মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী: এমন দিনও দেখতে হবে কখনো কল্পনায়ও আসেনি। এ সুন্দর সাজানো বাগান। আমরা এর বাইরের সৌন্দর্যে যেমন মুগ্ধ হয়েছি। তেমনি সাময়িক সময়ের মেহমান হয়ে আরো বেশি আকৃষ্ট হয়েছি এ বাগানের সুঘ্রাণে।
আমরা ছিলাম যার একান্ত ভক্ত। অনুরক্ত। যে তাবলিগের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে ছলকে উঠতো আমাদের রক্ত। লেখায় বয়ানে, বক্তৃতায় আমরা প্রতিবাদ করতাম। দলিলের আলোকে সমুচ্চ করে তুলতাম দাওয়াত ও তাবলিগের মানহাজ ও পদ্ধতিকে।
ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের হক্কানি উলামাগণ পূর্ণাঙ্গ সাপোর্ট দিয়েছে তাবলিগ জামাতকে। কখনো তাবলিগের মুরুব্বী সেজে মাতব্বরী করার খাহেশ জাহির করেননি বরেণ্য কোন শাইখুল হাদিস কিংবা আল্লামা। যে যার কাজে দরস-তাদরীস, ফিকহ-ফাতওয়া নিয়েই মগ্ন ছিলেন। সময় পেলে তাবলিগি মুরুব্বীদের অধীনেই দ্বীনী তাকাজায় শরিক হতেন। নিজেরা কখনো তাদের আসনে বসার ইচ্ছে প্রকাশ আগেও করেননি, এখনো নয়।
বিজ্ঞ উলামাগণের মত কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা প্রদান, মুফতিয়ানে কেরামের মত ফিকহ ও ফাতওয়া নিয়ে সুচিন্তিত মত পেশ করার সময়, সুযোগ, অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা যেমন তাবলিগি মুরুব্বীদের অনেকেরই নেই, তেমনি তাবলিগের সাথীদের মত সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তাবলিগের মারকাজে পড়ে থেকে এ কাজে জড়িয়ে থাকার সুযোগ বিজ্ঞ উলামা হযরতের নেই।
তাই উভয় জামাত উভয় জামাতকে মুহাব্বত করেন। ভালবাসেন। কল্যাণকামী। সবাই সবার কাজ করে যাচ্ছেন। নিষ্ঠার সাথে। এক জামাত অন্য জামাতের সহযোগী। হিতাকাঙ্ক্ষী। বিরোধী বা প্রতিপক্ষ নয়।
ইখলাস, লিল্লাহিয়্যাত, রবের সন্তুষ্টির জন্য সব কিছু কুরবান করা, খিদমতে খালক, উত্তম চরিত্র, অন্যকে প্রাধান্য দেয়ার মানসিকতা, বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ, সুন্নতের পাবন্দ, সাহাবা আজমাঈনের আখলাকের জলন্ত প্রতিচ্ছবি, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য ছিল তাবলিগি সাথী ও মুরুব্বীদের প্রধান পরিচয়। পুরো বিশ্ব জোরে এ কাজের দ্যুতি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ার পিছনে ছিল এসব আখলাকী চালিকাশক্তি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ নববী মেহনতের কাজের ভিতরে জমা বাঁধছিল কিছু ময়লা। আবর্জনা। যা আমাদের অজান্তেই নষ্ট করে দিচ্ছিল সুন্দর সাজানো বাগানের পরিবেশ। আল্লাহ হিফাযত করুন।
এ সংকটের জন্য দায়ী কারা?
আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি, দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, তাবলিগের এ চলমান সংকটের জন্য দেওবন্দের ফাতওয়া, কিংবা বাংলাদেশের উলামাগণের প্রতিবাদ মোটেও দায়ী নয়। হতেই পারে না। তাবলিগের চলমান সংকট বিষয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ উলামাগণ সভা করেছেন ২০১৭ সালের ১১ই নভেম্বর। আর দারুল উলুম দেওবন্দ মাওলানা সাদ সম্পর্কে তাদের অনাস্থার ফাতওয়া প্রদান করেন বিগত ৫ই ডিসেম্বর ২০১৬ সালে।
তাহলে তাবলিগ বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দ ও বাংলাদেশের উলামাগণের অবস্থান পরিস্কার করা হয় সর্বোচ্চ ২০১৬ সালের শেষ দিকে এবং ২০১৭ সালে। কিন্তু তাবলিগের সংকট কি এ ফাতওয়া প্রকাশ ও বাংলাদেশের উলামা হযরতের মিটিং এর পর সৃষ্টি হয়েছে?
নিজামুদ্দিন বা কাকরাইলের সাথে সম্পৃক্ত কোন মুরুব্বী বা কোন সাথী এ দাবি কী করতে পারবেন? পারবেন না। কারণ উক্ত ফাতওয়ার কারণে এ সংকট তৈরি হয়নি। এ ঝগড়া অনেক আগের। বহু আগের। সেই ২০১২/১৩ সাল থেকে শুরু। কিংবা আরো পুরোনো।
২০১৪ মুশফিক স্যার মরহুম এবং জনাব ওয়াসীফ সাহেবের গণ্ডগোল তাবলিগি সাথীদের সবারই জানা। তাহলে তাবলিগের চলমান সংকট ২০১৭ সালে সৃষ্ট না ২০১৩ সালে?
উলামাগনের কারণে তৈরি না নিজেদের ক্ষমতার দ্বন্দ নিয়ে তৈরি?
উলামায়ে কেরাম কিছুতেই এ সংকট তৈরির জন্য দায়ী নয়। দ্বন্দ সংঘাত যখন হাতাহাতি, দাড়ি টানাটানি, ক্যাডার বাহিনী দিয়ে মাস্তানী পর্যন্ত গড়ায়, তখন উলামাগণের কাছে এর সমাধানের জন্য চিঠির পর চিঠি আসতে থাকে। আমি অধমের মত নগণ্য ব্যক্তির কাছেও অসংখ্য মেইল ও চিঠি এসেছে বিগত কয়েক বছরে। কিন্তু লজ্জায় চুপ ছিলাম। কাকে বলবো? কিভাবে বলবো? কে মানবে আমার কথা?
দারুল উলুম দেওবন্দ! ঠিক একইভাবে এ সংকটের জন্য দায়ী নয়। দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ একটি দীনী দরসগাহ। ইলমে ওহির বাতিঘর। যেখান থেকে কুরআন ও সুন্নাহের আলো বিচ্ছুরিত হয় দুনিয়াব্যাপী। মাওলানা সাদ সাহেবের কুফরী বক্তব্য নির্ভর বয়ান বিষয়ে দারুল উলুমে প্রশ্ন এলে দীনী দায়িত্ব পালনার্থে তারা মাসআলার সমাধান দিয়েছেন।
ব্যক্তি মাওলানা সাদের বক্তব্যের কুরআন ও হাদিস ভিত্তিক সমাধান পেশ করেছেন। তাবলিগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। বা তাদের মসনদ দখল করার কোন হীন খাহেশও জাহির করেননি।
সুতরাং এ ফাতওয়া প্রদানকে আরো তিন চার বছর আগে থেকে চলতে থাকা ঝগড়ার ইন্ধনদাতা হিসেবে উপস্থাপন করা ঘৃণ্য ও নীচ মানসিকতা ছাড়া আর কী হতে পারে? সুতরাং প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাছেই পরিস্কার হবার কথা যে, দারুল উলুম দেওবন্দের ফাতওয়া বা বাংলাদেশের উলামাগণের পদক্ষেপ তাবলিগের চলমান সংকটের জন্য কোন অংশেই দায়ী নয়।
এটি তাদের পুরনো ঝগড়া। পুরনো বিবাদ। যা তাদের নিজেদের মজলিশে শুরা সদস্য এবং মুরুব্বীদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। দেওবন্দ ও বাংলাদেশের শীর্ষ উলামাগণ এর জন্য কোন অংশেই দায়ী ছিলেন না। এখনো নয়। উলামাগণ তাদের মুরুব্বীর আসনে বসার বা নিজে মুরুব্বী সেজে তাবলিগ জামাতকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছে আগেও কখনো জাহির করেননি এখনো নয়। তাই উলামায়ে কেরামকে এ সংকটের জন্য দায়ী করা চরম অপবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
তাবলিগি ভাই! তোমার মুখের এ কী ভাষা?
তাবলিগকে হেফাজতীরা দখল করতে চায়! পাকিস্তানপন্থী উলামারা তাবলীগের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়! কওমি মাদরাসায় ছাত্র ভর্তি করার আগে ভেবে নিন আপনার সন্তান কী করবে!
ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন। তাবলিগের সাথী নামধারী কতিপয় সাথীদের উপরোক্ত বক্তব্য নির্ভর ভিডিও যখন দেখি, অঝর ধারায় অধমের চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। যখন কম্পোজ করছি তখনো অধমের চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। ভিডিওটি দেখার পর থেকে সারারাত বিছানায় এপাশ উপাশ করে কাটিয়েছি। হায়! আমি এ কি দেখলাম? এ কি শুনতে পাচ্ছি? আমি কার জন্য কাঁদি। কার ব্যথায় ব্যথিত হই।
আজকের এ দিনটির জন্যই কি রাতকে দিন বানিয়েছিলাম। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছিলাম। আমার তাবলীগ। আমাদের তাবলীগ। আমার তাবলিগি ভাইটা আমাকে, আমাদের এ কী বলছে?
হেফাজতি। কী এই হেফাজত? হেফাজত কি কোন এক ব্যক্তির দল? এটি কি শুধুই একটি সংগঠন? না, কস্মিনকালেও না। এটি একটি আন্দোলন। ঈমানি আন্দোলন। নবি প্রেমিকের দিলের স্পন্দন। নাস্তিকের বিরুদ্ধে মুমিনের গর্জন। নবীর দুশমনের বিরুদ্ধে আশেকে রাসূলের হুংকারের নাম হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতের কোন নেতার বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ থাকতেই পারে। থাকাটাও যৌক্তিক। কিন্তু মূল হেফাজতে ইসলামের সেই স্প্রিট, সেই চেতনার প্রতি আপনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারেন না। কোন মুমিন পারে না। এতো নবির প্রতিই দুশমনির নিদর্শন। ‘হেফাজতী’ বলে গালিটাতো নাস্তিক বা তার দোসরদের। নবির দুশমনের। কিন্তু হে আমার সাথী। হে আমার বন্ধু, তোমার জবানে এ গালি উঠলো কি করে? তোমার ঈমান কোথায়? তোমার বিবেক কোথায়? তোমাকে কে এমন অন্ধ বানিয়ে দিল? কে তোমাকে এমন বধির বানিয়ে দিল? তুমি কী বলছো একবার ভেবেছো কী?
পাকিস্তানপন্থী!
যতবার অধমকে আল্লাহ তাবলিগের স্থানীয় মারকাজে যাবার তৌফিক দিয়েছেন। বড়দের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের অনেক পুরানো সাথীদের জবানে শুনতাম পুরো বিশ্বে তাবলীগের মেহনত ছড়ানোর পিছনে পাকিস্তানীদের একনিষ্ট মেহনতের কথা কেউ অস্বিকার করতে পারবে না। তাদের সাথে জামাতে গেলে কোন নিস্তার নেই।
সারাদিনই দাওয়াত দেবার মেহনতে থাকেন। অনেক কষ্ট করেন। অনেক মুজাহাদা করেন। পাকিস্তানীদের মেহনতের তুলনা হয় না। উম্মতের প্রতি এত দরদ, এত মোহাব্বত পাকিস্তানীদের ছাড়া নজীর পাওয়া ভার। আজকে হঠাৎ সেই পাকিস্তানি তাবলীগের সাথীরা হয়ে গেলেন জঘন্য। নিকৃষ্ট। খারাপ। আফসোস! বড়ই আফসোস!
প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের উলামা হযরতগণ কিভাবে পাকিস্তানপন্থী হলেন? উলামাগণের কারণে তো এ সংকট তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে ভেতরগত কারণে। তাহলে উলামাগণকে পাকিস্তানপন্থী বলে কাকে খুশি করতে চাচ্ছেন? খালিস দ্বীনী এ মেহনতকে আর কত নিচে নামাতে চাচ্ছেন আপনারা? শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তান ইস্যু পর্যন্ত টেনে আনছেন। ইন্নালিল্লাহ। আল্লাহর পানাহ।
বাংলাদেশের আলেমদের কেন দোষারোপ করেন?
পাকিস্তানে মাওলানা সাদ নিষিদ্ধ। অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে মাওলানা সাদের কট্টর অনুসারীদের পিটিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে মাওলানা সাদকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপ। একই হালাত ভারতে। একই অবস্থা লন্ডনসহ পুরো বিশ্বে। পাকিস্তান, অষ্ট্রেলিয়া, লন্ডন, ভারতে এই গ্রুপিং এর জন্য কি বাংলাদেশের উলামাগণ দায়ী? অষ্ট্রেলিয়া, ভারত, লন্ডনের মাওলানা সাদ বিরোধীরাও কী পাকিস্তানপন্থী?
বাংলাদেশের উলামাগণ তাবলিগের মারকাজের মুরুব্বী সাজতে আগেও যেমন আগ্রহী ছিলেন না। এখনো নয়। আর এ সংকটের জন্য বাংলাদেশের উলামাগণ মোটেও দায়ী নয়। তাই বাংলাদেশের সম্মানিত উলামা হযরত, এবং দারুল উলুম দেওবন্দের সেরেতাজ উলামাগণকে দোষারোপ করে নিজের আমলনামায় গোনাহ না লিখাতে সকল সাথীদের প্রতি উদাত্ত আহবান করছি।
শেষ কথা
কী লিখবো? কিভাবে লিখবো? বুঝতে পারি না। যদি আমার চোখের পানিতে জমিন ভিজে গেলে থেমে যেতো এ বিতর্ক, তবে আমি তাই করতাম। চিৎকার করে কাঁদতাম। মাতম করে কাঁদতাম।
এ কোন সময়ে আসলাম? এও কী দেখতে হল? কী বলে সান্ত্বনা দেব নিজেকে? ভাষা নেই। সমঝ যেখানে থমকে গেছে। বুদ্ধি যেখানে স্তব্ধ। জবান যেখানে বাকরুদ্ধ। কলম যেখানে নিথর। কিছু বলতে পারি না। অসহ্য এক দাহনে জ্বলছি। পুড়ে ছাই হচ্ছে সব। চিৎকার করতে পারি না। কলজে ছেড়া ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সব, মুখ ফুটে বলতে পারি না কিছুই।
আহ! আর কতোদিন এ অসহ্য দাহনে জ্বলবো জানি না। হে মালিক! পারওয়ার দিগার। তোমার রহমান গুণের কসম লাগে মালিক! এ যাতনা দূর কর। এ সংকট সমাধান করে দাও। ফিরিয়ে দাও স্থিতিশীলতা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনে তোমার ভয় দিয়ে দাও। সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার তাওফিক দাও। এ মকবুল মেহনতকে তার সেই পূর্বের রূহানী পরিবেশে ফিরিয়ে দাও। আমাদের সকলকে তোমার গোলাম হিসেবে কবুল কর। আমীন।
আরো পড়ুন : সঙ্কটে তাবলিগ: দুই আলেমের বিপরীতমুখী মতামত
এইচজে