিশ। এখানে সাধারণ মুসল্লিদের পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, সংসদ সদস্য, জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন মুসলিম দেশের কূটনৈতিক এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা নামাজ আদায় করবেন। তারা দেশের শান্তি ও উন্নয়ন, জনগণের কল্যাণ ও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্য কামনায় দোয়া করবেন।
আবহাওয়া প্রতিকূল থাকলে সাড়ে ৮টার পরিবর্তে সকাল ৯টায় বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হবে ঈদের মূল জামাত। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হবে পাঁচটি ঈদ জামাত। এগুলো অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৭টা, সকাল ৮টা, সকাল ৯টা, সকাল ১০টা এবং পঞ্চম ও শেষ জামাত সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে।
প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের সবচেয়ে বড় জামাত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। সেখানেও মাঠ এবং শহরের সব অলিগলিতে বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা
ঈদ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ঈদ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে গড়ে তোলে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এক কাতারে শামিল হন এবং ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেন। ঈদ-উল-ফিতরের শিক্ষা সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক, গড়ে উঠুক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।’
রাষ্ট্রপতির প্রত্যাশা, ইসলামের মর্মার্থ ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য মানবতার মুক্তির দিশারি হিসেবে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে, বিশ্ব ভরে উঠবে শান্তি আর সৌহার্দ্যে।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, ‘মুসলিম জাহানের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে আমি দেশবাসী ও বিশ্বের সব মুসলমানকে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।’
তিনি বলেন, ‘ঈদ শান্তি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম শিক্ষা দেয়। হিংসা ও হানাহানি ভুলে মানুষ সাম্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ঈদ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জীবনে আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন পরিব্যাপ্তি লাভ করুক–এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা।’
গণভবনে সকাল সাড়ে ৯টায় দলীয় নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ ও পেশাজীবীর সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর বেলা ১১টায় একই স্থানে বিচারক ও বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন তিনি।