আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম
আজ ১১ এপ্রিল। ঠিক ১ বছর আগে এই দিনে গণভবনে শত শত আলেমের উপস্থিতিতে কওমি মাদরাসার শিক্ষাসনদের স্বীকৃতি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বীকৃতি ঘোষণার ঠিক ৩ দিনের মাথায় প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গঠিত হয় আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয় সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
কিন্তু দিন গড়ানোর সাথে শ্লথ হতে থাকে স্বীকৃতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং হাইআতুল উলয়ার অন্তর্ভূক্ত অন্যান্য বোর্ডের মাঝে তৈরি হয় দূরত্ব।
বিগত কয়েক মাসে স্বীকৃতি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বৈঠকের চেয়ে পারস্পারিক মতভিন্নতা দূর করার প্রচেষ্টাটাই বেশি চোখে পড়েছে কওমি মাদরাসা সাধারণ ছাত্র ও শিক্ষকদের। বৈঠক ও পাল্টা বৈঠকের পরও পারস্পারিক মতভিন্নতা দূর হয় নি বোর্ডগুলোর।
স্বীকৃতি বাস্তবায়নে শ্লথ গতি ও পারস্পারিক মতভিন্নতার কারণে শঙ্কা তৈরি হয়েছে লাখো কওমি তরুণের মনে আদৌ কি স্বীকৃতি আলোর মুখ দেখবে? সোস্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার প্রকাশও দেখা গেছে।
শুধু কওমি তরুণরাই নয় বরং দায়িত্বশীল দেশবরেণ্য আলেমদের মনেও তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
কিছুদিন আগে আওয়ার ইসলামকে দেয়া এক মতামতে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের সহসভাপতি ও হাইআতুল উলয়ার সদস্য আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ বলেন, বিগত চারদলীয় সরকারের আমলে যেসব কারণে স্বীকৃতি বাস্তবায়িত হয় নি এবারও হয়তো একই কারণে তা বাস্তবায়িত হবে না।
তার এ শঙ্কার বাস্তবিক ভিত্তি কতোটা দৃঢ় এবং এক বছরে স্বীকৃতি বাস্তবায়নই বা কতো দূর এগুলো তা নিয়ে কথা হয় স্বীকৃতি বাস্তবায়ন কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশের শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে।
বেফাকের মহাসচিব ও হাইআতুল উলয়ার সদস্য মাওলানা আবদুল কুদ্দুস মনে করেন, ‘প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনও হয় নি। কারণ, সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তারা আন্তরিক। তবে প্রতিটি কাজেই সময় লাগছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আলিয়া মাদরাসার আরবি বিশ্ববিদ্যালয় পেতে ২০ বছর সময় লেগেছে। আমাদের সময় গেছে ১ বছর। সুতরাং আমরা এখনই কিছু বলতে পারি না। তবে যেহেতু এখনও সংসদের অধিবেশন বাকি আছে এবং সরকার বলছে হয়ে যাবে তাই আশা তো থাকছেই।’
আসছে রমজান; তারাবির হাফেজরা প্রস্তুতি নিবেন কীভাবে?
একইভাবে আশা জিইয়ে রাখতে চান আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম, সিলেটের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা এনামুল হক।
তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা অনেক আর প্রাপ্তি বিষয়ে এখনি কিছু বলা যাচ্ছে না। আমি আশাবাদী। আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি হবে ইনশাআল্লাহ! সরকারি কাজের প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। আমরা মনে করি, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন এবং সরকারও আন্তরিক। তাই হয়তো সরকারের বর্তমান মেয়াদেই তা আইনে রূপ নিবে।
কিন্তু স্বীকৃতির সফল বাস্তবায়নের জন্য সব বোর্ডের ঐক্যের প্রয়োজন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
কওমি শিক্ষা সনদের এক বছর পর স্বীকৃতির ব্যাপারে আশাবাদী হলেও সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন না দেশের শীর্ষ আলেম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ।
তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘আমি মানুষ হিসেবে আশাবাদী। তবে আশানুরূপ অগ্রগতি হয় নি। আমি যে কয়বার বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি তাকে আন্তরিক মনে হয়েছে। কিন্তু নানান কারণে হয়তো বিষয়টি আশানুরূপ পর্যায়ে যায় নি।’
বিশেষ কোনো কারণ কি আপনার চোখে পড়েছে? ‘আল্লামা ফরীদ মাসঊদ বলেন, প্রজ্ঞাপনের পর যে বাস্তবায়ন কমিটি হয়েছে আমার কাছে তার সক্রিয়তার অভাব আছে বলে মনে হয়েছে। নতুবা সরকার যতোটা আন্তরিক তাতে কাজ আরও খানিক দূর অগ্রসর হতো হয়তো।’
সাবস্ক্রাইব করুন আওয়ার ইসলাম টিভি
হাইআতুল উলয়াভূক্ত বোর্ডগুলোর মতভিন্নতা ও স্বীকৃতি বাস্তবায়নের গতি কমে যাওয়ায় কওমি তরুণদের মধ্যে স্বীকৃতি বাস্তবায়ন নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তা তুলে ধরলে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, আমি মনে করি না হাইআতুল উলয়ার বোর্ডগুলোর মধ্যে যে মতভিন্নতা তৈরি হয়েছে তাতে স্বীকৃতির বাস্তবায়ন থেমে যাবে।
আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের অনুসারী ও হিতাকাঙ্ক্ষীরা মনে করেন, স্বীকৃতির ব্যাপারে তার অবদান অনুযায়ী তার মূল্যায়ন হয় নি। যদি বিষয়টি এমনি হয় তবে স্বীকৃতি বাস্তবায়নে তার ভূমিকা কী হবে?
তিনি বলেন, ‘আমি একজন ক্ষুদ্র মানুষ। তারপরও জীবনে যা কিছু করেছি তা নিজের জন্য করি নি। কোনো পদের জন্য করি নি। আমার ভুল হতে পারে তবে আমার অন্তর সম্পূর্ণ সাফ যে আমি নিজের জন্য কিছুই করি নি।
সুতরাং স্বীকৃতির ব্যাপারে আমার চেষ্টা শুধু অব্যাহত থাকবে না; বরং আমি এ ব্যাপারে নিজেকে দায়বদ্ধ মনে করি। আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করছি এবং করে যাবে। ইনশাআল্লাহ!’
তিনি বাস্তবায়ন কমিটিকে পারস্পারিক মতভিন্নতা দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দেন।
অন্যদিকে কওমি মাদরাসার শিক্ষাসনদের বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নেই বলে জানান বেফাকের সহ-সভাপতি ও হাইআতুল উলয়ার সদস্য মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস।
তাকে ‘স্বীকৃতি ঘোষণার এক বছর পূর্ণ হলো। এক বছরে আমরা কতোটা অগ্রসর হলাম?’ প্রশ্ন করতেই তিনি প্রতিবেদকের উপর ক্ষেপে যান। বলেন, এটা বলে লাভ আছে নাকি? এটা একটা ফালতু প্রশ্ন।
প্রতিবেদক যখন তাকে পাল্টা প্রশ্নে জানতে চান আমাদের তো একটা আশা ছিলো? তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো আশাও ছিলো না, কোনো প্রত্যাশাও ছিলো না। সরকার যখন দিবে তখন হবে। এজন্য আমাদের কারো কোনো পেরেশানি নেই। কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। না বেফাকের, না হাটহাজারি হুজুরের।’
প্রতিবেদক যখন তাকে বলেন, আপনার প্রত্যাশা না থাকলেও লাখো কওমি তরুণের স্বপ্ন আছে। তিনি বলেন, আমরা কোনো দিন স্বীকৃতির স্বপ্ন দেখি নি।
স্বপ্ন না দেখলে গণভবনে গেলেন কেনো? সেদিন প্রায় সব আলেমই আইন করার দাবি করেছেন! তখন তিনি বলেন, কে বলেছে? সেদিন কেউ বলে নি আমাদের এই প্রত্যাশা, ওই প্রত্যাশা।
আমাদের একটাই প্রত্যাশা আমাদের দাবি অনুযায়ী স্বীকৃতি হবে। সেটা যেদিনই হোক।
কওমি স্বীকৃতি ও মিডিয়ার বিমাতাসুলভ আচরণ
আরআর