ইশতিয়াক সিদ্দিকী
হাটহাজারী প্রতিনিধি
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মোবাইল বিষয়ক বক্তব্য আমলে নিয়ে ছাত্রদের দুই বস্তা মোবাইল পুড়িয়ে ফেলেছে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী।
গত রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছাত্রদের উপস্থিতে মাদরাসার সম্মুখ মাঠে প্রায় দু'বস্তা মোবাইল আগুনে জ্বালিয়ে দেয় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সর্বমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ উদ্যোগকে কেউ স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ছাত্রদের সময় ও মনোযোগ নষ্ট হওয়া থেকে বিরত রাখতে এ এক যুগান্তকারী কাজ করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে কেউ কেউ সমালোচনাও করছেন।
তাদের বক্তব্য, এসব না পুড়িয়ে অন্যভাবেও শাস্তি দেয়া যেত। এতে সম্পদ রক্ষা হতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের ভাষ্য- বারবার সতর্ক করার পরও যখন কাজ হচ্ছিল তখন কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া উপায় ছিল না।
কিছু আলোচনা-পর্যালোচনা করা যাক
মোবাইল প্রত্যেক ছাত্রের জন্যে ক্ষতিকারক - একথা প্রত্যেক অভিভাবক, শিক্ষক ও জ্ঞানীরা বলে থাকেন। আর মোবাইল যদি এন্ড্রয়েড হয় তাহলে তো আরো ভয়ঙ্কর মনে করা হয়। কারণ তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ছাত্রদের জ্ঞান থেকে দূরে রাখার অন্যতম ক্ষতিকারক বস্তু মোবাইল।
এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোবাইল ব্যবহারে কড়াকড়ি করা হয়।
মোবাইল ব্যবহারে দারুল উলুম দেওবন্দের নিয়ম কী?
কওমী মাদরাসাগুরো যার অনুসরণ করে চলে সেটি হলো ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ। এখানে ছাত্রদের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। দেওবন্দ পড়ুয়া বাঙালি ছাত্র তাওহীদ আদনান জানিয়েছে, দারুল উলূম দেওবন্দের নিয়ম হলো, কেউ কোনো মাল্টিমিডিয়া (ক্যামেরা, মিউজিক, রেডিও সম্বলিত) মোবাইল সেট ব্যবহার করতে পারবে না।
হ্যা! ক্লাস টাইম ব্যতীত নির্ধারিত সময় নরমাল মোবাইল ব্যবহার করতে পারবে। কারো কাছে কোনো এন্ড্রয়েড ফোন ধরা খেলে, প্রথমবার মোবাইল বাজেয়াপ্ত এবং সাথেসাথে তার আবাসিক সব সুবিধা (ফ্রি খানা, থাকা, ভাতা ইত্যাদি) বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয়বার ধরা খেলে বহিষ্কার করার নিয়ম রয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য কওমী মাদরাসার ভূমিকা
বাংলাদেশেও মুফতি আবদুর রহমান রহ. প্রতিষ্ঠিত বসুন্ধরা মাদরাসা ও তার অাওতাধীন মাদরাসাগুলোতে মোবাইল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্রদের কাছে শুধু মোবাইল নয়, যেকোন ইলেক্ট্রিক ডিভাইস পেলে সাথে সাথে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এমনকি কিছুদিন আগে বসুন্ধরা আওতাধীন চট্টগ্রামের শোলকবহর মাদরাসায় স্বয়ং শিক্ষক বাবা তার ছেলে মারাসায় মোবাইল রাখার অপরাধে সন্তানকে বহিষ্কার করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়াও ঢালকানগর, জামিয়া ইবরাহীমিয়া মাহমুদনগর বাড্ডা, বাইতুচ্ছালাম এয়ারপোর্ট মাদরাসাসহ অনেক মাদরাসায় মোবাইল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
স্কুল-কলেজে মোবাইলের বিধান
ছাত্ররাজনীতি ও মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। নগর ভবনের কেবি আবদুস সাত্তার মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এ নীতিমালার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন। এটি চলতি বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে তিনি জানান। (দৈনিক যুগান্তর ৪ঠা এপ্রিল ২০১৭)
এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেসবুক-মোবাইল নিষিদ্ধের দাবি করেছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী বলেছেন, শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়ায় মনোনিবেশ করতে হবে। এখনকার স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। কারণ ছাত্র-ছাত্রীরা মোবাইলে ও ফেসবুকে প্রেমালাপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
তাই ছাত্র-ছাত্রীদের প্রেমালাপ থেকে বিরত রাখতে ফেইসবুক ও মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। (দৈনিকযুগান্তর ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪)
এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে দেখা যায়, এক স্কুলমাঠে শিক্ষার্থীর সামনে অসংখ্য মোবাইল হাতুড়ি দিয়ে ভাঙা হচ্ছে। এমন কড়াকড়ি অনেক স্কুলে।
ব্রিটেনের স্কুল নিয়ে উইকিপিডিয়া যা জানালো
In the United Kingdom, no schools banned mobile phones in 2001. However, by 2007, 50% of the schools had banned these devices, and by 2012, this number had increased to 98%.
এমনকি নরওয়ের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মুঠোফোন না চালালে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে।
মোবাইল বিষয়ে পোপ ফ্রান্সিস
গত ২ ডিসেম্বর বিকালে রাজধানীর নটরডেম কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত যুব সমাবেশে ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস তরুণ সমাজকে মোবাইল ব্যবহারে সতর্কত করেন।
পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ‘তোমার আশেপাশে যারা আছে তাদের প্রতি অমনোযোগী হয়ে মোবাইল ফোনে সারাদিন খেলায় মত্ত থেকে সময় কাটিয়ে দিও না। ইতিহাস আমাদের থেকে শুরু হয়নি।
বরং আমরা সুপ্রাচীন এক প্রবাহমানতার অংশ। সেই বাস্তবতা আমাদের চেয়েও সমৃদ্ধ। তোমাদের বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানির সঙ্গে সবসময় আলাপ করবে।’
আল্লামা আহমদ শফীর সেই বক্তব্য
গত ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে আয়োজিত হেফাজতের সম্মেলনে হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক বলেছিলেন, ‘আপনারা ছেলে মেয়েদের মোবাইল দিবেন না। মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য ইয়াহুদিরা মোবাইল নামক এক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘এই মোবাইল ফোন আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে শেষ করে দিয়েছে। আপনারা ছেলে-মেয়েকে মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখুন।’
সাবস্ক্রাইব করুন আওয়ার ইসলাম ইউটিউব চ্যানেল
হাটহাজারী মাদরাসা কর্তৃপক্ষের মোবাইল পোড়ানোর ঘটনা আল্লামা আহমদ শফীর সেই বক্তব্যে আমল করে এক যুগান্তকারী কাজ করেছে মনে করছে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। কারণ এর ফলে হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদরাসাকে অনুসরণ করবে।
তথ্য-প্রযুক্তি জানতে যা করা যেতে পারে
মোবাইল নিষিদ্ধ করলে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা তথ্য-প্রযুক্তি থেকে পিছেয়ে থাকবে এমন আশংকা অনেকের। এ বিষয়ে কিছু প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
ক. পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে নরমাল মোবাইল ব্যবহারে অনুমতি দেয়া/ মাদরাসা কর্তৃক মোবাইল বুথ ব্যবস্থা করা।
খ. মাদরাসা ক্যাম্পাসে নির্দিষ্ট সময়ে কম্পিউটার শেখার ব্যবস্থা করা।
গ. দেশ-বিদেশের খবরা-খবর জানতে মাদরাস ক্যাম্পাসে নির্দিষ্ট সময়ে পত্রিকাপাঠ ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা চালু করা।
আশা করা যায় এর মাধ্যমে বর্তমান সঙ্কটময় এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
চরমোনাই মাহফিলে যোগ দিতে ঢাকায় দেওবন্দের ৪ শায়খ