আবদুল্লাহ তামিম: মহিমান্বিত রমজান। রমজান ইবাদতের মাস। কুরআন তেলোয়াতের মাস। রমজানে আল্লাহ ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মিলনমেলার মাস।
ইবাদত মাগফিরাত নাজাত আর রহমতের মাস রমজান। রমজান মাস কুরআন নাজিলের মাস। এ মাসে কুরআনে পাকের সঙ্গে প্রতিটি মুমিনের সর্বাধিক সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন।
কুরআন বিশুদ্ধভাবে শেখা, কুরআনের তিলাওয়াত, তরজমা, তাফসির ও কুরআন পাকের বিধান প্রতিষ্ঠা, দা’ওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে কুরআনি জীবন গঠনের দাবি ছিল অপরিহার্য।
অন্তত কুরআনে কারিম তিলাওয়াতের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং আল্লাহ তাআ’লার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের এটাই সুবর্ণ সুযোগ।
আমরা আজকাল রমজানে ইবাদতের মধ্য দিয়ে কাটানোর থেকে ব্যস্ততায় লিপ্ত হয়ে যায়।
অথচ আমাদের আকাবিরদের জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই তার রমজানে আল্লাহর রঙে রঙ্গীন হতেন এ মহিমাময় মাসে।
ইমাম আজম আবু হানিফা রহ.-এর কথা প্রসিদ্ধ আছে তিনি রমজান মাসে ৬১ খতম তিলাওয়াত করতেন। আমাদের মুরব্বী হযরত শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ. তারাবিতে শোয়া পারা শোনাতেন, সাহরি পর্যন্ত তরজমাসহ তা পড়তেন চার-পাঁচ বার।
সে অংশটুকু তাহাজ্জুদের সময় শোনাতেন দু’বার। সাহারি খাওয়ার পর ফজরের নামাজের আগে এবং পরে ঘুমানোর আগে সে অংশটুকু একবার তিলাওয়াত করতেন।
আপনার মোবাইলকে সাজান কুরআন হাদিসের আলোয়, ইনস্টল করুন ইসলামী যিন্দেগী
সকাল দশটার দিকে ঘুম থেকে ওঠে শীতের দিনে চাশতের নামাজে একবার এবং গরমের দিনে দু’বার তিলাওয়াত করতেন। জোহরের নামাজের পনের মিনিট আগে দেখে দেখে দু’বার তিলাওয়াত করতেন। জোহরের নামাজের ফরজের আগে সুন্নতে দু’বার, পরের সুন্নতে একবার তিলাওয়াত করতেন। জোহরের নামাজের পর বন্ধুদের কাউকে একবার শোনাতেন।
আসরের নামাজের আগে দু’ বা একবার পড়তেন। আসরের পর বয়স্ক কাউকে একবার শোনাতেন। মাগরিবের নামাজের পর নফল নামাজে সে শোয়া পারা আরেক বার তিলাওয়াত করতেন।
প্রতিদিনের আমল ছিল এভাবে। ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ত্রিশবারে ত্রিশ পারা তিলাওয়াতে জোর দিতেন।
-শায়খ যাকারিয়্যা রহ. এ আত্মজীবনী হতে সংগৃহীত
হজরত খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. বাদ মাগরিব নফলে শোয়া পারা তিলাওয়াত করতেন। আর তাহাজ্জুদে করতেন সাধারণত দু’ পারা। তারাবি তো আমৃত্যু তিনি নিজেই পড়াতেন।
কুতুবে আলম হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী রহ. বাদ মাগরিব আওয়াবিনে দু’ পারা ও তাহাজ্জুদসহ দৈনিক অর্ধ খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন।
আল্লামা কাসিম নানুতুবী রহ. ১২৭৭ হিজরিতে মক্কা-মদিনা সফরকালে রমজান মাসে কুরআন পাক মুখস্ত করেছিলেন।
এরপর থেকে তিনি বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। একবার তিনি এক রাকাতে সাতাশ পারা তিলাওয়াত করেছিলেন। হাজী এমদাদুল্লাহ মক্কি রহ. সারা রাত বিভিন্ন হাফেজদের থেকে পালাক্রমে নামাজে তিলাওয়াত শুনতেন।
হযরত শাহ আবদুর রহিম রায়পুরী রহ. হাফেজে কুরআন ছিলেন। প্রায় সারারাত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। চব্বিশ ঘণ্টায় তিনি শুধু এক ঘণ্টা ঘুমাতেন।
শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ. হাফেজ ডেকে নামাজে সারারাত কুরআন শরিফ শুনতেন। তারাবিতে কখনও ছয় পারা, কখনও দশ পারা পড়া হতো।
শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. বাদ আসর দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষক হাফেজ-মাওলানা আবদুল জলিল রহ.-এর সেঙ্গ শোয়া পারা দাওর করতেন অর্থাৎ পরস্পর শোনাতেন।
হযরত মাওলানা ইয়াহইয়া রহ. রমজান মাসে দৈনিক চল্লিশ পারা তিলাওয়াত করতেন।
শায়খুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া রহ.-এর দাদিজানও কুরআন কারিমের হাফেজ ছিলেন। সুন্দর মুখস্ত ছিল তার। ঘর-গৃহস্থালীর সমস্ত কাজ-কর্ম করার পরও প্রতিদিন তিনি এক মঞ্জিল তিলাওয়াত করতেন।
তাদের ইফতার-সাহারি
আমরা সাধারণ ইফতারে খেজুর, শরবত, সেমাই, চনা, মুড়ি, বেগুনি, পেয়াজু, জিলাপি, নানারকম ফল-ফলাদি, খেয়ে থাকি এবং এত বেশি পরিমাণে খেয়ে থাকি যা সারা দিনের সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
কেউ কেউ তারাবি’র আগে ঘুমিয়ে পড়ি। আবার অনেকে তারাবি পড়তে কষ্ট অনুভব করি। কিন্তু আমাদের বড়রা ইফতারিতে খুব বেশি খেতেন না। তাদের অনেকেই খেজুর ও যমযমের পানি দ্বারা ইফতার করাকে বেশি ভালোবাসতেন।
হযরত খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. ইফতারিতে খেজুর ও যমযমের পানিকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। তার ইফতার এবং মাগরিবের নামাজের দশ মিনিট ব্যবধান হত। তিনি মাদরাসায় ইফতার করতেন। তার সাথে খাদেম এবং মেহমানও ইফতার করতো।
হযরত রশিদ আহমদ গঙ্গোহী রহ. ইফতার-সাহারি সব মিলে সারা রমজান মাসে পাঁচ সেরের বেশি খেতেন না। শাহ আবদুর রহিম রায়পুরী রহ.-এর ইফতার ও সাহরি উভয়ই মিলে খোরাক ছিল দু’কাপ চা এবং একটি বা অর্ধেক চাপাতি রুটি।
হযরত শাইখুল হিন্দের সাহরিতে জর্দ্দার ব্যবস্থা করা হতো। সাহারানপুরী হযরতের সাহরিতে দুধ ইত্যাদির বিশেষ কোন গুরুত্ব দেয়া হত না। মাঝে মাঝে পোলাও পাক করা হতো। পায়েশ হাদিয়া আসলে তিনি এক চামচ বা আধা চামচ খেতেন।
হযরত হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবি রহ. ইফতার মাদরাসায় মেহমানদের সাথেই করতেন। আজান সময় মত হতো। ধীরে সুস্থে ইফতার করতেন।
শাইখুল ইসলাম হযরত মাদানি রহ.-এর দস্তরখানে ইফতারিতে খেজুর, যমযম, নাশপাতি, আনারস, সাগরকলা, পেয়ারা, আম, বছরী খেজুর, ডাব, পেঁপে, জর্দ্দা ও সিদ্ধ ডিম থাকতো।
কিন্তু তার ইফতার ছিল সংক্ষিপ্ত। তিনি সামান্য কিছুই গ্রহণ করতেন। তার দস্তরখানে ইফতারের সময় আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতো কিন্তু তিনি ভাবনার সাগরে ডুবে থাকতেন। হযরত মাওলানা ইয়াহইয়া রহ.-এর সাহরিতে দুধ ইত্যাদির কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না।
এমনই ছিলো আকাবিরদের রমজান। আল্লাহ আমাদেরও- নবি কারিম সা. সাহাবি ও আকাবির আসলাফদের মত রমজান কাটানোর তাওফিক দান করুন। অামিন।
রমজানে তাফসির মাহফিলে রাষ্ট্রপতি
-আরআর