আতাউর রহমান খসরু
মাওলানা কারামত আলী নিজামীর ‘বেলায়েতে উলামা’ পড়লাম। বইয়ে লেখক আলেম সমাজ ও তাদের দায়িত্ব বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বলেছেন আলেমরাই মুসলিম সমাজের নেতা। এবং তারাই তাদের নেতৃত্ব দিবেন, তাদের শাসন করবে।
এছাড়াও ইলম কী, আলেম কারা, আলেমের দায়িত্ব কী ও আলেমের বৈশিষ্ট্য কী হবে ইত্যাদি বিষয়ে তিনি চমৎকার আলোচনা করেছেন বইটিতে।
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর পূর্বে তিনি বাঙালী আলেম সমাজকে রাজনৈতিক সচেতনতা, চিন্তার উদারতা ও সমাজসেবার মতো এমন অনেক কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন যার প্রয়োজনীয়তা আলেমগণ এখন এসে শুধু স্বীকারই করছেন না; বরং তাতে যথাসম্ভব যুক্ত হচ্ছেন। সবমিলিয়ে বইটি ভালো লেগেছে।
কিন্তু একটি বিষয় আমার প্রচণ্ড রকম আপত্তিকর মনে হচ্ছে। তাহলো, লেখক অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন এবং প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, প্রত্যেক নবী ছিলেন তার জাতি ও সমাজের আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত শাসক। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিজ নিজ জাতির শাসনভার লাভ করেছিলেন। আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় তারা ছিলেন দায়বদ্ধ। তারা সবাই নিজ নিজ জাতিকে ধর্মবিধান মতে শাসনও করেছিলেন।
আমার মনে হয়, দাবিটি যথাযথ নয়। দাবি সত্য হলে আল্লাহর বিধান ও শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারার যে ব্যর্থতা -তার দায় বর্তাবে অধিকাংশ নবীর উপর। কারণ, কুরআন-হাদিস ও ঐতিহাসিক দলিলাদি থেকে আমরা নবী আ.গণের জীবন-ইতিহাস সম্পর্কে যতোটুকু জানতে পেরেছি তার মধ্যে নবী ও শাসক ছিলেন মাত্র কয়েকজন।
অধিকাংশ নবীই নিজ সমাজে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। এমনকি অনেকেই বিতাড়িত হয়েছে নিজ জন্মভূমি থেকে। হত্যার শিকার হয়েছেন কেউ কেউ। আর তারা যদি আল্লাহর মনোনীত শাসকই হবেন তাহলে আল্লাহ কেনো তাদের হাতে শাসনভার তুলে দিলেন না? তাদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত করলেন।
লেখকের এ দাবির পেছনে রয়েছে একটি মৌলিক প্রশ্ন। তাহলো, মানুষ প্রধানত আল্লাহর দাস না আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি? মানুষ যদি প্রধানত আল্লাহর খলিফা হয়, তাহলে খেলাফত প্রতিষ্ঠাই হবে তার সব ইবাদতের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
আর যদি সে প্রধানত আল্লাহর দাস হয় তবে সর্বাবস্থায় আল্লাহর দাসত্ব এবং দাসত্বের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জন হবে তার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হলো, মানুষ প্রধানত আল্লাহর দাস। জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্যই হলো আল্লাহর জমিনের বুকে তার প্রতিনিধিত্ব করার মর্মকথা। শুধু রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা নয়; বরং তার জীবনের সব ক্ষেত্রে সে হবে আল্লাহর প্রতিনিধি। তার প্রতিনিধিত্ব প্রকাশ পাবে তার দাসত্বের মাধ্যমে।
মানুষকে যদি প্রধানত আল্লাহর প্রতিনিধি অর্থাৎপৃথিবীতে তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় সর্বতভাবে দায়বদ্ধ গণ্য করা হয়, তবে ইসলামের মৌলিক স্তম্ভসমূহ (পাঁচ রোকন) তার মৌলিকত্ব হারানোর সাথে সাথে শাসক হিসেবে নবী আ. গণের উপর ব্যর্থতার দায় চাপবে। বান্দা ও আল্লাহর মাঝের মায়া ও ভালোবাসার সম্পর্ক বিলুপ্ত হবে।
এমনকি দৈনন্দিন জীবনে তার দায়বদ্ধতাও কমে যাবে বহুলাংশে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার মিছিল ও সমাবেশের জন্য নামাজ ছেড়ে দেয়া বা কাজা করা বৈধ হয়ে যাবে। যেমন ধারণা কারো কারো মাঝে দেখাও যায়।
বরং আমরা এভাবে বলতে পারি, একজন মুমিন তার জীবনের সব কর্মকাণ্ডে আল্লাহর আনুগত্য করবে। এ আনুগত্যই আল্লাহর জমিনে তার প্রতিনিধিত্ব হিসেবে গণ্য হবে। আর যেহেতু আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা ব্যতীত তার পুরোপুরি দাসত্ব করা সম্ভব নয়, তাই আল্লাহর জমিনে তার শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। এ চেষ্টা করা তার জন্য ওয়াজিব।
কোনো সন্দেহ নেই, সব নবীই আল্লাহর জমিনে তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছেন কিন্তু সেটাই তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিলো না। বরং আল্লাহর বান্দার মাঝে তার একত্ববাদের প্রচার ও তার দাসত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিলো তাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
এজন্য ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তারা মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করে গেছেন। আল্লাহই সর্বোত্তম জ্ঞানী, তিনি সবচেয়ে ভালো জানেন।
সিলেটের ছক্কা ছয়ফুর! এক অনন্য সাধারণ বাংলাদেশি!
-আরআর