আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম
জাতীয় সংগীত আইন ১৯৭৮ এ বলা হয়েছে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় সংগীত গেয়ে কার্যদিবস শুরু করবে। এ আইনের অধীনে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে জাতীয় সংগীত গাওয়ার রীতি রয়েছে।
যদিও তা সর্বত্র সমানভাবে পালন করা হয় না। সরকারি মাদরাসাগুলোর কোনো কোনোটিতে জাতীয় সংগীত (নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে) গাওয়া হয়। আবার কোথাও তা গাওয়া হয়ও না।
দেশের কওমি মাদরাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়ার রেওয়াজ নেই। আর তা নিয়েই আপত্তি দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবি ও সুশীল সমাজের। তাদের অভিযোগ দেশপ্রেমের অভাব ও আইনের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ না থাকার কারণেই ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত পাওয়া হয় না।
অন্যদিকে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশ্ন জাতীয় সংগীত গেয়েই কেনো দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে হবে? বিশেষত যে সংগীতে ইসলামের মূলনীতি বিরোধী কথা রয়েছে। আমরা সততা ও দেশের প্রতি দায়িত্বপালন করেই দেশপ্রেমের পরিচয় দিবো।
সম্প্রতি হাইকোর্ট দেশের কওমি ও আলিয়া মাদরাসায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বাধ্যতামূলক না করার নির্দেশেনা চেয়ে করা একটি রিট খারিজ করে দেয়ার পর পুরাতন এ বিতর্ক আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে।
গত ২৭ মার্চ মঙ্গলবার দুপুরে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রিটটি উত্থাপিত হয়নি এ মর্মে এ আদেশ দেয়া হয়।
শুনানিতে রিট খারিজ করে হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন, মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআনের কোথায় এ কথা আছে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে না?
প্রচলিত আইনানুযায়ী মাদরাসাগুলো জাতীয় সংগীত গাইতে বাধ্য নয়
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
হাইকোর্টের এ প্রশ্নে ব্যথিত হয়েছেন অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিম নাগরিক। তারা মনে করছেন, কুরআন এখানে প্রাসঙ্গিক ছিলো না। তাই কুরআনের বিষয়টি টেনে আনারও প্রয়োজন ছিলো না।
বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও সিনিয়র সাংবাদিক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী মনে করেন বিচারক যে ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছেন তাতে কুরআনের প্রতি শ্লেষ প্রকাশ পায়। কারণ তিনি তো কুরআন অনুযায়ী বিচার করেন না।
বরং তিনি প্রশ্ন করতে পারতেন, এ ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেম ও ফকিহদের মত কী? তাদের মতের পক্ষে যুক্তি কী?
মাওলানা নদভী উল্টো প্রশ্ন তুলে বলেন, আদালত অবমাননা না হলে বলতে চাই, বিচারপতি সাহেবকে বলতে হবে কুরআনের কোথায় আছে মাদরাসায় জাতীয় সংগীত গাইতে হবে?
কুরআনে যদি থাকে আমাদের এই জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না। তবে বিচারক তা নিষিদ্ধ করবেন? অবশ্যই করবেন না। কারণ, তিনি দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী বিচার করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
তিনি ও তার কোর্ট তো কুরআনের বিধানে চলে না। তাহলে কেনো তিনি কুরআনের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন?
অভিজ্ঞ আলেম সাংবাদিকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, যারা জাতীয় সংগীত গাওয়া অপছন্দ করেন তাদের যুক্তি কী?
তিনি বলেন, জাতীয় সংগীত সাংবিধানিকভাবে সব প্রশ্নের উর্ধ্বে। সুতরাং কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। যদি সুযোগ থাকতো তবে তার রচয়িতা, রচনার সময়কাল, প্রেক্ষাপট এবং তাতে বিশেষ কোনো ধর্মাদর্শের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যেতো।
অসংখ্য কিতাব ও বয়ানের অনন্য অ্যাপ, ইনস্টল করুন আপনার মোবাইলে
আমাদের সংবিধানে কিছু বিষয়ে কথা বলা নিষিদ্ধ আছে। তা না হলে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে যে, বঙ্গবন্ধু যে গানটি পছন্দ করতেন সেটি কেন জাতীয় সংগীত হলো না। পরে তিনি সে গানটিকে জাতীয় গীত হিসাবে পেতে চান। সেটিও হয়নি।
তারপরও যদি কেউ আমাদের জাতীয় সংগীতের ব্যাপারে শরয়ি বিশ্লেষণ জানতে চান তার অভিজ্ঞ মুফতিদের শরণাপন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। সুপ্রিম কোর্টও ইচ্ছা করলে বিজ্ঞ আলেম, মুফতি, ইতিহাসবিদদের এ্যমিকাস কিউরি করে বিষয়গুলো জেনে নিতে পারে।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী মনে করেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া বিষয়ে উল্লিখিত রিটটি ছিল অপ্র্রয়োজনীয়। কারণ, জাতীয় সংগীত আইন ১৯৭৮-এ প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এজন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না।
আর সরকারি স্বীকৃতি অনুযায়ী বাংলাদেশের অধিকাংশ মাদরাসা, কলেজ ও ভার্সিটি পর্যায়ের।যেমন দেশের বড় বড় মাদরাসা কলেজ ও ভার্সিটির সমপর্যায়ের। তাই সেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। যদি গাওয়া হয় তবে কেবল মাদরাসার প্রাথমিক স্তরে গাইতে হবে।
তবুও এটি কনভেনশনে নেই বলে সরকার চিন্তা করে দেখতে পারে। কারণ, মাদরাসা যত না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তারচেয়ে বহুগুণ বেশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এসব না বুঝে কেনো রিট করে অপমানিত হতে হবে?
জাতীয় সংগীত দেশপ্রেম জাগ্রত করে তাই তা গাওয়া উচিৎ
ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন
অন্যদিকে মাদরাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়ায় শরয়ি কোনো সমস্যা দেখেন দেশের শীর্ষ ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক আলেম ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন।
তিনি বলেন, যদি বাদ্য না থাকে তবে জাতীয় সংগীত গাওয়াতে কোনো শরয়ি সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি না। গাইলে বরং লাভ আছে। এতে প্রমাণিত হবে আমাদের দেশপ্রেমে কোনো ঘাটতি নেই।
জাতীয় সংগীত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। মাদরাসায় জাতীয় সংগীত গাইলে আমাদের সন্তানরা শৈশবেই দেশপ্রেমের দীক্ষা পাবে।
উলামায়ে কেরামের আপত্তির কথা তুলে ধরলে চট্টগ্রাম এম ই এস ওমরগণী কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খালিদ হোসাইন বলেন, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা যেই হোন না কেনো, তা রচনার প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেনো জাতি আজ তাকে জাতীয় সংগীত হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং তা আমাদের সংবিধানের অংশ।
সুতরাং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা তা উপেক্ষা করতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, ‘উলামায়ে কেরামের একটি অংশ জাতীয় সংগীত গাওয়া অপছন্দ করেন। অথচ পাকিস্তান আমলে মাদরাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো। অথচ উভয় জাতীয় সংগীতের মধ্যে শব্দের ব্যবহার ও অর্থের মিল রয়েছে।
যদি পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতে ব্যবহৃত শব্দসমূহ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের শব্দগুলোকে রূপক ধরা যাবে না কেনো?
ড. আ ফ ম খালিদের মতো দেশের তরুণ প্রজন্মের অনেক আলেমই মনে করেন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া যেতে পারে। কেননা জাতীয় সংগীত মূলত দেশপ্রেমের অঙ্গীকার। আর ইসলামই তা মানুষকে সবচেয়ে বেশি করতে শেখায়।
জাতীয় সংগীতে প্রচ্ছন্ন শিরক নেই
মাওলানা লিয়াকত আলী
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা লিয়াকত আলীর কাছে প্রশ্ন করেছিলাম আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জাতীয় সংগীত এতোটা গুরুত্বপূর্ণ কেনো?
আর জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে কেনো দেশপ্রেম প্রকাশ করতে হবে?
উত্তরে তিনি বলেন, পৃথিবীতে এখন জাতিরাষ্ট্রের ধারণা প্রতিষ্ঠিত। আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করেই বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা চলছে। জাতীয় সংগীত এ জাতীয়তাবাদকেই উজ্জীবিত করে। সে কারণেই আধুনিক রাষ্ট্রে জাতীয় সংগীত এতোটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাজ্ঞ এ আলেম মনে করেন, আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও সরাসরি সাংঘর্ষিক নয়। সুতরাং জাতীয়তাবাদী ধারণা থেকে যদি জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় এবং তা দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত করে তবে তাতে সমস্যা নেই।
‘তবে দেখার বিষয় হলো আমাদের জাতীয় সংগীতে কোনো সমস্যা আছে কিনা? আমাদের জাতীয় সংগীতে প্রচ্ছন্ন কোনো শিরক নেই। তাই তা গাইলে খুব একটা সমস্যা নেই। ’
‘আমাদের জাতীয় সংগীতের ব্যাপারে আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়। তাহলো, আমাদের জাতীয় সংগীতে এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেমের যথাযথ উপস্থিতি আছে কি না?
সাবস্ক্রাইব করুন আওয়ার ইসলাম টিভি
এদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর দাবি রবীন্দ্রনাথ লিখিত সোনার বাংলা সংগীতে তার ঘাটতি আছে।
সুতরাং জাতীয় সংগীতের এ অভাব দূর করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আর পৃথিবীর ইতিহাসে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ঘটনা বিরল নয়। বহু দেশ প্রয়োজনে তাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করেছে।’-বলেন মাওলানা লিয়াকত আলী।
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে কুড়িগ্রামের সুখদেব ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম মিয়া ও ঢাকার কদমতলা মাদরাসার দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবক এই আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। শুনানির সময় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে শতাধিক মাদরাসা শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
আদালতে রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন তৈমুর আলম খন্দকার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
তৈমুর আলম খন্দকারকে বিচারপতি বলেন, ‘আপনি দেখান পবিত্র কুরআনের কোথায় আছে জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না? পবিত্র কুরআনের কোথাও নেই যে জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না।’
বিচারপতি বলেন, ‘আগে তো মাদরাসার সিলেবাসে (পাঠ্যক্রম) অংক, ইংরেজি বিজ্ঞান বিষয় অর্ন্তভূক্ত ছিল না। যুগের চাহিদা অনুযায়ী সে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইসলাম ধর্ম ডে বাই ডে উন্নত হচ্ছে। প্রকারন্তরে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করার জন্যই এ রিট করা হয়েছে।’
বিচারপতি বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষার্থীরা জাতীয় সংগীত গাইবে আর মাদরাসার শিক্ষার্থীরা গাইবে না, এটা তো হতে পারে না। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে গেলে যখন বিদেশিরা জাতীয় সঙ্গীতের বিষয় জানতে চাইবে তখন শিক্ষার্থীরা কী জবাব দেবে?’।
বিচারপতি আরও বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে আমরা (মুসলমানরা) ইংরেজি না শিখে পিছিয়ে পড়েছিলাম। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে দিতে এ ধরনের রিট করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন: তসলিমা নাসরিনের প্রতি এক কিশোরীর খোলাচিঠি
-রোরা