আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম
ইসরাইলের আগ্রাসী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ উপেক্ষা করেই হামাস শাসিত গাজায় চলছে ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’। গাজা-ইসরাইল সীমান্ত প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনি মাটি ও মাতৃভূমির অধিকার আদায়ের জন্য এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
৪২তম ফিলিস্তিনি ভূমি দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে গত ৩০ মার্চ শুক্রবার থেকে তা শুরু হয়েছে।
গাজার শাসনকারী ফিলিস্তিনের অন্যতম রাজনৈতিক দল হামাস ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’র ডাক দিয়েছে।
আয়োজক গোষ্ঠি হামাস বারবার এ আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ বললেও ইসরাইল শুরু থেকেই ছিলো মারমুখী। ইসরাইল হুশিয়ারি উচ্চারণ করে ‘গ্রেট মার্ট টু রিটার্ন’ থেকে ফিলিস্তিনিদের বিরত থাকার আহ্বান জানায়।
আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই গাজা সীমান্তে একশো ইসরাইলি সেনাকে মরণাস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রাখা হয়।
আন্দোলন শুরু হওয়ার সাথে সাথে ইসরাইলি বাহিনীকে গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়।
গত শুক্রবার ফিলিস্তিনি জনগণ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করার পর ইসরাইলি বাহিনী এ পর্যন্ত দুই ডজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং আহত হয়েছে আরও ২ হাজার।
গাজা ছাড়াও ওয়েস্টব্যাংক ও ১৯৪৮ সালে দখল করে নেয়া ফিলিস্তিনি ভূমির অধিবাসীরাও এ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় জমায়েত হয়েছে গাজায়। সেখানে প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনি ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’ প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছে।
গাজার এ আন্দোলন ১৫ মে তথা আরও ৬ সপ্তাহ চালিয়ে নেয়া হবে। ১৫ মে-তে ‘নাকবা’র ৭০ বছর পূর্তি হবে।
নাকবা অর্থ বিপর্যয়। ফিলিস্তিনি জনগণ ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবেই দেখে। আর ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রথম সন্ত্রাসী উদ্যোগকে নাকবা বা বিপর্যয় দিবস হিসেবে পালন করে তারা।
আজ থেকে ৭০ বছর পূর্বে ইহুদি সন্ত্রাসী ও মিলিশিয়া বাহিনী ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করে। তারা ৫৫০ ফিলিস্তিনি গ্রাম, শহর ও নগরকে আরব মুসলিম মুক্ত করে।
দখলকৃত এ ফিলিস্তিনি ভূমি ও সম্পদের উপরই গড়ে উঠেছিলো ইসরাইল রাষ্ট্রের ভিত্তি। নির্লজ্জ দখলদারিত্বই ছিলো ইসরাইল রাষ্ট্রের সূতিকাগার।
অবশ্য জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে যাদের বাস্তুচ্যূত করা হয়েছে তারা নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে বলে একটি আইন পাস করেছে। কিন্তু ইসরাইল বরাবর তা অস্বীকার করে আসছে।
ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রীই ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমিতে ফিরতে দিতে অস্বীকার করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘বৃদ্ধরা এক সময় মরে যাবে এবং যুবকরা তা ভুলে যাবে।’ অর্থাৎ আমরা কখনোই ভূমি ফিরিয়ে দিবো না। বরং এক সময় ফিলিস্তিনিরাই তাদের দাবি ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
দখলদারিত্বের নির্লজ্জ সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে এবং মাতৃভূমির অধিকার আদায়ের জন্যই এ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
তাদের দাবি এতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়ে যে ঘোষণা দিয়েছেন তার অসারতা প্রমাণিত হবে। লুণ্ঠিত ভূমিতে লুটেরার অধিকার কিভাবে দাবি করা যায়?
এছাড়াও গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর ১১ বছরব্যাপী অবরোধের অবসানও এ আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ গ্রহনের পর ইসরাইল সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে। অবরোধের ফলের গাজার ২০ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। গাজার বন্দী জীবন থেকেও মুক্তি চাচ্ছে ফিলিস্তিনি মুসলিমরা।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ভাষায়ও ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’ এর নানান প্রাসঙ্গিকতা উঠে এসেছে। তাদের ভাষায় ঘরে ফেরা ছাড়াও ফিলিস্তিনিদের এমন অনেক অধিকার রয়েছে যা রক্ষার দাবি রাখে। যেমন তাদের রাজধানী জেরুসালেম। ফিলিস্তিনিদের শ্বাশত রাজধানী রক্ষা করা তাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ২৭ বছর বয়সী দুআ হাবিব বলেন, আমি এসেছি পবিত্র শহর জেরুসালেম রক্ষার জন্য। ফিলিস্তিনের এ রাজধানী রক্ষা করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এ বার্তা পৌঁছাতে চাই যে, তার স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। কারণ এ ভূমির মালিক ফিলিস্তিনের জনগণ। আর তারা তাদের জীবন দিয়ে তা রক্ষা করবে।
২০০৯ সালে ইসরাইলের ড্রোন হামলায় পা হারান সাবের আল আশকার। তিনি বলেন, আমি এখানে ইসরাইল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছি। আমি জানি আমাদের অস্ত্র নেই। কিন্তু আমাদের আছে অধ্যবসায় ও দৃঢ় প্রত্যয়। আর আল্লাহর অনুগ্রহ। ইনশাআল্লাহ অতি শিগগির পৃথিবী স্বাধীন জেরুসালেম দেখবে।
আশকার আরও বলেন, আমি জানি, আমি হয়তো কখনো আমার ঘরে ফিরতে পারবো না। কিন্তু আমি ইসরাইল ও আমেরিকার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চাই। আমি বলছি, আমি ঘরে ফিরছি।
আজ না হলেও আগামীকাল আমি ফিরবোই। আমি আমার দাদার কবরের পাশে পৈতৃকভূমিতে একটি ঘর করবো। যাকে ইসরাইলি বাহিনী শহিদ করেছিলো।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বহু প্রবীণ ফিলিস্তিনি ৭০ বছর আগে হারানো গ্রামের নাম লেখা ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা বলছেন, আমরা হারানো গ্রামে ফিরে যেতে চাই।
সবমিলিয়ে ইসরাইলি আধিপত্য, জেরুসালেম রক্ষার তাড়না ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’ ফিলিস্তিনিদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো।
বিশেষত যখন ইসরাইলের সঙ্গে আরববিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঘনিষ্ঠতার সংবাদ একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে তখন নিজেদের অধিকার রক্ষায় নিজেদের সর্বাত্মক আন্দোলন ছাড়া ফিলিস্তিনিদের আর কোন পথই বা খোলা আছে?
তারা আজ বুঝতে পেরেছে, নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য নিজ পায়ে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
তবে দখলদার ইসরাইলের আচরণ থেকে স্পষ্ট যে তাদের কাছে ‘গ্রেট মার্চ টু রিটার্ন’ ছিলো সম্পূর্ণ আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। যা তাদের ভেতর আত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
এ ভয় ও নিজেদের অসীম পাপরেখা আড়াল করতে আবারও হিংস্র হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনিদের উপর।
সূত্র : দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশিত সারাহ হালিমের প্রবন্ধ ও মিডলইস্ট মনিটরে প্রকাশিত মু’তাসি আদ-দালুলের ফিচার অবলম্বনে। ছবিগুলো আল জাজিরা থেকে নেয়া...
আরও পড়ুন: ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের প্রতীক ১৬ বছরের এক কিশোরী
-রোরা