আতাউর রহমান খসরু
বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ইসলামি দলগুলোর জোট গঠনের কথা বেশ কিছুদিন যাবত শোনা গেলেও এখনও আলোর মুখ দেখে নি। আদৌ তা সম্ভব হবে কি না এ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
প্রতিবেদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও এখনও জোটগঠনের প্রাথমিক আলোচনাও শেষ করতে পারে নি ইসলামি দলগুলো।
রাজনীতিবিদদের ধারণা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সংশয়, জোটগঠনের লাভ-ক্ষতির হিসেব, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা ইত্যাদি কারণে জোটগঠনের প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
বরং এক ধরনের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে তাতে। আবার অনেকের আগ্রহও নেই জোটে। স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে চান তারা।
দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি দলগুলো নিয়ে বিপল্প শক্তি হিসেবে একটি রাজনৈতিক জোটগঠনের কথা বলে আসছেন ইসলামি ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ।
তিনি আওয়ার ইসলামে দেয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে জোটগঠনে তার ও তার দলের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার সূত্রে জোট গঠনের একাধিক সংবাদও পরিবেশিত হয়েছে। কিন্তু এখনও তার দল অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতায় সক্ষম হয় নি।
দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কেনো জোট গঠন করা সম্ভব হলো না এমন প্রশ্নের উত্তরে মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে এখনও বলার মতো কিছু হয় নি। হলে জানতে পারবেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।’
অনেক রাজনীতিবিদ মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের কারণেই ইসলামী দলগুলো জোটবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন। কিন্তু ইসলামী ঐক্যজোটের এ নেতা নির্বাচন কোনো সংশয় পোষণ করেন না। তবে উদ্যোমে যে কিছুটা ভাটা তৈরি হয়েছে তা তিনি স্বীকার করেছেন।
তার ভাষায়, ‘রাজনীতিতে জোয়ার-ভাটা তো সব সময় ছিলো এবং থাকবে। নির্বাচন সামনে রেখে উৎসাহ-উদ্যোম কমে যাচ্ছে বিষয়টি এমন না। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক সময় কাজ দ্রুত অগ্রসর হয় আবার অনেক সময় ধীর গতিতে অগ্রসর হয়। নির্বাচন নিয়ে কোনো সংশয় নেই। নির্বাচন হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচন না হয়ে উপায়ও নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি না, আমাদের প্রচেষ্টা এমন যে আগামীকালই সফল হয়ে যাবো। এমন চিন্তা করা ভুল হবে। ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছি, ধীরে ধীরে কাজ এগুচ্ছে। আশা করছি, এ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা সাফল্য পাবো।’
নির্বাচনকালীন জোটের ব্যাপারে যে কয়টি ইসলামি দল আগ্রহ দেখাচ্ছে ইসলামী ঐক্যজোট তাদের অন্যতম। ইসলামী ঐক্যজোটের এ আগ্রহের কারণ জানতে চাইলের দলের মহাসচিব বলেন, ‘মুসলমানের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকা আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা ইবাদত।
সুতরাং মুসলমানের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকাও ইবাদত। উলামায়ে কেরাম ঐক্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকার চেষ্টা করেন। ’
‘অনেক সময় দেখা যায়, নানাবিদ কারণে ঐক্যের প্লাটফর্ম তৈরি হয় না। আবার কখনো দেখা যায় সময়ের দাবিতে ঐক্য দ্রুত হয়ে যায়। এখন সময়ের দাবি ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ঐক্যবদ্ধ হলে ইসলাম ও মুসলমানের সাফল্য আসবে।
আর ঐক্যবদ্ধ না হলে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে। প্রথম ক্ষতি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা। দ্বিতীয় ক্ষতি হলো, ঐক্যবদ্ধ না হলে ইসলামবিনাশী শক্তি ইসলামের উপর হামলে পড়ার সুযোগ পাবে।’ যোগ করেন মুফতি ফয়জুল্লাহ।
ঐক্যের প্রচেষ্টার কথা বললেও ইসলামী ঐক্যজোট এ প্রচেষ্টার উপর পুরোপুরি আস্থাশীল নয়। তাই ঐক্য প্রচেষ্টার পাশাপাশি একক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। নিজ দলের নেতা-কর্মীদের এমন নির্দেশনাই দিয়েছেন দলের মহাসচিব।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা-কর্মীরা সব সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইসলামী ঐক্যজোট একটি দিশারী সংগঠন। এ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সব সময় দিশারীর ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে সময় কাটান। এ সংগঠনের সদস্যরা দীন কায়েমের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘দীন কায়েমের জন্য দলের জনশক্তি, সাংগঠনিক শক্তি ও ঐক্য প্রয়োজন। আমার আহ্বান থাকবে তারা যেনো সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করে। সামনের নির্বাচন সামনে রেখে গণসংযোগ সৃষ্টির কাজ করে।
আমাদের ২৭৮টি সংসদীয় আসনে ৩জন করে প্রার্থী বাছাই করেছি। তারা গণসংযোগের জন্য কাজ করবে এবং আল্লাহর কাছে দোয়াও করবে।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে হওয়ার কথা ছিলো ইসলামি ধারার দ্বিতীয় জোট। কিন্তু এক জোট গঠনের উদ্যোগও এক প্রকার স্থবির হয়ে আছে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, ‘জোট গঠনের আলোচনা থেমে গেছে তা নয়। আমাদের মাঝে পারস্পারিক আলোচনা ও যোগাযোগ আছে। কিন্তু গতি কিছু শ্লথ হয়েছে। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিবেচনা করে আমরা সামনে অগ্রসর হবো।’
এ মহাসচিবও জানান আপাতত তারাও একক নির্বাচন করার চিন্তা নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন।
জোটের অন্যতম শরিক খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদীও দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা জানান। তার ভাষায় ‘আমরা মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছি। উপযুক্ত পরিবেশ হলে এক সঙ্গে কাজ শুরু করবো।’
মাওলানা হামিদীর ভাষায় তাদের সম্ভাব্য জোট নির্বাচন সামনে রেখে হলেও তা নির্বাচনী জোট নয়। বরং বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামে তারা যুথবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন।
অন্যদিকে দেশের প্রধান দুটি দলের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন সামনে রেখে তাদের জোট সম্প্রসারণের চেষ্টা করছেন বলে গণমাধ্যমের দাবি। আর সে সুযোগও নিতে চাচ্ছে অনেক ইসলামি দল।
কিছুদিন পূর্বে নীতি আদর্শের সঙ্গে দূরত্ব থাকায় ১৪ দলীয় জোটের অংশীদার হতে চেয়েও পারে নি ইসলামিক ফ্রন্ট।
একইভাবে ২০ দলীয় জোটে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম পার্টি।
জোট নেতৃবৃন্দ জোটসম্প্রসারণের অংশ হিসেবে দলটির আগ্রহে ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছিলো বলে জানিয়েছেন জোটের অন্যতম শরিকদল খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের।
তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রীর মামলা নিয়ে অস্থিরতাসহ নানাবিধ কারণে আলোচনাটি আগায় নি। এখনও সম্ভবনা আছে। এমনকি মত ও মতাদর্শের মিল থাকলে অন্যান্য দলের জন্য দুয়ার খোলা থাকবে। ইসলামিগুলোর জন্যও সমান সুযোগ থাকবে।
ইসলামি দলগুলোর সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয়েছে কিছুটা সংশয় ও দ্বিধা।
তারা মনে করছেন, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তারই অংশ হিসেবে জোটগঠন প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি না হলে হয়তো আদৌ কোনো জোট গঠিত হবে না।
আরও পড়ুন: টাকা নিয়ে দরকষাকষি বক্তাদের পরিহার করতে হবে: মাওলানা নোমান হাবিবী