আতাউর রহমান খসরু
চিফ রিপোর্টার
শিশুর জীবন ও সময় শিক্ষকের কাছে পবিত্র আমানত। শিক্ষক তার স্নেহ মমতা, আদর ও শাসন দিয়ে শিশুকে তৈরি করবে আগামী দিনের জন্য। শিক্ষকের আদর ও শাসনের ভারসাম্য নষ্ট হলে হুমকিতে পরে শিশুর জীবন ও ভবিষ্যত জীবন।
এজন্য শিক্ষককে হতে হয় উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধ, পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ সম্পন্ন। জ্ঞান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে দেশের অধিকাংশ শিক্ষকই অ-শিক্ষকদের কাতারভূক্ত।
বিশেষত কওমি মাদরাসার মক্তব ও হিফজ বিভাগের শিক্ষকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অভাব অত্যন্ত প্রকট বলে মনে করা হয়। ফলে তাদের শিক্ষা ও শাসনে ভারসাম্য থাকে না অনেক সময়।
সম্প্রতি ময়মনসিংহের একজন হিফজ শিক্ষকের প্রহারে প্রাণ হারিয়েছে বিভাগের এক শিশু শিক্ষার্থী।
ঠিক মতো সবক (পড়া) না দেয়ায় মোটা কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষার্থীর পা ও পাজরের হাড় ভেঙ্গে ফেলেন পাষণ্ড শিক্ষক। এছাড়াও সারা শরীরে মারাত্মকভাবে জখম হয় শিশুটির।
শিশুটির মায়ের দাবি, ‘বাড়িতে মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে সে চিৎকার করে উঠতো হুজুর আমারে আর মাইরেন না, আমি মইরা যাবো।’
অভিযোগ উঠেছে, আহত শিশুকে যথাসময়ে চিকিৎসা না দিয়ে মাদরাসায় রেখে দিয়ে তা গোপনের চেষ্টা করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন ওই শিক্ষক এবং অভিভাবককে বলা হয় আপনার ছেলে খেলতে যেয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছে।
চিকিৎসায় এ বিলম্ব না হলেও হয়তো শিশুটির প্রাণ রক্ষা করা যেতো বলে জানিয়েছেন মহাখালী বক্ষ্মব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসকগণ। এ হাসপাতালেই শিশুটির মৃত্যু হয়।
শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থীর প্রাণ যাওয়ার ঘটনা বিরল হলেও তাদের নির্দয় প্রহারে আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করার ঘটনা প্রায় শোনা যায়। কোনো সন্দেহ নেই কঠোর সরকারি আইন, অভিভাবক ও মাদরাসা পরিচালকদের সচেতনতা ও গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতনের ঘটনা অনেক কমে এসেছে।
কিন্তু এখনো তা পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না কেনো? শিশুর প্রতি এমন অমানবিক আচরণ কি ইসলাম অনুমোদন করে? এমন ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ই বা কি? এসব জানতে কথা বলেছিলাম দেশের শীর্ষ ৩ ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে।
তাদের মতে শিশুর সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। শিশুনির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শিশু নির্যাতন ইসলামে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারা মনে করেন পর্যাপ্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবেই শিশু শ্রেণির শিক্ষকগণ অমানবিক শাস্তি প্রদান করেন।
তারা সবাই শিশুর মৃত্যুতে তীব্র ক্ষোভ ও গভীর সমবেদনা জানান। সাথে সাথে ঘাতক শিক্ষকের উপযুক্ত শাস্তিও দাবি করেন।
বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের ইফতা বিভাগের প্রধান মুফতি, মাওলানা এনামুল হাসান বলেন, শরিয়ত তথা কুরআন হাদিসে শাসন অবশ্যই আছে। বিশেষত অভিভাবক যখন সন্তানের জীবন গঠনের জন্য তাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেন তখন শাসন করার প্রয়োজনও হয়।
তবে শাসন শুধু মারের নাম নয়। এমনকি প্রহার অনেক সময় শাসনের অংশই হতে পারে না। শরিয়তে নাবালক শিক্ষার্থীকে প্রহার করা বৈধ নয়। সাবালকের ক্ষেত্রে অনুমতি আছে শর্ত সাপেক্ষে।
প্রথম শর্ত হলো, প্রহার ব্যতীত অন্য শাসনগুলো ব্যর্থ হওয়া। এছাড়াও চেহারাসহ স্পর্ষকাতর স্থানে আঘাত না করা, মৃদু আঘাত করা। ইত্যাদি শর্ত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের মাদরাসাগুলোয় শাসনের নামে যা চলছে তা কখনো শাসন হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ কাজগুলো যারা করেন তারা শরিয়তের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ। তাদের উচিৎ শিক্ষকতা শুরু করার পূর্বে ইসলামের বিধানগুলো জেনে নেয়া।
যে শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থীর প্রাণ গেলো তার শাস্তিও তিনি বর্ণনা করেন। প্রাজ্ঞ এ মুফতির মতে, উল্লিখিত ঘটনাকে ‘কতলে শিবহে আমদ’ (ইচ্ছাসাদৃশ্য হত্যা) এর অন্তর্ভূক্ত। যার শাস্তি দিয়্যাত বা অর্থদণ্ড।
তবে বাংলাদেশে যেহেতু ইসলামি আদালত নেই। তাই প্রচলিত আইনেই তার বিচার দাবি করেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের অমানবিক শাস্তির পেছনে শিক্ষা বা উপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করাকেই যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু আসলেও কি শিক্ষার জন্য শাস্তির প্রয়োজন আছে? দেশের অন্যতম সেরা দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হকের কাছে সে প্রশ্নই করেছিলাম।
তিনি বলেন, ‘শাসন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে তা হতে হবে সঠিক পদ্ধতি ও মাত্রায়। সঠিক পদ্ধতি ও মাত্রায় শাসন প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর। আমাদের শিশু বিভাগগুলোতে অনেক সময় সঠিক পদ্ধতি ও মাত্রা ঠিক রেখে শাসন করা হয় না। সুতরাং এ শাসনকে আমরা প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর শাসন বলতে পারি না।’
মাওলানা মাহফুজুল হকের মতে, ‘প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর শাসন হলো যার আগে শিক্ষক দোয়া ও ইস্তেগফার পড়ে নিবেন, ব্যক্তিগত রাগ ও ক্ষোভের উর্ধ্বে উঠে শিক্ষক হিসেবে তার মাত্রা নির্ধারণ করবেন, শরিয়তের সীমারেখা মনে রেখে শাসন করবেন।’
তিনি মনে করেন, ‘শিশুশ্রেণিতে যারা শিক্ষকতা করছেন তাদের শাসন ও শাস্তিদানে শরিয়তের বিধান, শিক্ষাদান পদ্ধতি ও শিশুর সঠিক বিকাশ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এজন্য এ ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।’
শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে এমন দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
মাদকাসক্তদের নিয়ে আর চিন্তা নয়, আছে হলিকেয়ার
এ ক্ষেত্রে মুফতি এনামুল হাসান মনে করেন, শুধু প্রশিক্ষণ নয়; বরং শিক্ষকতার পূর্বে শিক্ষকদের পৃথক তরবিয়্যাতের প্রয়োজন আছে। আমাদের শিক্ষা কারিকুলামের শেষভাগে শিক্ষকতা, শিক্ষকের গুণাবলী ও তাদের জন্য করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে বিশেষ কোর্স থাকা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোর সর্ববৃহৎ অভিভাবক প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড’ বেফাক। শিক্ষকদের মান উন্নয়নে বেফাকের কি আয়োজন রয়েছে তা জানতে যোগাযোগ করেছিলাম বেফাক মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘বেফাক প্রতিবছর নিয়মতান্ত্রিকভাবে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা এখনও সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি তা সম্প্রসারণের।’
শিশু নির্যাতন রোধ করতে বেফাকের নির্দেশনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুনির্যানের বিরুদ্ধে কঠোর আইন করেছে। বেত নিষিদ্ধ করেছে। আমরা সরকারের এ আইনকে অনুসরণ করতে বলি আমাদের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
আমি মনে করি, সরকারি আইনের আনুগত্যই যথেষ্ট। সাথে সাথে আমরা বার্ষিক পর্যবেক্ষণের সময় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চারিত্রিক বিষয়েও খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করি।’
আমরা বলি, শারীরিক শাস্তির বিকল্প কিছু অনুসরণ করবেন। প্রয়োজনে মাদরাসা থেকে অব্যহতি দিয়ে দিবেন। তবুও শিশুর উপর নির্যাতন করবেন।
বেফাকের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকও বেফাকের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নেন। তিনি বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘শুধু বেফাক নয়; প্রত্যেক অঞ্চলের নেতৃত্বদানকারী বড় বড় প্রতিষ্ঠান এবং কওমি মাদরাসাভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজস্ব আয়োজনে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় সভা করতে পারে।’
শুধু প্রশিক্ষণের অভাব নয়, বরং মাদরাসা পরিচালকদের পক্ষ থেকে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় পান নির্যাতনকারী শিক্ষকগণ। তারা শিক্ষকদের এমন অনৈতিক কাজ দেখেও দেখেন না; বরং কোনো অভিযোগ এলে তা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।
আপনার ছেলেকে ঢাকা আইডিয়াল মাদরাসা দিন
কোনো অভিভাবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসলে শিক্ষকের পক্ষ নেন এবং বাড়াবাড়ি করলে শিক্ষার্থীকে মাদরাসা থেকে অব্যহতি দেয়ার হুমকি দেন।
প্রতিবেদকের কাছে শেখ হাসিবুল হাসান নামের একজন মাদরাসা শিক্ষার্থীর অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, ‘আমার ছেলে কওমি মাদরাসায় নাজেরা বিভাগে পড়তো। সময় মতো ঘুম উঠতে না পারায় তার শ্রেণি শিক্ষক তাকে বেত দিয়ে আঘাত করে। এতে তার শরীরে রক্ত জমে যায়।
এ বিষয়ে মাদরাসা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি উল্টো আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, শিক্ষক কি খালি খালি পিটাইছে? আপনি আবার আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে আসছেন! পোলা মানুষ করতে চান? ভালো না লাগলে নিয়া যান।
হাসিবুল হাসান তার ছেলেকে মাদরাসা থেকে এনে স্কুলে ভর্তি করেছেন। শুধু হাসিবুল হাসান নয়; এ দেশের অসংখ্য অভিভাবক বেদম প্রহারের ভয়ে তাদের সন্তানদের হয়তো মাদরাসায় দেন নি অথবা রাখেন নি।
পরিচালকদের প্রশ্রয়, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহির অভাব যে কারণেই হোক না কেনো মাদরাসায় শিশুনির্যাতন বন্ধ হোক। মাদরাসা শিক্ষার ভবিষ্যতের জন্যই শিশুর জন্য তাকে নিরাপদ করে তুলতে হবে। নতুবা হাসিবুল হাসানদের মিছিল দিন দিন ভারি হতে থাকবে।
আরও পড়ুন: বেফাকের কমিটি নিয়ে ময়মনসিংহ আলেমদের নতুন কর্মসূচি; সমাধানের আশ্বাস
আরআর