সাঈদ আহমাদ খান
১৮৫৭ সালের দিকে সিপাহী বিপ্লব শেষ হল৷ সুদূরপ্রসারি মুসলমানদের এ আন্দোলন ততক্ষণাৎ কোনো ফলপ্রসূ হলো না৷ ইংরেজগণ আয়ত্ব করে নিলো পুরো হিন্দুস্তান৷ দিশেহারা মুসলিম কর্ণধারগণ তখন অস্ত্রের ময়দান ছেড়ে শিক্ষার যুদ্ধ শুরু করলেন৷
দুর্দশাগ্রস্থ মুসলিম জাতিকে উদ্ধার করতে প্রতিষ্ঠিত হলো দু'ধরনের প্রতিষ্ঠান৷ দারুল উলুম দেওবন্দ৷ আর আলীগড় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি৷
কিন্তু দু:খের বিষয় হলো, আলিগড় ইউনিভার্সিটি তার উদ্দেশ্য অর্জনের পরিবর্তে পশ্চিমা কৃষ্টিকালচারকে অনেকটা যেনো বুকে চেপে ধরলো৷ অন্যদিকে পাশ্চাত্যের ধোঁয়ায় পৃথিবীর আকাশে ছেয়ে পড়া আধুনিকতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করতে উদগ্রীব করলো অনেকে৷ ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করলো দু'টি চিন্তাধারা৷
হতাশাগ্রস্ত মুসলিম জাতিকে বিভক্তির আভাস ছুঁয়ে দিলো এ দ্বন্দ্ব৷ ঠিক এ মূহুর্তে-১৮৯২ সালে (হিজরি- ১৩১০) মাওলানা সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ আলি মুঙ্গিরি রহ. এবং তার মত একদল মহান আলেমদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় এক যুগান্তকরি ঐতিহাসিক ইসলামিক সংস্থা৷
মাদরাসা ফয়জে আম- কানপুরে যার প্রথম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়৷ দু'টি চিন্তাধারার যুগোপযোগি ইসলামিক সমন্বয় সাধনই ছিলো যার মূল লক্ষ্য৷ প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের সব কৃষ্টিকালচার থেকে হাত গুটানো নয়, বরং ইসলামের উন্নত রঙ দিয়ে এগুলোকে সাজানোই হলো একজন দক্ষ মুমিনের সরল কাজ৷ এটাই ছিলো সংগঠনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি৷
উন্নত এ চিন্তা- চেতনাকে বাস্তবের রুপ দিতেই মুহাম্মাদ আলি মুঙ্গিরি রহ. সংগঠনকে কেন্দ্র করে হিজরি- ১৩১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিদ্যালয়৷ এটাই হলো আজকের দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা৷ যা বিশ্ব মুসলিম জাতিকে দীনের এক অনবদ্য খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে৷ খৃস্টীয় ১৮৯৮ সালে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়৷
লক্ষ ও উদ্দেশ্য
দারুল উলুম লি নদওয়াতুল উলামা প্রতিষ্ঠিত হয়, আকাবির ও আসলাফের চিন্তাধারাকে সামনে রেখে৷ বিদেশি কৃষ্টিকালচারে আহত মুসলিম জাতিকে ইসলামের মধ্যপন্থার সঠিক দিশা দিতে৷ তাই বুনিয়াদি চার উসুল নিয়ে এগিয়ে চলে নদওয়াতুল উলামা৷
১. শিক্ষা সিলেবাসের পূর্ণতা দানে এমন এক নেসাব তৈরি করা, যা ভরপুর থাকবে মুসলিম উম্মাহর সকল প্রকার সঠিক দিক- নির্দেশনাতে৷ সহনীয় সব মতোপার্থক্য ভুলে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব- বন্ধনকে মজবুত করবে যে সিলেবাস৷
২. দীনের সকল শাস্ত্র; বিশেষ করে তর্কশাস্ত্র ও ফিকহশাস্ত্রের আধুনিক রুপায়ন৷ যা শিখে একজন তালেবে ইলম কুফুরি শক্তির জওয়াব দিবে৷ এবং মুসলিমদের দৈনিক জীবনে সমস্যার সঠিক সমাধান বের করবে৷
৩. ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুনে আকাবের ও আসলাফের পথের পূর্ণ অনুসরণ৷ যাতে করে, প্রতিটি তালেবে ইলম উন্নত আখলাকের মজবুত ধারকবাহক হতে পারে৷
৪. ওসয়াতে কলব তথা কলবের প্রশস্ততা আর উম্মাহর প্রতি দরদে দিলে এমন বেচাইন বানানো; যাতে ইসলামের তরে নিজের জীবনকে ওয়াকফ করে দিবে৷ এটা হলো এমন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা অর্জন করা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ছাড়া দুষ্কর প্রায়৷
উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নদওয়ার পদক্ষেপ
নদওয়াতুল উলামা আপন লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার শুরুর দিন থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ মুহাম্মাদ আলি মুঙ্গিরি রহ.'র মতো অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মহান বুযুর্গদের বরকতময় হাতে শুরু এর যাত্রা৷ তাই আপন লক্ষ্য অর্জনে আধুনিক ও ইসলামিক বিষয়গুলোর সমন্বয়ে এমন এক সিলেবাস তৈরি করেছেন তারা।
যার সুনাম, সুখ্যাতি শুধু উপমহাদেশেই নয়, পুরো বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাই তো নদওয়া বাগানের মধু আহরণে ছুটে আসছে চিন, নেপাল, বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী৷
এমনকি আরব ও ইউরোপের রাজ্যগুলো থেকেও তালেবে ইলমগণ ভিড় করছেন এখানে৷ ইদানিং বিদেশিদের জন্য চার দেয়ালে বেষ্টিত আধুনিক সব সরঞ্জামাদি বিশাল ভবনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ইংরেজি ভাষা নেসাবভুক্ত করা
মাওলানা শিবলি নো'মানি রহ.'র পরামর্শে নদওয়া প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছরেই ইংরেজি ভাষাকে নেসাবভুক্ত করা হয়েছে৷ নদওয়ার সম্পূর্ণ কোর্সেই আধুনিক ইউনিভার্সিটির সাথে কিছুটা সামঞ্জস্যতা রাখা হয়েছে৷ সানুবিয়্যা (অষ্টম বছর) পর্যন্ত ইসলামের সকল ফনের ব্যাপক নিসাব নিয়ে এক নয়া কারিকুলাম বানানো হয়েছে৷
এরপর কিছুটা নির্দিষ্ট পড়াশোনার জন্য আলিয়া নামের চার বছরের কোর্স৷ যাকে ‘আলিমিয়্যাত’ বলা হয়৷ আধুনিক কলেজে যাকে আমরা ‘অনার্স কোর্স’ বলে জানি ৷ এরপর শুরু হয় নির্দিষ্ট ফনের উপর বিশেষ পড়াশোনা৷ উলয়াউলা আর উলয়া সানিয়া নামে দু' বছরের কোর্স এতে৷ যাকে ‘ফযীলাত’ও বলা হয় ৷ চলবে ...
লেখক : শিক্ষার্থী, নদওয়াতুল উলামা, ভারত।