শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


উমামাকে ভালোবেসেছিলাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জারির আরমান
গল্পকার

এয়ারপোর্ট লাউঞ্জের ঘড়িতে সাতটা বাজতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। সন্ধ্যা সাতটার সাউদিয়া এয়ারলাইন্স। ঢাকা টু জেদ্দা। চল্লিশ মিনিট সময় যেন কাটছেই না ইফাদের। একবার হাতঘড়ি আরেকবার লাউঞ্জের লালবাত্তি জ্বলা ঘড়িতে তাকাচ্ছিল। পাশে বসা সদ্যবিবাহিত স্ত্রী উমামা।

দুজনেই সাদা কাপড় পরা। ইফাদের এইটুকু উৎকণ্ঠিত হওয়া স্বাভাবিক। এটা তাদের একসঙ্গে প্রথম ভ্রমণ।  উত্তেজনায় ইফাদ একটু চাপ অনুভব করছিল। এদিকে মাগরিবের নামাজের সময়ও হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে নামাজের নির্ধারিত স্থান আছে।

কিন্তু তারা দুজন লাউঞ্জের একটি কোণা দেখে জামাতে দাঁড়িয়ে গেল। শিউলি ফুলের মতো ছোটছোট বাক্যের সুরা ইখলাস দিয়ে দ্রুত নামাজ পড়াল ইফাদ। নামাজ শেষে সোফায় গিয়ে বসল আবার। কিছুক্ষণ পর স্পিকারে তাদের ফ্লাইটের ঘোষণা শোনা গেল।


উমামার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এটাকে ঠিক "দেখা হওয়া" বলা ঠিক না। মানে আমি উমামাকে প্রথম দেখি একদিন বিকালে। আসরের নামাজ পড়ে চা খেতে নিচে নামছি। আমার বাসার নিচেই বইয়ের মার্কেট। বিশেষ করে ধর্মীয় বইপত্র পাবলিশ করা কিছু লাইব্রেরি।

একদম সামনের দোকানটায় দেখি একজন বোরকা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে। কেবল চোখ দুটো দেখা যায়। চা খাব বলে বেরুলাম। কিন্তু চোখজোড়া আমাকে কোথায় যেন একটা টান মারল ধরে। অস্বাভাবিক একটা ভঙ্গি নিয়ে দোকানের অদূরে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

আশেপাশে ছোট ভাইবেরাদাররা ঘোরাঘুরি করছিল। ওরা আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে প্র্যাসটিজ পাংচার হওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার এগিয়ে গিয়ে কথা বলাও সম্ভব না। মেয়েটাও আমাকে একটু একটু দেখছিলো যেন লুকিয়ে লুকিয়ে।

আমি একটু আড়চোখে খুঁটিয়ে নিচ্ছিলাম। এঁকে নিচ্ছিলাম আমার নিজস্ব ক্যানভাসে। যেন পরবর্তী সাক্ষাতে দেখে চিনতে পারি। বিশেষভাবে লক্ষ করলাম ওর জুতোজোড়া। এছাড়া কিছু লক্ষ করার ছিল না। দেখলাম দোকানের ছোকরার কথা শুনে একটু হাসল। দেখলাম না ঠিক, শুনলাম।

ছোটখাটো নিশ্বাস ফেললাম আর "কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে" আওড়াতে আওড়াতে সেদিনের মতো চা খেতে গেলাম।

প্রায় ছয় মাস। যত বোরকা পড়া মেয়ে দেখি, আগে পায়ের দিকে তাকাই। একজোড়া সোনালি ফিতার জোতা খুঁজি। কোথাও দেখা নেই তার...


ছয় ঘন্টা জার্নির পর জেদ্দায় নামল ইফাদ উমামা। নেমেই জেদ্দা থেকে মক্কার দিকে যাত্রা। বুকিং দেয়া হোটেলে পৌঁছে ব্যাগপত্র রাখল। রেখেই ছুটল কাবার দিকে।

দৌড়ুতে দৌড়ুতে চিন্তার গতি থেমে থেমে যাচ্ছিল ইফাদের। তন্দ্রার মতো আজব এক ঘোর মাথায় ভর করছিল। এইতো কাবা, ভালোবাসার বাইতুল্লাহ। জীবনের এতো বড় স্বপ্ন আজ সত্য হচ্ছে। এসব ভাবছিল ইফাদ। উমামাও কি তাই ভাবছিল? হয়ত।

দুজন হাত ধরাধরি করে বাবুস সালাম দিয়ে হারামে প্রবেশ করল। কালো গিলাফে ঢাকা কাবার দীপ্তিতে তাদের চোখ আর হৃদয় শীতল হয়ে আসছিল। মৃদু শব্দে দোয়া পড়তে থাকল দুজনে। সারাজীবন যেন সরল সঠিক পথে থাকতে পারে সেই দোয়া।

লাব্বাইক ধ্বনিতে ক্বাবা চত্বর মুখরিত। তারাও শামিল হলো সেই মিছিলে। একে একে ওমরার আমলগুলো করতে থাকল ইফাদ উমামা। তাওয়াফ, সায়ি, মাথামুণ্ডণ ইত্যাদি। ওমরা শেষে ক্লান্ত শরীরে দুজন হোটেলে ফিরল।


উমামার সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হওয়াটা ছিল রীতিমত মিরাকেল। প্রথম দেখার তিন বছর পর দ্বিতীয়বার দেখা। মজার ব্যাপার হলো, দ্বিতীয় সাক্ষাতে শুরুতে বুঝতেই পারিনি, এই উমামা সেই সোনালি ফিতার জোতার মালিক।অনেক পরে রহস্য উন্মোচিত হয়।

সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। নীলক্ষেতে হাঁটাহাঁটি করছি। বইয়ের তালিকা হাতে। খোঁজাখুঁজি করছি। ফাঁকে ফাঁকে চা পাকোড়া  খাচ্ছি।  এক দোকানে দাঁড়িয়ে পাওলো কোয়েলহোর "দ্য স্পাই" দামাদামি করছি। হঠাৎ পাশে একটা এসে দাঁড়াল।

যেহেতু একদম গা ঘেঁষে দাঁড়ানো তাই দৃষ্টি যতটা বাঁকানো যায় বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কালো বোরকায় আকাশী স্কার্ফ। মুখ ঢাকা। হাতে মেরুন পাথরের আঙটি। আঙুলের ফাঁক থেকে একটা কাগজ বের করল। বেশকিছু বইয়ের নাম করল। বেশির ভাগই নীলক্ষেতের বাইরের দোকানে না পাওয়ার মতো।

দোকানি মামার সঙ্গে আমার আগে থেকেই মুখচেনাচিনি ছিল। মামা বলল, আপুকে একটু মোস্তফার দোকানটা দেখায়া দেন। "অবশ্যই" বলে আপুকে নীলক্ষেতের লিজেন্ডারি মোস্তফা মামার দোকানে নিয়ে গেলাম। দোকানে রেখেই চলে এলাম না। বললাম, "আপনার তালিকাটা দেন আমারে"।

একে একে সব বই মোস্তফাকে দিয়ে বের করালাম। কয়েকটা পাওয়া গেল না অবশ্য। ফাঁকে ফাঁকে আমরা প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলছিলাম। প্রয়োজনীয় বলতে বইকেনা সম্বন্ধীয় প্রয়োজন। ঘন্টাখানেক লাগলো এইসব করতে।

বই নিয়ে বের হলাম। মেয়েটা আমাকে চা খাওয়াতে চাইলো। আমি না করতে করতেও রাজি হয়ে গেলাম। রাস্তার ওপারে একটা হোটেলে মুখোমুখি বসলাম দুজন।

আপনার নামটাই তো জানা হয় নাই এখনো
ইফাদ, নাম তো সুনা হি হো গা

দুজনই হাসলাম। ওর নামটাও জানলাম। চা মানেই তো কেবল চা না, সাথে টা ও থাকে। কথা লম্বা হলো অনেক। কে কী করি, কোথায় থাকি এসবও শোনা হয়ে গেল কথার ভেতর দিয়ে। জানলাম, উমামা নিজ জেলাতেই বোটানিকে অনার্স করছে।

বছরে একবার নিয়ম করে ঢাকা আসা হয়। শুধু বই কেনার উদ্দেশ্যেই। ঢাবিতে ওর এক বান্ধবী শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদে পড়ে। তার ওখানেই আসে। কি এক কাজ থাকায় সেই বান্ধবী আজ সঙ্গে আসেনি।

চা খেতে খেতে আমার ফেসবুক আইডির নাম জানতে চাইল। বললাম। দুজনের মধ্যে বিনাবাক্যে বন্ধুত্বও হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষে মানুষের আবেগ কমছে? কে বলল?

পরের ঘটনা আর বড় করা যাবে না। কয়েক লাইনে বলি। অনলাইনে নিয়মিত বন্ধু হয়ে উঠলাম আমরা।  এমন বন্ধু, মাঝেমধ্যে অফলাইনেও হানা দেই পরস্পরকে। বছর না গড়াতে দুজনই ব্যাপারটা ফিল করলাম। কেউ বলার সাহস পাচ্ছিলাম না।

নানান রুপক, উপমা, মেটাফোরে বোঝাই। বোঝে না। আরো কিছুদিন গেল। একদিন বলেই ফেললাম। ফলাফল, পারিবারিক আলাপে বিয়ে। ভাল বন্ধু থেকে আমরা আরো ভাল বন্ধু হওয়ার পথে।


বিয়ের কিছুদিন পর। একদিন উমামাদের বাসায় জোতার সেলফে আমার চোখ আটকে গেল। সোনালি ফিতার সেই জোতা! আমি ঝটকা খেলাম একটা। সম্বিত ফিরে পেতে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। নাহ! এ হতেই পারে না! এটা সেই জোতা না। কোম্পানি তো আর এক ডিজাইনের এক জোড়াই বানায় না।

তাও মন কেমন কেমন করে। উমামাকে ডাকলাম। দরজা লাগালাম। বসলাম মুখোমুখি। "মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন" টাইপ করে।

বললাম, চোখে চোখ রাখো।
ছি! এই অসময়ে কি দুষ্টুমি!
একরকম জোর করে ক্ষাণিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করলাম। তিন বছর আগের সেই চোখই তো এই চোখ!

সেই লাইব্রেরিটির নাম করে বললাম, ওখানে গেছো কোনদিন?
কয়েকবছর আগে গেছিলাম একবার। বাইরের লাইব্রেরিতে ধর্মীয় বইপত্র তেমন পাওয়া যায় না। তাই..

আমি নিশ্চিত হলাম কিন্তু কিছু বললাম না ওকে। শেষে বলে বসতে পারে, বিয়ের আগে তাইলে এসবই করে বেড়িয়েছ? শুধু মনে মনে বললাম, অভিধানে মিরাকেল বা কাকতালীয় শব্দগুলো এইসব ঘটনার জন্যেই পড়ে  আছে তাইলে?


মক্কায় কয়েকদিন থেকে আমরা রওনা হলাম মদিনার দিকে। কালো গিলাফের আশ্রয় থেকে সবুজ গুম্বজের আশ্রয়ে। মদিনার অলিগলির কত কথা হাদিসে পড়েছি। সেই পুণ্যময় ভূখণ্ডের দিকে এই যাত্রা! মদিনায় নেমে রওজার পাশে হোটেল খামিরু ফিরজুতে চেক ইন করলাম।

যাত্রার ক্লান্তি কিছুটা কমতেই রওনা হলাম মসজিদে নববীতে। মসজিদে প্রবেশ করে প্রথমেই তাহাইয়্যাতুল মসজিদের দুরাকাত নামাজ পড়ে নিলাম। দুজন পাশাপাশি রওজার দিকে এগুলাম।

ঝিমুনিটা আবার ভর করছে। ঝিমুনির সরপড়া বোধে বিচিত্র কল্পনার হানা।

কত মানুষের কত স্বপ্ন! একদিন বন্ধুদের আড্ডায় জিজ্ঞেস করছিলাম, তোরা বিয়ের পর কে কোথায় ঘুরতে যাবি? কেউ বলছিল সমুদ্রে বা পাহাড়ে। কেউ বলছিল নিউইয়র্ক শহরের হাডসন নদীর তীরে একটা সন্ধ্যা কাটানোর খুব শখ হয়। কেউ বলছিল মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বসে ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া একটা ম্যাচ দেখতে চাই। সবার ইচ্ছাই পূরণ হোক, তাই চাই।

ওইদিন আমি কিছু বলিনি। কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। আমি তো চাইছিলাম দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নবীর রওজায় একবার সালাম দিতে।

আমার সেই স্বপ্নের ঠিক আগ মুহূর্তে এখন আমরা দাঁড়িয়ে। দেখলাম, উমামার ঠোঁট কাঁপছে। চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রুবিন্দু। ভালোবাসার। প্রকৃত মহব্বতের। যে মহব্বত সব ছাড়িয়ে উঠে যায় মহাকালের মহাকাশ ফুঁড়ে।

এত সুন্দর দৃশ্য জীবনে আমি আর দেখিনি।

এসএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ