আওয়ার ইসলাম: মাদকের সঙ্গে জড়িত তিনি। ধনাঢ্য নারীদের ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের অর্থ। হয়রানির ভয়ে সহকর্মীসহ স্থানীয়রা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে সাহস দেখাচ্ছিলেন না। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তার। পুলিশের হাতেই ধরা পড়েন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) সোহরাওয়ার্দী রুবেল।
গত ৮ মার্চ এএসআই রুবেলের বাসা থেকে ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল। ওই বাসার কেয়ারটেকারের অভিযোগ, প্রায় সময় এএসআই রুবেল বিভিন্নজনকে হাতকড়া পরিয়ে ফ্ল্যাটে এনে আটকে রাখতেন। ওনাকে জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলতেন না। পরে জানা যেত অর্থের বিনিময়ে তাদের ছাড়া হয়েছে।
অভিযুক্ত এএসআই রুবেলের বিরুদ্ধে সম্প্রতি এক নারীকে আটকে রেখে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ উঠে।
গত ৭ মার্চ মাদক উদ্ধারের পর কম দেখিয়ে বাকি মাদকের তথ্য গোপনের অভিযোগ ওঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানা ছয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। পরে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে জেলা পুলিশ।
ওই দুই ঘটনা পুলিশ সদস্যদের অপরাধের খণ্ডচিত্র হলেও প্রায় প্রতিদিনই নানা অভিযোগ উঠছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। নানা অপরাধে জড়িত থাকা এবং অপেশাদার আচরণের অভিযোগ ওঠার পর প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপরও থামছে না অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের দুর্নীতি-অনিয়ম। পুলিশ সদর দফতর এসব বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও মাঠপর্যায়ে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং উল্টো দৃশ্যই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গরু ব্যবসায়ীর টাকা ছিনতাই, মাদক বহন ও ব্যবসা, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ছাড়াও রয়েছে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় কয়েকজনকে প্রত্যাহার ও বরখাস্ত করেছে পুলিশ সদর দফতর।
পুরনো অভিযোগ ঘুষ ও দুর্নীতির বাইরে গিয়ে মাদক ব্যবসার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশের কনস্টেবল থেকে মাঠপর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তারা। ফলে জঙ্গি দমন থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিসহ পুলিশের নানা সফলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতর বলছে, আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি অপরাধ প্রমাণিত হলে দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। শাস্তির কারণে অপরাধ আগের চেয়ে কমেছে বলেও দাবি সদর দফতরের।
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) এক অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, আইনবহির্ভূত কাজে ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আইজিপি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আরও বলেন, যদি পুলিশের কোনো কর্মকর্তা ও সদস্য মাদকের সঙ্গে জড়িত হন, যদি প্রমাণ করতে পারি তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মার্চ রাতে বরিশালের উজিরপুরের শিকারপুর এলাকা থেকে মুণ্ডপাশা গ্রামের মৃত মোশারফ খানের ছেলে শামিম খানকে ৫০ পিস ইয়াবাসহ আটক করেন এএসআই আমিনুল। পরে রিমান্ডে নেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করেন এএসআই আমিনুল। ঘটনার সত্যতা পেয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম এএসআই আমিনুল ইসলামকে থানা থেকে প্রত্যাহার করেন।
কসবা উপজেলার টি. আলী মোড় থেকে দুটি প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গাঁজা উদ্ধার করে পুলিশের একটি দল। পরবর্তীতে তারা মাত্র ৪০ কেজি গাঁজা থানায় জমা দিয়ে বাকি গাঁজা থানার পাশের একটি ঝোপে লুকিয়ে রাখেন। রাতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ওই ঝোপ থেকে গাঁজা উদ্ধার করে। ওই ঘটনার পর তথ্য গোপনের অভিযোগে গত ৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শ্যামল মজুমদার, মনির হোসেন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ফারুক, সালাউদ্দিন ও কনস্টেবল শাহজাহান ও কাশেম নামে ছয় সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
মাদারীপুরের কালকিনির বাঁশগাড়িতে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে আটকে নয় ব্যক্তিকে নির্যাতনের অভিযোগে থানা পুলিশের ওসি, তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক ও পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তাসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। গত ১১ মার্চ মাদারীপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেনের আদালতে বাদী হয়ে মামলাটি করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য খবির মৃধার বাবা নূরু মৃধা।
গত ২ মার্চ নারায়ণগঞ্জে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্য কোচিং সেন্টার খুলে ২০ চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত সেই পুলিশ কর্মকর্তা এএসআই শাহাবুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি থানার মালখানা থেকে মাদক সরানোর অভিযোগ ওঠে কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার মালখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই আহসান হাবিব এবং থানার অপারেশন অফিসার এসআই তপন বকশীর বিরুদ্ধে। পরে জেলা পুলিশ লাইনে তাদের ক্লোজড করা হয়।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরায় গরু ব্যবসায়ীর নয় লাখ ৪৫ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে দুই পুলিশ সদস্যসহ চারজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। আটকরা হলেন- ডুমুরিয়া থানার এএসআই আবদুর রউফ, কনস্টেবল নাদিম, সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর গ্রামের মনি ড্রাইভার ও ঘোষপাড়া এলাকার রাজু হোসেন।
নরসিংদীতে প্রবাসীকে বহনকারী গাড়িতে ডাকাতির মামলায় গত ৩১ জানুয়ারি চার পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলেন- রায়পুরা থানার এসআই সাখাওয়াত হোসেন, এসআই আজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মাইনুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম।
গেল বছর রাজধানীর ফকিরাপুলে একটি ভবনে অভিযানের নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের কাছে সিআইডির এক কর্মকর্তা কোটি টাকা ঘুষ দাবি করে বরখাস্ত হন। ২৫ অক্টোবর টেকনাফের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ ও মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়ার পর ১৭ লাখ টাকাসহ গোয়েন্দা পুলিশের সাত সদস্য আটক হন।
সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি চাঞ্চল্য ও সমালোচনার জন্ম দেয় পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা কর্তৃক এক তরুণীকে তুলে নিয়ে জোর করে বিয়ে এবং পরবর্তীতে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হয়রানির বিষয়টি। অভিযোগটি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ডিআইজি মিজানকে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার পদ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। অভিযোগ তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটি পুলিশ সদর দফতরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও তা এখনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছায়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
পুলিশ অ্যাক্ট-১৮৬১ অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। এর একটি লঘুদণ্ড, অন্যটি গুরুদণ্ড। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিতকরণ ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ। এছাড়া বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি ছোট ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেয়া হয়।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কনস্টেবল থেকে শুরু করে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পর্যন্ত সদস্যরা বেশি অপরাধে জড়াচ্ছেন। তারপর রয়েছেন পরিদর্শক মর্যাদার কর্মকর্তারা। এএসপি থেকে শুরু করে আরও উপরের কর্মকর্তার অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে শাস্তি পাওয়ার নজির রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লঘুদণ্ড পেয়েছেন ৭৩ হাজার ৩৩৩ জন সদস্য। তাদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত রয়েছেন ৭৩ হাজার ২৯ জন, পুলিশ পরিদর্শক ৭০ জন এবং এএসপি থেকে তার ঊর্ধ্বে কর্মকর্তা রয়েছেন ২৩ জন। একই সময়ে গুরুদণ্ড পেয়েছেন তিন হাজার ৯৯১ জন।
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১২ সাল থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫১১ পুলিশ সদস্য চাকরিচ্যুত এবং ৪২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এরপরও তাদের অপরাধপ্রবণতা কমানো যাচ্ছে না।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সহেলী ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তা তদন্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। দোষীদের বিভাগীয় প্রসিডিউর অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়।