সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মৃত্যুশয্যায় শায়িত। জীবন প্রদীপের শেষ আলোটুকু টিমটিম করে জ্বলছিল তখনও, যে কোনো সময় দপ করে নিভে যাবে চিরদিনের জন্য। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ছেলের নামও আবদুল্লাহ, তিনি উৎসর্গিত মুসলমান। বাবার মৃত্যুশয্যার এমন সঙ্গীন মুহূর্তে ছেলে আবদুল্লাহ দৌড়ে এলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছে।
লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে, চোখে জল নিয়ে আবদুল্লাহ রাসুলের কাছে আবেদন জানালেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনার মুখের খানিকটা উচ্ছিষ্ট পানি দেবেন? হয়তো আপনার উচ্ছিষ্ট পানির বরকতে আমার আব্বার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।’
এ সেই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যে ছিল মদিনার মোনাফেকদের নেতা। মুসলিমদের অরক্ষিত রেখে যে উহুদের ময়দান থেকে ৩০০ যোদ্ধা নিয়ে ভেগে গিয়েছিল। উম্মুল মুমিনি আয়েশা রা.-এর ওপর অনাচারের অপবাদ দিয়েছিল যে।
যে রাসুলকে হত্যা করতে মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেছিল। রাসুলকে মদিনা থেকে বের করে দিতে একের পর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সেই ইবনে উবাই মৃত্যুশয্যায় শায়িত আর তার ছেলে আবদুল্লাহ এসেছে রাসুলের মুখের বরকতময় উচ্ছিষ্ট পানি নিতে, যেন তার আব্বার মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব হয়ে যায়।
আল্লাহর রাসুল দেরি করলেন না, তখনই নিজের মুখের বরকতময় উচ্ছিষ্ট পানি আবদুল্লাহর হাতে দিয়ে দিলেন। আবদুল্লাহ রাসুলের উচ্ছিষ্ট পানি নিয়ে বাবার মৃত্যুশয্যার পাশে এসে বসলেন। বাবার সামনে পানির পাত্র তুলে ধরে বললেন, ‘নিন, পান করুন।’
ইবনে উবাই বললো, ‘এটা কী?’
ছেলে বললেন, ‘রাসুলের মুখের বরকতময় উচ্ছিষ্ট পানি, হয়তো এর বদৌলতে আপনার মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব হবে এবং আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন।’
ইবনে উবাই পানির পাত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললো, ‘কারো পেশাব নিয়ে আসো, সেটা পান করবো; তবু মুহাম্মদের মুখের পানি পান করবো না।’
০২
কিছু সময় পরই ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু হয়। ছেলে আবদুল্লাহ এক বুক দুঃখ নিয়ে আবার দৌড়ে এলেন রাসুলের কাছে। বুকে দুঃখ, চোখে মুখে অনুশোচনার লজ্জা, বাবার পাপের ভার যেন তার বুকে ভারী পাথর হয়ে বসে আছে। তবু সাহস করে রাসুলের কাছে আবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আব্বা মারা গেছেন। আপনার গায়ের একটা জামা দেবেন, আব্বার কাফন দিবো। হয়তো আপনার জামার বরকতে তার কবরের আজাব মাফ হয়ে যাবে।’
আল্লাহর রাসুল, আমার রহমতের নবি, পৃৃথিবীর সবচে নরম দিলের মানুষটি কোনো রকম চিন্তা ছাড়াই বলে ওঠলেন, ‘হ্যাঁ, কেন নয়? এই নিয়ে যাও।’ বলেই তিনি নিজের গায়ের জামা খুলে আবদুল্লাহর হাতে দিয়ে দিলেন।
আবদুল্লাহর চোখ জলে ভরে ওঠলো। এমন দয়ার নবিকে তার বাবা কতো ভাবেই না কষ্ট দিয়েছে! রাসুলের জামা বুকে চেপে ধরে আবদুল্লাহ দৌড়ে বাবার লাশের কাছে চলে এল।
০৩
ইবনে উবাইয়ের জানাজা প্রস্তুত। তাকে রাসুলের গায়ের জামা দিয়ে কাফন দেয়া হয়েছে। এখনই জানাজা পড়ানো হবে। এমন সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এলেন সেখানে। ইবনে উবাইয়ের ছেলে আবদুল্লাহ রাসুলকে দেখে দৌড়ে এসে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে মিনতি করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আব্বার জানাজাটা আপনি পড়াবেন?’
আমার রাসুল একবারও চিন্তা করলেন না, একবারও ভাবলেন না ইবনে উবাইয়ের অতীত অপকর্মের ব্যাপারে, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন, ‘হ্যাঁ, কেন নয়? অবশ্যই তার জানাজা পড়াবো।’ রাসুল সাহাবাদের জানাজা নামাজের কাতার সোজা করতে বললেন।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কাছেই ছিলেন। তিনি রাসুলের সামনে দাঁড়িয়ে ইবনে উবাইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কি জানেন না সে কে?’
রাসুল উমরের রাগত চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, উমর, আমি জানি সে কে।’
‘তবু আপনি তার জানাজা কেন পড়াচ্ছেন?’ উমর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘উমর, আল্লাহ তো আমাকে তার জানাজা পড়াতে নিষেধ করেননি। শুধু বলেছেন, আপনি তার জানাজা পড়ান বা না পড়ান তবু তাকে ক্ষমা করা হবে না। আমি তবু পড়ছি, যদি আল্লাহ দয়ার্দ্র হয়ে তাকে ক্ষমা করেন! আল্লাহ বলেছেন, আপনি যদি ৭০ বার তার গোনাহ মাফের জন্য দোয়া করেন তবু আমি তাকে ক্ষমা করবো না। উমর, আল্লাহ যদি বলতেন ৭০ বার তার জন্য দোয়া করার পর তাকে ক্ষমা করা হবে, তবে আমি ৭০ বারই তার জন্য দোয়া করতাম।’
তাবলিগ ও মাওলানা সাদ বিষয়ে উলামা জোড়ে গুরুত্বপূর্ণ ৫ সিদ্ধান্ত
রাসুল ইবনে উবাইয়ের জানাজা পড়ালেন। জানাজা শেষে তাকে কবরে শোয়ানো হলো। রাসুল তার লাশের সঙ্গে কবর পর্যন্ত এলেন। লাশ কবরে শোয়ানোর সময় কী মনে হতেই তিনি সাহাবাদের বললেন, ‘তার লাশটা একটু বাইরে উঠাও তো।’
মদিনার মোনাফেকদের নেতা ইবনে উবাইয়ের লাশ কবর থেকে আবার উপরে উঠানো হলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের মুখের একটুখানি থুতু পরম যত্নে ইবনে উবাইয়ের মুখে মেখে দিলেন, হয়তো এর বরকতে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন।
হায় আমার নবি! এমন করে মানুষকে ভালোবাসা যায়, এভাবে নিজের হৃদয়কে ছেঁচে মানুষের ভালোবাসায় বিলিয়ে দেয়া যায়... আপনি না দেখালে এ পৃথিবী ভালোবাসাহীন কাঙাল হয়ে থাকতো। ভালোবাসার অসংখ্য অনুভব অধরা থেকে যেত পৃথিবীর ইতিহাসে।
০৪
ও আমার ভাই, আপনি সেই নবির উম্মত যিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ক্ষমার জন্য নিজের গায়ের জামা খুলে দিয়ে দিয়েছিলেন, নিজে তার জানাজা পড়িয়েছিলেন। আপনি সেই নবির উম্মত যিনি নিজের সবচে প্রিয় চাচার হত্যাকারীকে সকলের সামনে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর আবু জেহেলের ছেলে ইকরামা রা.-কে নিজের বুকে টেনে নিয়েছিলেন। যে তাকে হত্যা করতে আসতো তিনি তার দিকে নিজের বুক পেতে দিতেন, যাতে হত্যা করতে হত্যাকারীর কোনো ধরনের তকলিফ না হয়।
আপনি নিজেকে সেই নবির উম্মত দাবি করে প্রতিদিন অপর ভাইয়ের দোষচর্চা, ঘৃণাচর্চা, শত্রুতা, জ¦ালিয়ে দাও-পুড়িয়ে দাও, হত্যা করো...স্লোগান তুলছেন। এ কেমন ইসলাম আপনারা পালন করছেন? এ কোন নবির উম্মত বলে নিজেদের প্রকাশ করছেন? ইসলামের কোথায় এ ধরনের ঘৃণিত অপকর্মের বৈধতা দেয়া আছে? নবুওয়াতের ২৩টি বছর যে নবি উম্মতকে ভালোবাসার সবক শিখিয়ে গিয়েছেন, সেই উম্মত ঘৃণা, পরনিন্দা, কুৎসিত গালিগালাজ, অপরকে হেয় করার হীন সকল পন্থা অবলম্বন করে যাচ্ছে। ইসলামের নামে এই অসভ্যতা কোথা থেকে আমদানি হয়েছে?
আমার ভাইয়েরা, রহমাতুল্লিল আলামিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও আপন ভাইকে ঘৃণা করার এমন কারগুজারি দূরে সরিয়ে দিন। অপরকে ঘৃণা করার মানসিকতা কখনো আপনাকে মহৎ করবে না, অপরকে অপমান করে কখনো আপনি গুড মুসলিম হতে পারবেন না। যদি তাই হতো তবে রাসুল আমাদের ভালোবাসা না শিখিয়ে ঘৃণা করতে শিখিয়ে যেতেন, অপরের দোষচর্চা করতে শিখিয়ে যেতেন। অথচ তিনি বলেছেন, ‘যে মানুষকে ভালোবাসতে জানে না, আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন না।’ তিনি আবার বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উম্মতের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে, সে আমার উম্মত নয়।’
হায় আমার নবি! আপনার এই উম্মতের পথের দিশা আপনার করকমলেই পেশ করছি।
আল্লাহুম্মা ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম!