কারি আহমাদ বিন ইউসুফ আল আজহারী
স্বাধীন সার্বভৌম লাল সবুজের অপূর্ব সুন্দর একটি দেশের নাম বাংলাদেশ, আর এই ব-দ্বীপে এসেছেন অসংখ্য আল্লাহর ওলি এবং দীন এর বড় বড় খাদিম যারা এই জাতির জন্য ভিন্ন ভিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে অসামান্য অবদান রেখেছেন, আর তাদের মধ্যে এই বাংলাদেশের যে কয়জন শ্রেষ্ঠ সন্তান রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন তৎকালীন এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠ কারিদের অন্যতম, উপমহাদেশের ইলমে কিরাত জগতের কিংবদন্তী, বাংলাদেশের শুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত ও ইলমে কিরাতের পথপ্রদর্শক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাইখুল কুররা হজরত মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ।
জন্ম: ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে তৎকালীন উপমহাদেশের (স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার (বর্তমান কর্ণফুলি থানা) দৌলতপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন।
শিক্ষা জীবন: ৫ বছর বয়সে তিনি পটিয়ার মাওলানা খায়ের আহমাদ রহ. এর কাছে কুরআনের প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করা শুরু করেন। ৭ বছর বয়সে চট্টগ্রামের পটিয়ায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জিরি মাদরাসায় কুরআন হিফজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে উক্ত প্রতিষ্ঠানেই হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ১৯৫৭ সালে দাওরা-এ-হাদিস সম্পন্ন করেন।
ঘটনাক্রমে একদিন আসরের নামাজের সময় তার আজান শুনে কণ্ঠস্বরের প্রশংসা করে জিরি মাদরাসার মুহাদ্দিস শাইখুল হাদিস হজরত মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ সন্দিপী রহ. এবং জিরি মাদরাসার তৎকালীন মুহতামিম মাওলানা আহমাদ হুসাইন রহ. তাকে ইলমে কিরাতের এই (ফন) বিষয়ের উপর উচ্চতর পড়াশুনা করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করেন।
পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে যান। সেখানে তিনি পাকিস্তানের প্রখ্যাত কারি যাহের কাসেমি রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘মাদরাসা দারুল কুরআন লাজভেলা করাচি’ তে ভর্তি হন [কারি জাহের কাসেমি রহ. দারুল উলুম দেওবন্দ এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ. এর নাতি এবং দারুল উলুম দেওবন্দ এর দীর্ঘ সময়ের মুহতামিম মাওলানা কারি তৈয়ব রহ. এর ভাতিজা ছিলেন, এ ছারাও তিনি ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন]।
সেখানে হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ ‘ইলমে ক্বিরাতের’ উপর কঠিন অধ্যবসায় শুরু করেন, উনার কিরাতের উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন ইয়েমেনের বিশ্ববিখ্যাত কারি উস্তাদ শাইখ আলি মুহাম্মাদ শরফুদ্দিন রহ., উপমহাদেশের প্রখ্যাত কিরাতের উস্তাদ আফগানিস্তানের হাবিবুল্লাহ খাঁন আফগানি রহ. [যার লেখা ৭ ও ১০ কিরাতের কিতাব উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধ], দিল্লির (পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানের) কারি মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহ. এবং মিসর থেকে প্রেরিত প্রসিদ্ধ কিরাতের শিক্ষকগণের অধীনে থেকে দীর্ঘ ৫/৬ বছর ইলমে কিরাতের ওপর পড়াশুনা করেন এবং ১৯৬২ সালে ইতিহাসের সর্বপ্রথম বাঙালি হিসেবে রাসুলুল্লাহ সা. হতে ধারাবাহিকভাবে কিরাতের উপর সনদ/ইজাযাহ ( قراءات امام عاصم) লাভ করেন।
কর্মজীবন, সফর ও অর্জন
পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) এ দাওরা-এ-হাদিস সম্পন্ন করার পর তিনি মাওলানা মেহেরুজ্জামান রহ. [কারি উবায়দুল্লাহ রহ. এর পিতা] কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাঙ্গুনিয়া মাদরাসায় ৩ মাস শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানে পড়াশুনা করা অবস্থাতেই তিনি করাচির গুলিমাগ এ মাসজিদের ইমাম হিসেবে ১ বছর কর্মরত ছিলেন এবং ‘মাদরাসা তা’লিমুল কুরআন’ এ শিক্ষক হিসেবে বছরখানেক কর্মরত ছিলেন।
পড়াশুনার শেষ দিকে ছাত্র অবস্থায়ই ১৯৬০ সালে তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে পাকিস্তান (করাচি) বেতারে প্রথম ও একমাত্র বাঙালি কারি হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে পিটিভি (পাকিস্তান টেলিভিশন) চালু হওয়ার পর সেখানেও যোগদান করেন।
১৯৬২ সালে তিনি করাচির আরামবাগ জামে মাসজিদ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত ‘অল পাকিস্তান কিরাত কম্পিটিশন’ এ অংশগ্রহন করেন [যার আয়োজন করেছিলেন কারি জাহের কাসেমি রহ.], যাতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দ এর মুহতামিম হজরত মাওলানা কারি তৈয়ব রহ. এবং বিচারক হিসেবে ছিলেন ইয়েমেনের উস্তাদ কারি শাইখ আলী মুহাম্মাদ শরফুদ্দিন রহ., আফগানিস্তানের উস্তাদ হাবিবুল্লাহ খাঁন আফগানি রহ., উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দীন, হজরত মাওলানা কারি মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ., মাওলানা মুফতি দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁন রহ., কারি খলিলুর রহমান রহ. এবং বাইতুল মুকাররমের মাওলানা আব্দুর রহমান বেখুত রহ.।
ওই প্রতিযোগিতায় ১ম হন মাওলানা কারি তৈয়ব রহ. এর ভাতিজা এবং কারি জাহের কাসেমি রহ. এর ছোট ভাই কারি শাকের কাসেমি এবং দ্বিতীয় হন হজরত কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ হাফিযাহুল্লহ।
প্রতিযোগিতা শেষে হজরত মাওলানা কারি তৈয়ব রহ. ২ জনকে রৌপ্য পদক প্রদান করেন এবং সেখানেই মাওলানা কারি তৈয়ব রহ., কারি মুহাম্মাদ ইউসুফকে নিজ হাতে কিরাতের সনদ/ইজাযাহ প্রদান করেন। [ উল্লেখ্য পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে উক্ত কম্পিটিশন এ ১২ জন অংশগ্রহন করেছিলেন]
১৯৬৩ সালে হজরত কারি মুহাম্মদ ইউসুফ পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ‘৩য় আন্তর্জাতিক কিরাত প্রতিযোগিতায়’ অংশগ্রহণ করেন এবং দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম ও শেষ ব্যক্তি হিসেবে উক্ত ‘আন্তর্জাতিক কিরাত প্রতিযোগিতায়’ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক অর্জন করেন (কম্পিটিশন এর তখনকার নিয়মানুযায়ী ১ম ও ২য় প্রতিযোগিকেই কেবল স্বর্ণপদক দেয়া হতো, এ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন মালয়েশিয়ার কারি ইসমাইল বিন হাশিম) এবং তাঁর এই পদক প্রাপ্তির মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সামনে পাকিস্তানের নামকে উজ্জ্বল করেন যার ফলে পাকিস্তানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংবাদ মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
সংবাদের বেশিরভাগেরই মূল শিরোনাম ছিলো ‘কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহাব নে পাকিস্তান কা নাম রশান কিয়া (অর্থাৎ ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের নাম উজ্জ্বল করেছেন)’। তখন মালয়েশিয়ার কম্পিটিশন এর সভাপতি ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কারি শাইখ মুস্তাফা ইসমাঈল রহ.।
১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে বার্মার (মায়ানমার) রেঙ্গুনের সবচেয়ে বড় মাসজিদ সুরুতি মাসজিদের আন্তর্জাতিক মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন, সাথে ছিলেন বন্ধু লাহোরের কারি গুলাম রসুল রহ.।
মাহফিল শেষ করে তিনি জানতে পারেন ‘মার্শাল ল’ জাড়ি করা হয়েছে।পরদিন জরুরি ভিত্তিতে রেঙ্গুনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হাবিবুর রহমান সাহেব উনাদের পাকিস্তানের ফ্লাইটে উঠিয়ে দেন।এ বছরই তিনি সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক মাহফিলে’ অংশগ্রহন করেন।
১৯৬৪ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়ার বন্দুমে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ইসলামিক সম্মেলনে’ অংশগ্রহণ করেন। যেখানে বিশ্বের ১০টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন।
এ ছারাও হযরত মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে ৬০’র দশকে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন/সেমিনারে অতিথি হিসেবে অসংখ্যবার সফর করেন।
১৯৬৬ সালে কারি জাহের কাসেমি, কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ এবং কারি শাকের কাসেমি ইসলামাবাদের ‘প্রেসিডেন্ট হাউসে’ গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান এর কাছে বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন করার ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন, তাঁরই সহযোগিতায় ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬ সালে বিশ্বের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক কারিদের সংগঠন (إتحاد القراء العا لمية) “International Quran Recitation Association(IQRA)/ আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত সংস্থা(ইক্বরা)” গঠিত হয় যার সভাপতি মনোনীত হন মিসরের তৎকালীন শাইখুল কুররা, বিশ্ববিখ্যাত কারি শাইখ মাহমূদ খলিল আল হুসারি এবং মহাসচিব হন কারি জাহের কাসেমি।
কার্যকরী সদস্য হিসেবে মনোনীত হন মিসরের বিশ্ববিখ্যাত কারি শাইখ আবদুল বাসিত মুহাম্মাদ আবদুস সামাদ, তৎকালীন পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) হজরত কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ, ইয়েমেনের উস্তাদ কারি শাইখ আলী মুহাম্মাদ শরফুদ্দিন, পাকিস্তানের উস্তাদ কারি মুহাম্মাদ ইলিয়াস, কারি শাকের কাসেমি এবং কারি আসিফ কাসেমি ।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালে ‘ইক্বরা’ আয়োজিত বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ‘আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির নিশতার পার্ক, লাহোরের শাহী মাসজিদ এবং পেশাওয়ার-এ।
১৯৬৭ সালে ‘ইকরা’ আয়োজিত ‘২য় আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা, সিলেটের আলিয়া মাদরাসা ময়দান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, পেশাওয়ার-এ।
সম্মেলন উদ্বোধন করেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ মুসা এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান ।এতে শাইখ মুস্তাফা ইসমাঈল, শাইখ মাহমূদ খলিল আল হুসারি, শাইখ আব্দুল বাসিত মুহাম্মাদ আব্দুস সামাদ, কারি জাহের কাসেমি, কারি মুহাম্মাদ ইউসুফসহ ‘ইকরা’র সকল সদস্য সর্ব মোট বিশ্বের ১৭টি দেশের বিশ্ববিখ্যাত ও প্রখ্যাত ক্বারী সাহেবগণ অংশ নেন।
এই সম্মেলনের মাধ্যমেই মূলত উপমহাদেশে কুরআন তথা বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ও ইলমে ক্বিরাত শিক্ষা নেওয়ার বিষয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। পরবর্তীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে ‘ইক্বরা’ এর পরবর্তী সম্মেলনগুলো স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৬৭ সালে কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেন এবং ৩য় স্থান অর্জন করেন।
হজরত মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬দফা আন্দোলনের অন্যতম আয়োজক ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের এত বড় একজন বিখ্যাত কারি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে (পিটিভি) ‘বাঙালি বাবু’ সম্বোধন শুনতে হতো যার ফলে তার মনের মধ্যে পাকিস্তানিদের প্রতি ধীরে ধীরে ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্বপক্ষে নিজেকে যুক্ত করেন।
যার ফলে তিনি করাচি থেকে পূর্ব পাকিস্তানে(বাংলাদেশে) বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২-এর বাড়িতে এসে বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানে সমাবেশ করার অনুরোধ জানান এবং রাজি করান। ফলে সে বছরই লাহোরে ৬দফা দাবির আন্দোলন করা হয় এবং করাচির নিশতার পার্ক ময়দানে সমাবেশের আয়োজন করা হয় যেখানে ১০লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত হয় এবং সেই সমাবেশে হযরত মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ ৬-দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ৬-ভরি স্বর্ণের পদক প্রদান করেন।
মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ ১৯৭১ সালে সংগঠিত মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হলে পরদিন ২৬ মার্চ করাচি রেডিওর আঞ্চলিক পরিচালক তাহের শাহ (পাঞ্জাবী) মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফকে ডেকে পাঠালেন।
তিনি যাওয়ার পর তাহের শাহ রেডিও ও টিভির সব অফিসারদের ডাকলেন, সবার সামনে কারি মুহাম্মাদ ইউসুফকে অপমানের সাথে চাকরিচ্যুত করে করাচি রেডিও ও পিটিভি থেকে বের করে দেয়।
মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ তৎকালীন এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠ কারিদের অন্যতম ছিলেন এবং পাকিস্তানের এত বড় একজন বিখ্যাত কারি হওয়া সত্ত্বেও, পাকিস্তানের জন্য এত সম্মান বয়ে আনার পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করায় তাঁর কর্মস্থল থেকে বহিষ্কৃত হন।
করাচিতে তাঁর বাসস্থানে অসংখ্যবার হামলা করা হয় এবং এক পর্যায়ে তাঁর ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়, এই অবস্থায় তার উপর পাকিস্তানি সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এবং তিনি কিছুদিন তার কিছু ভক্ত এবং ছাত্রদের সহযোগিতায় লুকিয়ে থাকেন।
পরবর্তীতে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের অফিসার তাঁর এক ছাত্রের (মাযহার সাহেব) সহযোগিতায় নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তান থেকে সবকিছু (বাসস্থান, অর্থসম্পদ, সম্পত্তি) ত্যাগ করে সর্বশেষ ফ্লাইটে শ্রীলঙ্কাতে গিয়ে সেখান করে বাংলাদেশে (ঢাকার তেজগাঁও এয়ারপোর্টে) প্রত্যাবর্তন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই পাকিস্তান বেতারের (ঢাকায়) ডি.জি. জিল্লুর রহমান তাঁকে প্রোগ্রাম করার জন্য অনুরোধ করেন কিন্তু কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘যত দিন পাকিস্তানের পতাকা থাকবে ততদিন আমি কোন অনুষ্ঠান করব না’।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই সেপ্টেম্বর মাসেই উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা কারি মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুযুর রহ., মাওলানা মুফতি দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁন রহ., হাফেজ মাওলানা মীর আহমাদ রহ. এবং কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ এর উদ্যোগে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত ও একমাত্র স্বতন্ত্র ইলমে ক্বিরাত এর প্রতিষ্ঠান ‘মাদরাসা দারুল কুরআন’ প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার উর্দু রোড জামে মাসজিদে।
পরবর্তীতে ২০০৩ সালে এর নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ক্বিরাত ইন্সটিটিউট/معهد القراءات بنغلاديش/ Institute of Quranic Science and Phonetics Bangladesh” রাখা হয় ।
মাওলানা কারি মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুযুর রহ. এর একটি স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে হবে একটি করে মক্তব, সেই লক্ষেই তিনি তাঁর জীবদ্দশায় এই দায়িত্ব মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফকে দিয়ে যান।
এরপর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে হযরত কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ এর সাক্ষাত হলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে পরদিন তাঁর বাসায় যেতে বলেন।
বাসায় গেলে তিনি বললেন, ‘মাওলানা আপনি আবার আমার সাথে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকুন এবং আপনার এলাকা চট্টগ্রাম থেকে ইলেকশন করবেন এবং ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিবেন’, তখন কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে বলেন, ‘মুজিব ভাই আমি আর রাজনীতি করতে চাই না, বাকি সারা জীবন কুরআনের খিদমত করতে চাই’।
তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ঠিক আছে তাহলে আপনার জন্য তিনটি সরকারি পদ আছে- ১। বাংলাদেশ বেতার ও টিভির প্রধান কারি, ২। জাতীয় মাসজিদ বাইতুল মুকাররম এর খতিব। এবং ৩। ঢাকা আলিয়া মাদরাসার প্রধান কারি।
তখন হজরত কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ বলেন, ‘যেহেতু আমি আগেও পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে কাজ করেছি সুতরাং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে কাজ করতে চাই’, তখন বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাংলাদেশের প্রধান কারি (شيخ القراء) হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন যার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের পাশাপাশি সমস্ত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তিলাওয়াত করা।
তিনিই বাংলাদেশের প্রথম কারি যার তিলাওয়াতের মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে তিলাওয়াত শুরু হয় এবং তাঁর যোগদানের পর বাংলার মানুষ শুনতে পেল এক ব্যতিক্রমধর্মী সুমধুর কণ্ঠের কুরআন তিলাওয়াত যে রকম তিলাওয়াত কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্যেই শুনা যেত এবং এই তিলাওয়াত শুনেই সারা বাংলার অসংখ্য মানুষ কুরআনকে ভালবেসে নিজের সন্তানকে হাফিযে কুরআন ও আলেম বানান।
স্বাধীনতার পর একটানা ৩ বছর তিনি একাই বাংলাদেশ বেতার ও টিভি তে অনুষ্ঠান করেছেন [১৯৭৫ সালের পর শাইখুল কুররা মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ এর বন্ধু চট্টগ্রামেরই আরেক কৃতি সন্তান উস্তাদুল কুররা হজরত মাওলানা কারি ওবাইদুল্লাহ রহ. যোগদান করেন]।
‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা
শাইখুল কুররা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ হাফিযাহুল্লহ পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র সফর করেন। ১৯৬৩ সালে মায়ানমার সফরে তিনি ‘রেঙ্গুনের সুরুতি মাসজিদ’ প্রাঙ্গনে একটি ইসলামিক সেন্টার দেখলেন।
মালয়েশিয়ার ‘জাতীয় মাসজিদ নাগারা’ প্রাঙ্গনেও এরূপ একটি ইসলামিক সেন্টার দেখলেন। ইন্দোনেশিয়াতেও একি রকম বড় ইসলামিক ফাউন্ডেশন দেখলেন। তখন তিনি এরুপ একটি বড় ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশেও (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) হওয়ার উপলব্ধি করলেন [তখন কেবল একটি ছোটো ইসলামিক একাডেমি ভবন ছিল]।
স্বাধীনতার পূর্বেই বিভিন্নবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে একটি ইসলামিক সেন্টার এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ওয়াদা করলেন এবং বললেন “আপনারা দুআ করুন, বাংলাদেশ হওয়ার পর ইনশাল্লাহ আমি করব”
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় ইসলামিক সেন্টার এর কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি শাইখুল কুররা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ হাফিযাহুল্লহকে বললেন “আপনারা মিটিং করুন এবং পরামর্শ করুন এই বিষয়ে”।
মিটিং অনুষ্ঠিত হলো বাইতুল মুকাররমের ইসলামিক একাডেমির বিল্ডিং এ, সেখানে উপস্থিত ছিলেন- শাইখুল কুররা হযরত মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ, মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, মাওলানা খাইরুল ইসলাম যশোরী, কুমিল্লার মাওলানা হাবিবুর রহমান, ইসলামিক একাডেমির ডিজি চট্টগ্রামের আহমাদ হুসাইন, ইসলামিক একাডেমির আব্দুল কুদ্দুস এবং মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদি।
মিটিং এ সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবিত হলো “ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ” এর নাম এবং এর কিছু কার্যবিবরণ। কমিটির এই প্রস্তাবিত কাগজপত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে তিনি প্রস্তাবসমূহকে গ্রহণ করে একটি ইসলামিক একাডেমি থেকে পূর্ণাঙ্গ ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৫ সালে।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ইন্তেকালের পর স্বাধীনতা বিরোধীশক্তির কিছু মানুষ এই ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শাইখুল কুররা মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফসহ যাদের অবদান ছিল তাঁর সমস্ত ফাইল ও মিটিং এর নথিপত্র গায়েব করে ফেলে।
১৯৭৫ সালে শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত “আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়” অংশগ্রহণ করেন এবং চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। প্রতিযোগিতায় কারি উবায়দুল্লাহ রহ. ও অংশ নেন। এবং উক্ত সফর শেষে উভয়েই সিঙ্গাপুর এর মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৮ সালে শাইখুল কুররা মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত “আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়” অংশগ্রহণ করেন এবং ৩য় স্থান অর্জন করেন।
১৯৭৯ সালে তিনি সৌদি আরবের বাদশাহ খালিদ বিন আবদুল আযিয আল-সৌদ এর রাজকীয় অতিথি হিসেবে আন্তর্জাতিক ইসলামিক কনফারেন্স এ অংশগ্রহণ করেন (সাথে কারি উবায়দুল্লাহ রহ. ও ছিলেন) যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের সম্মানিত স্কলারগণ, মন্ত্রী, স্পিকার, রাষ্ট্রদূত ওকারিগণ অংশগ্রহন করেন এবং সকলেই বাদশার রাজকীয় প্রাসাদে বাদশাহ এর দাওয়াতে অংশ নেন।
কনফারেন্সে কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ ও ক্বারী উবায়দুল্লাহ রহ. তিলাওয়াত করেন যা সমগ্র আরববিশ্বে প্রচার করা হয়। তিলাওয়াত শেষে সৌদি বাদশার পক্ষ থেকে উনাদের স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। তখন সৌদিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মারহুম হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী।
কনফারেন্স এর পর তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে কারি মুহাম্মাদ ইউসুফকে বললেন, ‘আমি যা চেয়েছিলাম তাই হয়েছে, আপনাদের তিলাওয়াত শুনে অনেক ফোন এসেছে আমার কাছে, বাংলাদেশে এত উচ্চমানের কারি আছে যার প্রশংসা করছে সবাই এবং আপনাদের তিলাওয়াত শুনে অনেকেই বলছে বাংলাদেশ তাহলে মুসলিম দেশ”। (উল্লেখ্য স্বাধীনতাবিরোধী কিছু দল বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের কাছে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রচার করত)।
তারপর একদিন আনুমানিক রাত ১২.৩০ এর সময় হযরত কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ, মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট এর স্পিকার তুন দাঁতো সাইয়েদ নাসের ইসমাইল, কারি উবায়দুল্লাহ রহ., বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, স্কলার, ক্বারীসাহেবদের আল্লাহর ঘর খানা-এ-ক্বা’বা এ প্রবেশ করানো হয়।
কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ ৪৫ মিনিট খানা-এ-ক্বা’বা তে অবস্থান করেন, সেখানে তিনি রুকনে ইয়ামানি এর সামনে ৪রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন।
পরবর্তীতে বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আযিয আল-সৌদ সকল মেহমানদের সম্মানে ভোজের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি নিজ হাতে শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফসহ রাষ্ট্রীয় অতিথিদের ক্বা’বা শরিফের গিলাফ (ক্বিসওয়াহ) উপহার দেন।
জাতীয় কিরাত ও আজান প্রতিযোগিতার সূচনা
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় বঙ্গভবনের দরবার হলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানির সহধর্মিণীকে পদক দিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে শাইখুল কুররা হযরত মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ মেহমান হিসেবে ছিলেন এবং তিনি তিলাওয়াত করলেন।
অনুষ্ঠান শেষে জিয়াউর রহমান দরবার হল থেকে বের হওয়ার সময় শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফের হাত ধরে উনার লিভিং রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে বসার পর রাষ্ট্রপতি ২ বার বললেন, “আপনি কিছু বলেন না কেন?”
কারি মুহাম্মাদ ইউসুফবললেন “আমি বলব?”, রাষ্ট্রপতি বললেন “বলুন”, তখন কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ বললেন “আপনি বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলনের আয়োজন করুন”, জিয়াউর রহমান সাহেব বললেন “ঠিক আছে, প্রথমে জাতীয়ভাবে সম্মেলন হোক, তারপর আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজন করবো”, তখন তিনি কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবের সামনে ধর্মমন্ত্রীকে ফোন করলেন এবং বললেন “আপনি একটি কিরাত সম্মেলন আয়োজনের ব্যবস্থা করুন”। পরবর্তীতে এর আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হলো ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গভবনের দরবার হলে প্রথমে জাতীয় কিরাত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো যার প্রধান বিচারক ছিলেন মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ।
অনুষ্ঠান চলাকালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কারি মুহাম্মাদ ইউসুফকে বললেন, “আপনি বাংলাদেশের নক্ষত্র, আপনি আমার পাশেই বসুন”, তখন তিনি কারি মুহাম্মাদ ইউসুফকে মাঝখানে বসালেন, তার ডানপাশে বসলেন জিয়াউর রহমান এবং বামপাশে বসলেন আব্দুস সাত্তার (পরবর্তী রাষ্ট্রপতি)।
এর পর থেকেই বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর অধীনে কিরাত, আজান ও ইসলামি সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলো।
পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের ইন্তেকাল হলো এবং আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলনের বিষয়টি থেমে গেল।
সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর কিরাত ও আজান প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার সূচনা
জেনারেল হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় তার সাথে শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ এর একটি প্রোগ্রাম ছিল। অনুষ্ঠান শেষে চা-পর্বে কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ এরশাদ সাহেবকে বললেন, “১৯৬২ সালে মিশর সেনাবাহিনীর একটি দল পাকিস্তান সফরে এসেছিল, সেই সফরে তাঁদের বেশকয়েকজন অনেক উচ্চমানের কারিও ছিল”, তখন তিনি এরশাদ সাহেবকে প্রস্তাব করলেন “আমাদের সেনাবাহিনীর ছেলেদের জন্য কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিন”।
তখন সেখানে এরশাদ সাহেব ও ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফের সামনে ছিলেন ফারুক খান [পরবর্তীতে কর্নেল ও বাণিজ্যমন্ত্রী (২০০৯-২০১৩)], এরশাদ সাহেব তাঁকে বললেন, “আমার বাহিনীর এই ছেলেদের আগামী বছর থেকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কম্পিটিশন এর ব্যবস্থা করো”।
পরবর্তী বছর থেকে শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ এর প্রস্তাব অনুযায়ী উনার অধীনে প্রথমে সেনাবাহিনী এবং পরবর্তীতে বিমানবাহিনীকে কুরআন তিলাওয়াতের শিক্ষা ও তাঁদের মধ্যকার কম্পিটিশন শুরু হলো যা এখনো চলছে। পরবর্তীতে বিডিআর (বিজিবি) ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ এর অধীনে কুরআন তিলাওয়াতের শিক্ষা ও প্রতিযোগিতা শুরু হলো।
১৯৮৩ সালে শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত “আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়” অংশগ্রহণ করেন এবং চতুর্থ স্থান অর্জন করেন।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন আয়োজনের পুনরায় প্রচেষ্টা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শাইখুল কুররা মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ বাংলাদেশে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রমকে পুনরায় শুরু করার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। কিন্তু নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি দেশে সম্পদের স্বল্পতা এবং দেশজ উন্নয়নের কারণে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুরু করা যায়নি।
১৯৯০ সালে রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ এর ক্ষমতার শেষ দিকে শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ একটি ‘আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলনের’ তারিখ ঠিক করে এরশাদ সাহেবের সাথে সাক্ষাত করলেন।
তিনি এরশাদ সাহেবকে উক্ত সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসেবে থাকার জন্য দাওয়াত করলেন।রাষ্ট্রপতি দাওয়াত গ্রহন করে বললেন “তিনি উক্ত সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকার প্রত্যেকটি প্রবেশমুখে একটি করে তোরণ করে দিবেন,সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন(বিটিভি) কে বলে দিবেন,এবং তিনি উক্ত সম্মেলন আয়োজনের জন্য ১০লক্ষ্য টাকা অনুদান দিবেন বলে ওয়াদা করলেন”।
পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে সম্মেলনের বিষয়টি স্থগিত হয়ে যাচ্ছিল।তখন এরশাদ সাহেবের ক্যাবিনেট এর মন্ত্রী দৈনিক ইনকিলাব এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব শাইখুল কুররা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবকে বললেন ‘আপনি একটু ধৈর্য ধরুন”।
কিন্তু ২দিন পর তিনি পদত্যাগ করলেন। তারপর আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন আয়োজনের বিষয়টি বাতিল হয়ে গেল।
১৯৯১ সালে শাইখুল কুররা হযরত মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ একক প্রচেষ্টায় পুনরায় “International Quran Recitation Association(IQRA)” এর কার্যক্রম বাংলাদেশে শুরু করতে সক্ষম হলেন।
‘ইক্বরা’ আয়োজিত বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১৫ নভেম্বর, ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। সম্মেলন উদ্ভোধন করেন বাংলাদেশের তংকালীন রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুর রহমান বিশ্বাস।
১৯৯১ সাল হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একটানা ১৪ বছর তিনি ‘আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন’ আয়োজন করেছেন ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। ২০০৪ সালের পর দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার কারণে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম স্থগিত ছিল।
২০১২ সালে ১৫তম আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলনের মাধ্যমে শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ পুনরায় ‘ইকরা’র কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছেন। বিগত ২৭ বছরে তিনি ‘আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত সংস্থা(ইক্বরা)’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ১৮বার আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন আয়োজন করেছেন।
সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত ও বিশুদ্ধ কুরআন শেখার প্রতি ব্যাপক আগ্রহী করে তুলেছেন।
১৯৯৬ সালের ২৫মার্চ শাইখুল কুররা মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ইসলামী বিদ্যাপীঠ “দারুল উলূম দেওবন্দ” এর মুহতামিম হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ. এর দাওয়াতে ভারত সফর করেন এবং তাঁকে দারুল উলূম দেওবন্দ এর ‘দারুল হাদিসে’ বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র বাংলাদেশী আলেম হিসেবে কুরআনের প্রচার ও প্রসারে অসামান্য অবদান রাখায় সংবর্ধনা প্রদান করেন।
সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন ‘ওয়াকফ দারুল উলূম’এর মুহতামিম হযরত মাওলানা সালেম কাসেমি [যিনি মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব রহ.) এর বড় সাহেবজাদা এবং কারি জাহের কাসেমি র.) এর চাচাতো ভাই], মাওলানা আরশাদ মাদানি প্রমুখ।
পরে হযরত মাওলানা সালেম কাসেমি, কারি মুহাম্মাদ ইউসুফকে হাত ধরে পুরো দারুল উলূম দেওবন্দ ঘুরিয়ে দেখান।
২০০১ সালে শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মদ ইউসুফ কেনিয়া সফর করেন এবং সেখানকার রেডিও ও টেলিভিশন উনার তিলাওয়াত রেকর্ড করে।
শাইখুল কুররা কারি মুহাম্মাদ ইউসুফ হাফিযাহুল্লহ বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে “বাংলাদেশ কিরাত ইন্সটিটিউট (معهد القراءات بنغلاديش)” প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশের সমস্ত কারিগণ, এই দেশের বহু প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম, বিভিন্ন মাসজিদের খতীব ও ইমাম, বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষকগণ সহ সাধারণ মানুষজন উনার কাছ থেকে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত ও কিরাতের তা’লীম নিয়েছেন।
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন এর অশেষ রহমতে তিনিই বাংলাদেশে কিরাত এর ময়দান তৈরি করেছেন যেখানে এদেশের সমস্ত উল্লেখযোগ্য ক্বারীগণ উনার দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছেন। দীর্ঘ এত বছরের প্রচেষ্টায় তিনি লক্ষাধিক মানুষকে কুরআন শিখিয়েছেন যাতে বাঙলার মানুষ শুদ্ধ করে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে।
কারি ইউসুফ রহ. এর ইন্তেকালে হেফাজতের শোক প্রকাশ
বাংলাদেশের ৭ কারি; যাদের কেরাত শেখায় অনন্য স্রষ্টাপ্রেম
-রোরা
লেখাটি শায়খ কারি আহমদ বিন ইউসুফ আল আজহারীর ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া