নেসারুদ্দীন কাসেমি: ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যাবো। ডাইরেক্ট গাড়িতে সিট না পেয়ে রংপুরের শ্যামলী পরিবহনে একটা টিকেট নিলাম।
রংপুর নেমে দিনাজপুরের একটা লোকাল-সিটিংয়ে উঠলাম। বিশ ঘন্টার জার্নিতে আগ থেকেই ক্লান্ত। সুপারভাইজারকে বলে উঠেছি সিট একটা দিতেই হবে সামনের দিকে। সে তার ওয়াদা রক্ষা করলো।
প্রথম সারিতেই একটা সিট দিয়েছে আমাকে। কিছুক্ষণ পরে ২৫-৩০ বছর বয়সী একজন অর্ধ-পর্দানশীন মহিলা উঠলেন। তখন বাসে কোন সিট নেই। যদিও সুপারভাইজার তাকে সিট দিবে বলে চুক্তি করেই উঠিয়েছে।
মহিলা সুপারভাইজারকে সিটের কথা বললে সে ক্ষীণস্বরে কী যেন একটা বললো। আমার ঠিক সামনে পার্শ্বঘেষে দাঁড়িয়েছে মহিলাটা। বাসের নড়াচড়ায় তিনিও বারবার পরে যাচ্ছিলেন। দুই হাত দিয়ে বাসের দু'পাশের রড ধরে রাখায় তার হিজাবটা সরে যাচ্ছিল বারবার। আবার একহাতে ধরেও দাঁড়াতে পারছিলেন না ।
এতগুলো পুরুষ-চক্ষুর সামনে এমন পরিস্থিতিতে তিনি ভীষণ নার্ভাস ফিল করছিলেন।
মহিলাটা পুরোদস্তুর পর্দাবৃত না হলেও কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের লাজুক টাইপের কেউ হবে বলে মনে হয়েছে। আমি সাধারণত বাস রেল জাতীয় এসব স্থানগুলিতে বোরকাধারী কাউকে দাঁড়িয়ে যেতে দেই না আমার সামনে। তাতে যত কষ্টই হোক।হিজাবের প্রতি এই শ্রোদ্ধাবোধটুকু অনেক আগে থেকেই।
এমনিতেই লম্বা জার্নিতে খুব ক্লান্ত। অপরদিকে মাথাটাও ব্যথা করছে প্রচুর। তবুও সিটটা ছেড়ে মহিলাকে বসতে দিলাম। তিনি প্রথমে ইতস্ততা বোধ করছিলেন। অস্বীকৃতি জানালেন বারদুয়েক। আমি দাঁড়িয়ে তাকে বসতে দেয়া তার কাছেও খারাপ লাগছিলো। তবুও অপারগ হওয়ায় তিনি বসলেন।
ঘণ্টাখানেক পর তার গন্তব্য চলে আসায় তিনি নেমে যাচ্ছেন। ততক্ষণে আমি সিট পেয়ে গেছি। নামার সময় মহিলাটা এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়তো আমাকে খুঁজছিলেন। আমি তখন পিছনের দিকে জানালার পাশে বসা।
বাইরে তাকিয়ে কিছু একটা দেখার ভান করছিলাম। ইচ্ছে ছিল তিনি যেন আমাকে খুঁজে না পান। নাহ! তিনি বাস থেকে নেমেও জানালাগুলির দিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছিলেন। হঠাৎ আমার উপর চোখ পড়লো।
একটা রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে আমার দিকে আসতে বললেন। আমার জানালার পাশে এসে চাপা কণ্ঠে কী যেন বললেন। মনে হচ্ছিল তিনি অনেক কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু কন্ঠ ভারি হয়ে আসছে।
স্পষ্ট আওয়াজ না বুঝলেও এতোটুকু বুঝলাম যে তার প্রতি আমার সামান্য অনুগ্রহে তিনি ভীষণ মুগ্ধ ও লজ্জিত। শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় তার লাল চোখদুটো অনেকটা অশ্রুসিক্ত দেখাচ্ছিলো। আমার সামনে পেছনে বসা লোকেরাও বিষয়টা লক্ষ্য করলেন।আমি অনেকটা ইতস্ততা বোধ করছিলাম । এর মধ্যে বাস ছেড়ে দিল।
বাস চলছিলো আর আমি মনে মনে পড়ছিলাম الإنسان عبد الإحسان (মানুষ অনুগ্রহের গোলাম।) হাদিসটা স্বরণ হওয়ায় আরো বেশি আনন্দ লাগছিলো... وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ . [ مسلم عن أبي هريرة]
আসলেই সামান্য উপকার দিয়ে একজন স্বাধীন মানুষকে গোলামে পরিনত করা যায়। তার ভালবাসার রাজ্য জয় করা যায়। শত্রুকে মিত্রতে পরিনত করার জন্য উপকারের চেয়ে উত্তম কোন কৌশল হয়তো পৃথিবীতে আর নেই।
পুনশ্চ: আমার সঙ্গে কোন ক্যামেরাম্যান থাকে না। আর আমিও ফটো তোলায় তেমন এক্সপার্ট না।কোন ফটো নেই
নেসারুদ্দীন কাসেমির টাইমলাইন থেকে
এইচজে