আতাউর রহমান খসরু
সমকালীন বিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত স্টেফিন হকিং গত ১৪ মার্চ বুধবার মারা গেছেন। তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর জীবনের অধিকারী।
মাত্র ২২ বছর বয়সে দুরারোগ্য মোটর নিউরনে আক্রান্ত হয়ে চলাফেরা ও কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। চিকিৎসকরা বলেছিলেন তিনি সর্বসাকুল্যে ২-৩ বছরের বেশি বাঁচবেন না। কিন্তু তিনি বেঁচেছেন আরও ৫৪ বছর এবং জয় করেছেন বিজ্ঞান জগতের সিংহাসন।
শারীরিক অক্ষমতা উপেক্ষা করে হকিং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন একজন সফল গবেষক, জনপ্রিয় শিক্ষক ও পাঠকপ্রিয় লেখক হিসেবে। তার এ প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি বিস্ময়কর ও অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। কি পরিমাণ অমিত জীবনশক্তি থাকলে মানুষ এ অসাধ্য সাধন করতে পারে?
যে বিজ্ঞানীর গবেষণা জীবনের ৫০ বছরই কেটেছে হুইল চেয়ারে, কথা বলেছেন মেশিনের সাহায্যে তিনি কিনা একের পর এক আবিস্কার করেছেন মহাবিশ্বের জটিল ও দুর্বোধ্য সব তত্ত্ব। উন্মোচন করেছেন মহাবিশ্বের জন্মরহস্য।
কি সেই জীবনশক্তি যার মাধ্যমে তিনি এ কীর্তি গড়েছেন? নিজেকে টেনে তুলেছেন সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায়? হকিং তার সাফল্যের চাবিকাঠি লুকান নি। উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সবার জন্য। তার নাম মৃত্যুচিন্তা।
তিনি বলেছেন, ‘প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুকে সামনে পাওয়ায় জীবনের মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন জীবনকে সর্বোচ্চ মূল্যমানে উন্নীত করতে। ধাবমান মৃত্যু তাকে শিখিয়েছে সময়ের সঠিক ব্যবহার।
চোখের সামনে মূর্তমান মৃত্যু তাকে জীবনের কোনো মুহূর্তকে মূল্যহীন ভাবতে দেয় নি।
হকিং তার জীবনকে খরচ করেছেন পাই পাই হিসেব করে এবং নিজের পাওনা বুঝে নিয়েছেন কড়ায় গণ্ডায়। মৃত্যুচিন্তাই তাকে পরিণত করেছে মহাকালের বিস্ময়ে, তার নাম লিখে দিয়েছে অবিস্মরণীয়দের তালিকায়।
তিনি বলেছেন, মৃত্যুর সার্বক্ষণিক নৈকট্যের কল্যাণে আমি তিলে তিলে অনুধাবন করেছি জীবন একটা তুমুল যাপনীয় জিনিস। সেই হিসেবে আমি এ পাথর-জীবনকে অনেকের চেয়ে বেশিই অর্থময় করে তুলতে পেরেছি।
ইসলাম মানুষকে অধিক পরিমাণে মৃত্যুচিন্তা করার যে নির্দেশ দিয়েছে তার কারণও ঠিক এটাই। মৃত্যুমুখী মানুষ যেনো তার ক্ষণস্থায়ী জীবনকে মূল্যবান করে তোলে। সময়ের সর্বোচ্চ ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে। জীবনকে সাজিয়ে তোলে সাফল্যের হীরা-মণি-মাণিক্য দিয়ে।
হাদিসের ভাষায় জাগতিক এ জীবন পরকালের শষ্যক্ষেত। যে ব্যক্তি এ যতো বেশি নিখুঁতভাবে সফল বোপন করবে সে ততো বেশি লাভবান হবে।
মৃত্যুচিন্তাই মানুষকে জীবনে সৎ ও হিসেবি হতে শেখায়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মানুষকে বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন! তোমরা যে মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে নিশ্চয় তোমরা তার মুখোমুখি হবে। অতপর তোমাদের উপস্থিত করা হবে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগতের জ্ঞাতসত্ত্বা আল্লাহর দরবারে। তিনি তোমাদের জানিয়ে দিবেন তোমরা কি কাজ করেছো।’ [সুরা জুমা : ০৮]
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমরা অধিক পরিমাণ মৃত্যুকে স্মরণ কর। কেননা তা পাপ মিটিয়ে দেয় এবং দুনিয়া বিমুখ করে। যদি তোমরা মৃত্যুকে প্রাচুর্যের সময় স্মরণ কর তা হ্রাস করবে। আর যদি তাকে দারিদ্র্যে স্মরণ কর তা তোমাদের জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট করবে।’ [কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ৪২০৯৮]
ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফূযাতের অন্যন্য অ্যাপ
অর্থাৎ মৃত্যুচিন্তা মানুষকে নানান ধরনের প্রলোভন থেকে মুক্ত করে সত্যিকার একজন সাধকে পরিণত করে। তাকে একজন মানবিক মানুষে পরিণত করে, অর্থময় জীবনসন্ধানে অনুপ্রাণিত করে। তার দাবি মানুষ সব ধরনের অর্থহীন কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মুসলিম জীবনের সৌন্দর্য্যই অর্থহীন বিষয় পরিহার করা। [সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৯৭৬]
জীবনজুড়ে এই অর্থময়তার সন্ধানই ব্যক্তিকে উভয় জগতে সাফল্যমণ্ডিত করে। সে সাফল্য শুধু পরকালীন জীবনে সীমাবদ্ধ নয় বরং তা ব্যক্তির জাগতিক জীবনকেও জ্যোতির্ময় করে তোলে।
হজরত সাফিয়্যাহ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক নারী হজরত আয়েশা রা. কাছে হৃদয়ের কঠোরতার অভিযোগ করলো। তিনি বললেন, অধিক পরিমাণে মৃত্যুকে স্মরণ কর। তা তোমার হৃদয়কোমল করবে।
হজরত সাফিয়া রা. বলেন, সে তাই করলো। তার হৃদয় কোমল হলো। এজন্য সে হজরত আয়েশা রা. এর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
হৃদয়ের কোমলতা মানুষের জীবনসৌন্দর্যের অপরিহার্য একটি বিষয়। এভাবে মৃত্যুচিন্তা মানুষের জীবনকে সুন্দর, অর্থময় ও স্বার্থক করে তোলে।
রাসুলুল্লাহ সা. এর একটি হাদিস থেকেও বোঝা যায় মৃত্যুচিন্তা মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জীবনকেই প্রাপ্তি ও সমৃদ্ধিতে সম্পন্ন করে তোলে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও সম্মানিত ব্যক্তি হলো যারা অধিক পরিমাণে মৃত্যুকে স্মরণ করে, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার পূর্বে তার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়। প্রকৃতপক্ষে তারাই বুদ্ধিমান। তারা লাভ করবে জাগতিক জীবনের সম্মান এবং পরকালের মর্যাদা। [মু’জামুস সগির, হাদিস নং ১০০৮]
বিজ্ঞানী স্টেফিন হকিংয়ের মৃত্যুচিন্তায় পরকাল ছিলো না তাই তিনি হয়তো পরকালীন জীবনে কিছুই পাবেন না। কিন্তু ইহকালীন জীবন তিনি তার প্রাপ্য ঠিকই বুঝে নিয়েছেন।
অন্যদিকে একজন মুমিনের মৃত্যুচিন্তায় পরকাল প্রবলভাবে বিদ্যমান থাকায় তিনি সাফল্য পানে দুনিয়া ও আখেরাতে সমানভাবে। মৃত্যুচিন্তা তার সামনে খুলে দিবে উভয় জগতের ধনভাণ্ডারের দুয়ার।
মুমিন তার বল্গাহীন জীবনে আল্লাহর আনুগত্যের লাগাম পরিয়ে বুঝে নিবে পার্থিব ও অপার্থিব জীবনের সব প্রাপ্য। এটাই হাদিসের অঙ্গীকার।
আরও পড়ুন: স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্য: পাল্টাবে কি নাস্তিকদের বিশ্বাস?