সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন: উর্বর মাটি আর কৃষকের ঘামঝড়া পরিশ্রমে কৃষিপ্রধান বাংলাদশে উৎপাদিত হয় হরেক রকমের সবজি। দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এসব সবজি রফতানি হয় বিভিন্ন দেশে।
স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ শাকসবজি রফতানি শুরু করে এবং প্রথমবার আয় হয় সাত লাখ ১৩ হাজার মার্কিন ডলার। এরপর থেকে প্রতিবছরই বেড়েছে এর পরিমাণ। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে আয় পৌঁছে কোটি ডলারের ঘরে এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সবজি রফতানিতে আয় হয় সর্বোচ্চ।
কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, এরপর থেকেই শুরু হয় নেতিবাচক ধারা। সম্প্রতি সহযোগী এক দৈনিকের সবজি রফতানি-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মান ইস্যুতে কড়াকড়ি আরোপ করায় ইউরোপের বাজারে এর রফতানি কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে অন্যতম গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যেও হ্রাস পেয়েছে সবজি রফতানি। এতে গত অর্থবছরে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় নেমে এসেছে ২০১৩-১৪ সালের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সবজি রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২১ কোটি ডলার। পরের অর্থবছরে সবজি রফতানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৪ কোটি ডলার।
আর গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা আরও কমে দাঁড়ায় আট কোটি ৩৬ লাখ ডলারে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ কম।
প্রসঙ্গত, রফতানিকৃত সবজির একটা বড় অংশ যেত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সবজি-ফল চাষ ও মোড়কীকরণের মতো কয়েকটি বিষয়ে জোর দিতে বলেছিল।
কিন্তু দেশীয় রফতানিকারকরা সেগুলো যথাযথভাবে না মানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউউ) নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইঙ্গিত দেয়। আর বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি সবজি ও ফল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
উল্লেখ্য, ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হওয়ার কারণে ২০১৩ সালে পান রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এছাড়া পোকামাকড় ও রোগবালাই এবং অতিমাত্রায় কীটনাশকের উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশ থেকে সবজি রফতানির ওপর কয়েক বছর ধরে নন-কমপ্লায়েন্স আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষতি কি শুধু কৃষক কিংবা সবজি রফতানিকারকদের? না। বরং বলা যায়, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাস্তবতায় বৈদেশিক মুদ্রা আয় যখন কমে এসেছে, তখন অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কারণে সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে আয় কমে আসাটাও উদ্বেগের নয় কি?
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সারা বিশ্বে ১৪ কোটি ৭৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৫৩ ডলারের সবজি রফতানি হয়।
এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের আটটি দেশে রফতানি হয় ছয় কোটি ৮৫ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯৮ ডলারের। বাংলাদেশ থেকে সবজির মধ্যে বেশি রফতানি হয় লাউ, কুমড়া, পটোল, বেগুন, ঢেঁড়স, আলু, পেঁপে, চিচিঙা, কাঁকরোল, কাঁচামরিচ, বরবটি, শিম, টমেটো, কচুরলতি ও বিভিন্ন ধরনের শাক।
সারা বিশ্বে প্রায় ৯০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রয়েছেন প্রায় ৬০ লাখ লোক। তাদের উদ্দেশ্য করেই মূলত এদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সবজি রফতানি করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান কম খরচে উড়োজাহাজের পাশাপাশি জাহাজে করে সবজি পাঠায়। সেজন্য বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম দামে ওইসব দেশের সবজি বিক্রি হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যেও মার খাচ্ছে বাংলাদেশের সবজি রফতানি।
দেশের সচেতন একজন নাগরিক হিসেবে মনে করি, সবজি রফতানির ধারা স্বাভাবিক করতে কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এটা করা গেলে রফতানিকে আগের অবস্থায় ফেরানো সম্ভব বলেই মনে হয়।
তাছাড়া কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হলে দেশের অভ্যন্তরে সবজির পরিভোগ এবং বিদেশে সবজি রফতানি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে।
এছাড়া কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য অঞ্চলভিত্তিক আরও অধিকসংখ্যক হিমাগার স্থাপন এবং সবজি বিপণনের জন্য আধুনিক বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বিমানবন্দরের কাছাকাছি কোথাও একটি প্যাকেজিং হাউজ প্রতিষ্ঠার দাবি রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন কিছু বলে মনে হয় না। একই সাথে ইউরোপের বাজারে সবজি রফতানি করতে হলে চুক্তিবদ্ধ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতার হাত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের দেশে কৃষি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে চুক্তিবদ্ধ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য বৃহৎ পরিসরে জায়গা নির্বাচন করা যেতে পারে, যেখানে কৃষক মানসম্মত সবজি উৎপাদন করবেন এবং ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে সবজি কিনে রফতানি করবেন। এ কাজে যত বিলম্ব হবে তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের কৃষি, কৃষক ও অর্থনীতি।
লেখক: কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
[email protected]