আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম
প্রথম থেকেই ফিলিস্তিন নিয়ে ইসরাইলি ষড়যন্ত্রের সহযাত্রী আমেরিকা। ফিলিস্তিনি মুসলমানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের যে কোনো অন্যায়কে সমর্থন করে আসছে দেশটি। এবার ইসরাইলের দাবি অনুযায়ী ফিলিস্তিনকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে তারা। এ কাজে তাদের সাহায্য করছে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো।
নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইসরাইল-আমেরিকা একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। যা আরব গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বা শতাব্দীর সেরা চুক্তি নামে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। ষড়যন্ত্রটির কথা প্রথম গণমাধ্যমে আসে গত বছরের শেষভাগে।
নতুন পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরির পূর্বে ইসরাইল-আমেরিকা তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র সৌদি আরব, মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে সমঝোতা করে নিয়েছে।
সমঝোতা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ইসরাইল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরব নেতারা একাধিক বৈঠকও করেছেন। বৈঠকগুলো তেলাবিব, কায়রো ও আম্মানে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নতুন চুক্তির সংবাদ যখন প্রথম প্রকাশ হয় তখন বলা হয়েছিলো বর্তমান ফিলিস্তিনকে তিনভাগে ভাগ করে ফেলা হবে। দখলকৃত গাজা উপত্যকা চলে যাবে মিসরের অধীনে। আর দখলকৃত পশ্চিম তীরের একাংশে থাকবে জর্ডানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।
পশ্চিম তীরের অবশিষ্ট অংশ শাসন করবে ইসরায়েল। এখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌম ইসরায়েল রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।
এ তথ্য ফাঁস হওয়ার পর আরব জনগণের মাঝে তীব্র প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে এ রূপরেখায় খানিকটা পরিবর্তন করে জেরুসালেম বাদে বাকি অংশ নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের কথা বলা হয়েছে। তবে তাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়া হবে কি না সে বিষয়ে কোনো অঙ্গীকার নেই।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের গণমাধ্যমগুলো দাবি করছে, সৌদি আরব ফিলিস্তিনকে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’-এর একটি কপি হস্তান্তর করেছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে তা মেনে নিতে চাপ দিচ্ছে।
তবে সৌদি আরব কোনো ধরনের নথি হস্তান্তর বা অন্য কোনো ভূমিকা পালনের দাবি অস্বীকার করেছে।
যদিও প্রেসিডিন্ট ট্রাম্পের ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’র পুরো রূপরেখা এখনও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় নি তবে ধারণা করা হয় সৌদি সরকার এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ উভয়ই পরিকল্পনাটি বিস্তারিতভাবে জানে।
এজন্যই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বলেছেন, আমেরিকা এ পরিকল্পনা মানার জন্য একজন ফিলিস্তিনিকেও খুজে যাবে না।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক ফিলিস্তিনি কূটনৈতিক বলেছেন, পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ওয়েস্ট ব্যাংকের অর্ধেক এবং গাজা ভূ-খণ্ড নিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে। ফিলিস্তিনের শরনার্থী সমস্যার মানবিক সমাধান খোঁজা হবে।
ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন একটি জেরুসালেম গঠনেরও আশ্বাস দেয়া হয়েছে তাতে।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু একমত হয়েছেন যে, জেরুসালেমের উপর ফিলিস্তিনের দাবি প্রত্যাহার ব্যতীত কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। ফিলিস্তিনের রাজধানী অবশ্যই জেরুসালেমের বাইরে হবে। প্রাচীন ও মূল জেরুসালেমের বাইরে তার নিকটস্থ গ্রামাঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন জেরুসালেম গড়ে তোলার অবকাশ দেয়া হয়েছে।
নতুন পরিকল্পনায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে ইসরাইলের উপর। এজন্য ফিলিস্তিনকে অধিকৃত ভূমির দাবি ও ভবিষ্যত সীমান্তের ব্যাপারে দরকষাকষি ত্যাগ করতে হবে।
ফিলিস্তিনি কূটনৈতিক নাম গোপনের কারণ তুলে ধরে বলেন, আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়ায় কথার অনুমতি দেয়া হয় নি এবং পরিকল্পনাও প্রকাশিত হয় নি।
জেরুসালেম ইসরাইলের হাতে থাকলেও মুসলিমদের আল আকসা মসজিদে এবং খ্রিস্টানদের গির্জায় যাওয়ার সুযোগ থাকবে বলে উল্লেখ রয়েছে।
ফিলিস্তিনের প্রধান আলোচক সায়িব আরিকত বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে জেরুসালেমের বাইরে গাজা উপত্যকা ও ওয়েস্টব্যাংকে সংকোচিত করার প্রস্তাব রয়েছে। এজন্য আমেরিকা গাজা উপত্যকা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যা সন্দেহজনক।
গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউজে গাজার মানবিক অবস্থা নিয়ে একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ১৯টি দেশ অংশ নেয়। ফিলিস্তিন এ বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে।
ফিলিস্তিনকে এ প্রস্তাবে রাজি করতে সৌদি আরবকে ব্যবহার করছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ফোন করে ফিলিস্তিনি গোয়েন্দা প্রধান মাজিদ ফারাজকে রিয়াদে পাঠানোর কথা বলেন।
ফারাজ সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং তার হাতেই ট্রাম্পের পরিকল্পনা তুলে দেয়া হয়।
ফারাজ মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে কথা বলে একটি বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় আমেরিকা। সৌদি আরব সফররত একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল ফিলিস্তিনের আলোচনা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাব দরাদরির জন্য নয়। এটি বাস্তবায়নের জন্য।
প্রস্তাবে রাজি করতে সৌদি আরব ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে প্রদত্ত তাদের সাহায্যও দ্বিগুণ করেছে গত দুই মাসে। সাহায্যের পরিমাণ ৭.৫ মিলিয়ন ডলার থেকে তা বাড়িয়ে ২০ মিলিয়ন করা হয়েছে।
সবকিছুর পরও মাহমুদ আব্বাস পূর্ব জেরুসালেমসহ ১৯৬৭ সালের সীমানা সংকোচনে রাজি নন। তিনি বলেছেন, আমেরিকা ও কিছু আরব রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাপ থাকার পরও আমরা এ পক্রিয়া রাজি হবো না এবং তাতে সম্পৃক্তও হবো না। কেননা তা আমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি জেসন গ্রিনব্লাট বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করে না। তারা দূরদর্শী নয়। আমরা এ অঞ্চল ও ফিলিস্তিনিদের জন্য পরিকল্পনা করেছি। তারা ইচ্ছে করলে অংশ নিতে পারে। তবে তারা এর বাইরে থাকতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ একটি আঞ্চলিক পরিকল্পনা। যা ইসরাইল ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসন ও আরব ইসরাইল কোয়ালিশন তৈরির জন্য করা হয়েছে। যেনো তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইরানকে দমন করতে পারে। আমেরিকা এ অঞ্চলের শান্তি চায়। এতে ফিলিস্তিনের সম্মতি ও অসম্মতির ভ্রুক্ষেপ তারা করবে না।’
ফিলিস্তিনি কূটনৈতিক আরও বলেছেন, আব্বাস চিন্তিত যে হয়তো অধিকাংশ আরব রাষ্ট্র আমেরিকার পরিকল্পনাকে সমর্থন দিবে।
সূত্র : মিডলইস্ট আই