চৌধুরী মনজুর লিয়াকত: ইসলাম ধর্মের বিধান হলো- শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি প্রত্যেক শ্রমিকের প্রয়োজন ও কর্মানুসারে নির্ধারিত হবে। আর শ্রমিককে কমপক্ষে এমন মজুরি দিতে হবে, যাতে সে এর দ্বারা তার ন্যায়ানুগ ও দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।
এখানে ১৬ নং সূরা আন-নহল এর ৭১ নং আয়াতটি তুলে দিলাম মাত্র, যেখানে আমাদের অধীনস্থদের (বাসার কাজে সহযোগী, শ্রমিক আর যারা বিভিন্ন শ্রমভিত্তিক কাজ করেন কিন্তু অবস্থাসম্পন্ন নয় তারা সহ) নিজ অবস্থানে নিয়ে আসার দায়িত্বের বিষয়টি ঠিক এভাবেই আছে ।
"আল্লাহ তোমাদের কাউকে কাউকে অন্যদের চেয়ে বেশি জীবনোপকরণ দিয়েছেন। যাদের অতিরিক্ত জীবনোপকরণ দেয়া হয়েছে, তারাও (সাধারণত) নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে তাদের অধীনদের এমন কিছু দেয়না, যাতে ওরা তাদের সমকক্ষ হতে পারে। এর মাধ্যমে তারা কি আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করছেনা"।
শ্রমে নিযুক্ত প্রতিটি শ্রমিকেরই ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না। শ্রমিকের ন্যায্য প্রাপ্য মজুরি পরিশোধের বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ -ইবনে মাজাহ
কাজ সম্পাদন করামাত্রই শ্রমিককে তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের সর্বপ্রধান দায়িত্ব। এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা হলো- শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি দিতে হবে। যেমনটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করবে না। -সহিহ বোখারি
শ্রমিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। কারণ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করবেন। তন্মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছে, যে ব্যক্তি কাউকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে, তার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করা সত্ত্বেও তাকে পারিশ্রমিক প্রদান করে না।’ –সহিহ বোখারি
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘অধীনদের সঙ্গে অসদাচরণকারী বেহেশতে যেতে পারবে না।’ –তিরমিজি
জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায় শ্রম। এ কারণে নবী করিম (সা.) শ্রম বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘শ্রমজীবীর উপার্জনই উৎকৃষ্টতর, যদি সে হয় সৎ উপার্জনশীল।’ -মুসনাদে আহমদ
যুগে যুগে প্রত্যেক নবীই নিজ নিজ শ্রমলব্ধ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল পথে শ্রম বিনিয়োগ বিন্দুমাত্রও লজ্জার ব্যাপার নয়। বরং এ হচ্ছে নবীদের সুন্নত। মুসতাদরাকে হাকিমে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, হজরত দাউদ (আ.) লোহার বর্ম তৈরি করতেন। হজরত আদম (আ.) কৃষি কাজ করতেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। হজরত ইদরিস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন এবং হজরত মূসা (আ.) রাখালের কাজ করতেন।
প্রিয় নবীর সাহাবারা নিজেরা যেমন শ্রমদানে অভ্যস্ত ছিলেন, তেমনি অন্যদেরও শ্রমদানের প্রতি উৎসাহিত করতেন। নবী কন্যা হজরত ফাতেমার (রা.) বিষয়ে উল্লেখ আছে, পানি টানতে গিয়ে তার বুকেপিঠে দাগ পড়ে যেত, যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতে ফোসকা পড়ে যেত, তবুও তিনি শ্রম-বিমুখ হননি।
এমনকি মানবসেবার মূর্ত প্রতীক মহানবী (সা.) খন্দক যুদ্ধের প্রাক্কালে নিজ হাতে পরিখা (দূর্গ) খনন কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের মহান পেশাকে সম্মানিত করেছেন।
আমাদের নবীজি হজরত মুহাম্মদ সা. একজন সৎ শ্রমজীবি মানুষ ছিলেন। খেটে খাওয়া মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর অন্যতম একটি উক্তি ছিল 'Work is Worship' অর্থাৎ 'কাজই ইবাদত'। যখন সৎ জীবিকা অর্জনের প্রচেষ্ঠা আমরা করবো তখন সেই পরিশ্রমের সময়টিকেও আমরা এভাবেই চিন্তা করবো।। আরবের ধনাঢ্য মহিয়সী নারী হজরত খাদিজাতুল কুবরার ব্যবসায় শ্রম বিনিয়োগ করেছেন হজরত মুহাম্মদ সা.।
ব্যবসায় নবীজির সততার এবং সফলতার কথা পৃথিবী আজ অবগত। শ্রমজীবি নবীজির ভক্ত-অনুরক্ত সাহাবারাও গায়ে গতরে খেটে খাওয়া মানুষের উদাহরণ ছিলেন।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. ছিলেন আরবের ব্যবসায়ী। নিজে ব্যবসায় শ্রম দিয়েছেন, অন্যদের জন্য সৎ কাজের ব্যবস্থা করেছেন। হযরত বেলাল রা. কে মুক্ত করেছেন।
বাইশ লক্ষ বর্গমাইল রাজ্যের প্রধান হজরত ওমর রা. ছিলেন একজন রাখাল। মাঠের শ্রমিক। মক্কার জানজান ময়দানে তিনি উট চড়াতেন। এক সময় তার রাজত্বকালে এই মাঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ঝাড় ঝাড় চোখের পানি ফেলে কাঁদছিলেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে খলিফা ওমর বলছিলেন, আমি এই মাঠে উটের রাখাল ছিলাম।
গায়ে পুরো নয়; টুকরো কাপড় ছিল। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়লে বাবা বেদমভাবে প্রহার করতেন। আজ আল্লাহর করুণায় এই আকাশের নিচে আমি প্রধানতম ব্যক্তি। রাখাল ওমর আজ রেশমি রোমাল দিয়ে নাকের ময়লা পরিস্কার করে!
ব্যবসা ও বাণিজ্যে শ্রমের প্রবাদপুরুষ হজরত উসমান রা.। ইহুদির বাড়িতে খেটে সংসার চালানো শ্রমজীবি মানুষটির নাম হজরত আলী। হজরত আলী রা. নিজের শ্রম জীবনের কথা এভাবে বলেন, আমরা তখন মদিনায়।
নবীজি, হজরত ফাতেমাসহ ঘরের সবাই ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছেন। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে শহরতলির দিকে কাজের সন্ধ্যানে বেরিয়ে পরি। এক স্থানে একজন মহিলাকে মাটি জমা করতে দেখি। মনে হলো সে হয়তো মাটি ভেজাবে। অনুমান সত্য হলো।
তখন একেকটি খেজুরের বিনিময়ে একেক বালতি পানি কূপ থেকে তুলে দেয়ার কাজ নিলাম। ১৬ বালতি পানি তুললাম। আমার হাতে লালে লাল ফোসকা পড়ে গেল। কাজ শেষে হাত-মুখ ধুয়ে পারিশ্রমিক পেলাম ১৬টি খোরমা।
খোরমা নিয়ে দৌঁড়ে হাজির হই নবী করিম সা. এর কাছে। পুরো ঘটনা নবীজি শুনলেন। চোখের পানি ফেললেন। পেটের ক্ষুধা মিটাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে খোরমা খেলেন।
হজরত আবু হুরায়রাও রা. মদিনায় একজন মহিলার গৃহশ্রমিক হিসাবে কাজ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি বুশরা বিনতে গাজওয়ানের ঘরে খাবার এবং এক জোড়া জুতার বিনিময়ে কাজ করতাম।
তারা উটে আরোহণ করলে তা হাঁকিয়ে নিয়ে যেতাম এবং নেমে এলে তাদের সেবা করতাম। এছাড়াও হজরত বেলাল রা. মসজিদে নববীর মোয়াজ্জিনের কাজ করতেন।
হজরত ইকরামা রা. ছিলেন ইবনে আব্বাস রা. বাড়ির শ্রমিক। মহিলা সাহাবি উম্মে আয়মান বারাকাহ ছিলেন নবীজির দাদা আবদুল মুত্তালিবের গৃহপরিচালিকা।
হজরত জায়েদ রা. ছিলেন খাদিজতুল কুবরার খাদেম। ইসলামের প্রথম শহিদ হজরত সুমাইয়া রা. ছিলেন হজরত আবু হুজাইফার কেনা গোলাম।
বিখ্যাত সাহাবী হজরত সালমান ফারসির জীবনও কেটেছে মরু আরবের মাঠে-ঘাটে। পথে পান্তরে। এক সময় খলিফা ওমরের শাসন আমলে মাদাইনের গর্ভণর ছিলেন হজরত সালমান ফারসি।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পাওয়া ৫ দেরহাম পুরোটা সদকা করে দিতেন। আর সংসার চালাতেন খেজুর পাতার ঠোঙা বিক্রি করে। (ক্রীতদাস থেকে সাহাবি : ১০৫)
শ্রমের এমন গুরুত্বের কারণেই ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তিকে নিষেধ করেছে। বর্তমান ভিক্ষাবৃত্তি একটি ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে।অগণিত ভিক্ষুকের কর্ম ও শ্রমের প্রতি নিদারুণ অনীহা পেয়ে বসেছে। ফলে তারা ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে উপার্জনে নেমে যাচ্ছে। এটা স্বভাবে পরিণত হচ্ছে। ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তিকে পছন্দ করে না। তাই তো নবী করিম (সা.) ভিক্ষাবৃত্তির পরিবর্তে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহের প্রতি জনৈক ভিক্ষুককে শিক্ষা দিয়েছিলেন।
তাই অন্যের উপর নির্ভরতা আর ভিক্ষাবৃত্তিকে দূরে রেখে ইসলাম ইবাদত, সৎ কাজ এবং সময়মত ন্যায্য মজুরী প্রদানে বিশাল গুরুত্ব আরোপ করেছে।
চৌধুরী মনজুর লিয়াকত
প্রাবন্ধিক
আরো পড়ুন- বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে সাভারে শ্রমিক বিক্ষোভ