শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মোনাজাতগুলো পাখি হয়ে ঘিরে থাকুক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাহরিয়ার জামান তনয়
গল্প

নিরব নিস্তব্ধ রাত। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পৃথিবী। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভয়ংকর। ভূতুরে। আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমার ঘুম যেন হিমালয়ের ভার নিয়ে পড়ে আছে চোখে।
হঠাৎ কেউ একজন আমার নাম ধরে ডেকে উঠল।

এই শাহরিয়ার ওঠো!
আসলেই কি কেউ আমাকে ডাকছে নাকি কোনো স্বপ্নের ভেতরে ঢুকছি? নিজেকে আবিষ্কার করতে চাইলাম, আমি কোথায়?
কণ্ঠটি আবার ডেকে উঠল। আরো গম্ভীর শব্দে। মাথায় হাত বুলিয়ে কেউ একজন বলছে, শাহরিয়ার! তাড়াতাড়ি ওঠো!
মনে হলো আমি ইসরাফিলের দ্বিতীয় ফুৎকারের ধ্বনি শুনছি। ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে বসে যাই। ভয়ে বুকের ধুকপুক ক্রমশ বাড়ছে।

এমন শীতের  রাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। চোখ মুদে তাকালাম। নাহ, চোখ থেকে পালিয়েছে ঘুম। আচমকা তাকিয়ে দেখি আমার শিয়রে বসে আছেন বড় ভাইয়া! আমি রিতীমতো অবাক!

কটা বাজে?
দুইটা বা তিনটা...!
এই অসময়ে? কী ব্যাপার?
ভাইয়া এমন একটি সংবাদ দিলেন, আমার জন্য যেটা অসাধ্য ছিল সহ্য করা।

ভাইয়া বললেন, বড় আব্বু আর নেই!
ভাইয়ার কথা শুনে অনেক্ষণ আমার মুখে কোনো্ কথা বের হয়নি। শুধু ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত।
ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাড়া করলেন, তৈরি হয়ে নাও। গাঁয়ে যেতে হবে।

আমি উপলব্ধি করলাম, পৃথিবীটা আমার জন্য খুবই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো আবার সতেজ হয়ে ঝরে পড়ল। দুচোখ বেয়ে ঝরতে লাগল বাঁধভাঙা অশ্রুঢেউ।

একসেট জামা বেগে পুরে মাদরাসা থেকে বের হলাম। শীতের রাত। চিরচেনা শহর। ইট পাথরের পিচঢালা পথ। সব যে অচেনা হয়ে গেল মুহূর্তে । দানবের মতো দালানগুলো বিষণ্ন মনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দু’পাশ ঘেঁষে।

রাতের নিস্তব্ধতা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে গলির মুধে ঝিমুতে ঝিমুতে হঠাৎ জেগে ওঠা নাইট গার্ডের বাঁশি। কোথাও আবার ডাস্টবিনের পাশে কয়েকটি নেড়ি কুকুর ভাগ্য খুঁজতে খুঁজতে লেজুড় নাড়ছে। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্টেও যেন আল্লাহ তাআলা লিখে রেখেছেন তকদির। অবশ্য শুধু কুকুর নয়, পথশিশুর দলও নাম লিখিয়েছে অভিনব এ তকদিরের খাতায়।মানবতা যেন কুকুরের জীবনকেও হার মানিয়েছে।

মৃত্যুর ছায়াঢাকা শহর, উপশহর আর মফস্বলের পর মফস্বল মাড়িয়ে আমাদের গাড়ি।মেঘনা সেতুতে প্রচন্ড জ্যাম। গাড়িগুলো কাতার বেঁধে দাঁড়িয়ে। কোথাও কোনো সাড়া নেই যেন। সবাই হয়ত এতক্ষণে জেনে গেছে বিদায়ের সময় শব্দ করতে নেই। চুপ মেরে যেতে হয়। একদম চুপ।

বেলা তখন সাড়ে দশটা। আমরা বড়ির আঙিনায়। উৎকণ্ঠার ছাপ সবার মুখে মুখে।কান্নায় যেন ভেঙে পড়েছে সবাই।আমার দম আটকে আসছে চাপা আর্তনাদে। বুক ফাটা বেদনায় চোখ বেয়ে নেমে আসছে বিদায়ী ঝরণার ঢল।

আকাশও যোগ দিয়েছে আমাদের বেদনার মিছিলে। আমাদের শোকের পোশাকগুলো দেখে আকাশেরও কান্না পেয়েছে। ঝরঝর নামছে তার তপ্ত অশ্রু। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় সমাধা হলো আমার বড় আব্বুর দাফন।

এই বাঁশবাগান। কবরস্থানের গুচ্ছ অন্ধকার। আমাকে সবসময় বিষাদময় একটি তৃপ্তি দিত। গোরস্থান আমাকে সবসময় প্রশান্তির প্রলেপ দিত। মৃত্যুর মায়া আমাকে পেয়ে বসত এই ভরদুপুরের গুচ্ছগুচ্ছ অন্ধকার।

এখানে আজ থেকে আমার বড় আব্বু বাস করবেন। গুচ্ছগুচ্ছ অন্ধকার আর অন্ধকারের পেটের ভেতরে অন্ধকার কবর। আমার বড় আব্বু এখানেই ঘুমাবেন। একলা। একা। একা কি? এই বাঁশবাগানের পাখিরা? কঞ্চির ফাঁকফোঁকরে মিশে থাকা চড়ুইরা? তারা কি  আমার বড় আব্বুর একলা যাপনে সঙ্গী হবে না?
আমার মোনাজাতগুলো পাখি হয়ে ঘিরে থাকুক আমার বড় আব্বুর একলা থাকার ঘর।

এসএস
আরো পড়ুন : বাবা আসে গভীর রাতে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ