আওয়ার ইসলাম
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত মূল চক্রের সন্ধান করতে গিয়ে 'টপটেন' নামে একটি বিশেষ গ্রুপের খোঁজ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এই গ্রুপ থেকেই কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন পৌঁছাত।
গোয়েন্দারা মনে করছেন- টপটেন গ্রুপের সদস্যদের গ্রেফতার করা গেলে প্রশ্ন ফাঁসের মূল উৎস শনাক্ত করা যাবে। এদিকে প্রশ্ন ফাঁসে সরাসরি জড়িত থাকতে পারে, এমন সন্দেহভাজন ছয়জনের একটি গ্রুপকে এরই মধ্যে শনাক্ত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের ধরতেও গোয়েন্দা জাল পাতা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই ওই ছয়জনের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চান না গোয়েন্দারা। পুলিশ-র্যাবের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ফেসবুক, ইমো, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টপটেন নামের গ্রুপ খুলে প্রশ্নপত্র বিক্রি করে আসছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। জড়িতদের গ্রেফতারে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ- কিছুদিন ধরে এমন অভিযোগের পর মূল অপরাধীদের গ্রেফতারে মনোযোগী হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও মনে করছেন- আইসিটি বিভাগ, মাঠ প্রশাসন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সময় মতো তৎপর হলে প্রশ্ন ফাঁস অনেক আগেই ভালোভাবে সামাল দেওয়া যেত।
পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মনে করেন, এসএসসির প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের গ্রেফতার করা না গেলে দুই ধরনের ঝুঁকি থাকবে। এক- আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার সময়ও একই চক্র একইভাবে প্রশ্ন ফাঁস করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারে। দুই- প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতাদের ধরা না গেলে কী প্রক্রিয়ায় কীভাবে কার মাধ্যমে কারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন তা অজানাই থাকবে। তবে এরই
মধ্যে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, দুইভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। একটি চক্র পরীক্ষার অনেক আগেই প্রশ্ন ফাঁস করে দুই থেকে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে তা ছড়িয়ে দেয়। আবার কয়েকটি চক্র পরীক্ষার দুই থেকে তিন ঘণ্টা আগেই প্রশ্ন ফাঁস করে। তারা মাত্র ২০০-৩০০ টাকায় প্রশ্ন পৌঁছে দিয়ে বিকাশে অর্থ নেয়।
চলতি বছর এসএসসির প্রশ্ন ফাঁস অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। তাই বাধ্য হয়ে সরকার পাবলিক পরীক্ষার বর্তমান পদ্ধতি বদলে ফেলারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামীতে ছাপানো প্রশ্নে পরীক্ষা না নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের পরীক্ষার জন্য তৈরি করা হবে প্রশ্নব্যাংক। তুলে দেওয়া হচ্ছে এমসিকিউ পদ্ধতি।
সোমবার র্যাব রাজধানীর উত্তরখান ও গাজীপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ক্যামব্রিজ হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তানভীর হোসেনসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। অন্যরা হলো- একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সজীব মিয়া, উত্তরখানের সৃজনশীল কোচিংয়ের শিক্ষক এনামুল হক ও মো. ইব্রাহীম এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের ছাত্র হাসানুর রহমান। অনলাইনে হাসানুর 'রকি ভাই' নামে পরিচিত ছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদে পাঁচজনই স্বীকার করেছেন, টপটেন নামে একটি গ্রুপ থেকেই তারা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পেতেন। বিকাশের মাধ্যমে টপটেন গ্রুপ পরিচালনাকারীদের অর্থ দেওয়া হতো। প্রতিটি প্রশ্ন সেটের জন্য পরিশোধ করতে হতো দুই থেকে তিন হাজার টাকা।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সমকালকে বলেন, যাদের কাছ থেকে গ্রেফতার পাঁচজন প্রশ্ন পেতেন তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন ফাঁসের মূল রুট শনাক্ত করতে গোয়েন্দারা কাজ করছেন।
র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, টপটেন গ্রুপ থেকেই ক্যামব্রিজ হাইস্কুলের শিক্ষকসহ অন্যরা প্রশ্ন পেতেন। এই গ্রুপের সঙ্গে জড়িতদের ধরা গেলে আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। শিক্ষকসহ পাঁচজনকে গ্রেফতারের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত র্যাব করতে পারে বলেও জানান তিনি।
চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় বিভিন্ন এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত অন্তত ১৪০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তবে তাদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা নন। গ্রেফতার অধিকাংশই শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক। অভিযোগ রয়েছে, প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতাদের গ্রেফতারে এখনও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা নেই।
অতীতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের ধরতে তৎপর হলেও এবার তা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে বিভিন্ন সময় চ্যালেঞ্জ নিয়েই মাঠে দেখা যেত গোয়েন্দাদের। তবে এবার গোয়েন্দাদের মধ্যে শুরু থেকে শৈথিল্য দেখা যায়। প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্র ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও কোনো সুফল মেলেনি।
এ বিষয়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতাদের ধরতে পুলিশ কাজ শুরু করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে এর ফলও দেখা যাবে। পুলিশ এও মনে করছে, শুধু গ্রেফতার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাবে না। ফাঁস ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে মূল ভূমিকা রাখতে হবে। এ ছাড়া অভিভাবক ও সচেতন নাগরিকদের প্রশ্ন ফাঁস রোধে এগিয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন ফাঁসের আলামত পেলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ নাগরিক যেন সে তথ্য পুলিশকে দেন, তেমন মূল্যবোধের পরিচয় দিতে হবে।
র্যাব সূত্র জানায়, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত গ্রুপগুলোর 'অ্যাডমিন' শনাক্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে 'মিসাইল ও আইসিটি' গ্রুপ থেকে প্রশ্ন পেয়ে তা ফাঁস করেছেন- এমন একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। ওই দুই গ্রুপের নেপথ্যে কারা রয়েছেন, তা এখনও জানা যায়নি।
সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের অভিযানে গ্রেফতার হাসানুর রহমান প্রায় চার বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। প্রশ্নপত্র বিক্রি করে টাকা আয় ক্যামব্রিজের গ্রেফতার শিক্ষকদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না।
অসৎ উপায়ে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ভালো ফল অর্জন করানোই ছিল তাদের প্রধান টার্গেট। যাতে প্রতিষ্ঠানের সুনাম হয়। উত্তরখানের ক্যামব্রিজ হাইস্কুলটি এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি। তারা মূলত অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করান।
গোয়েন্দারা মনে করছেন, রাজধানীসহ সারাদেশে এ ধরনের আরও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানকার শিক্ষকরাই মূলত ফাঁস করা প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এ ছাড়া আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বলেও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মঙ্গলবার সমকালকে জানান, তারা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান শুরু করেছেন। তিনি মনে করেন, এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যেভাবে প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে তা সমুদ্রের সঙ্গে তুলনীয়। সমুদ্রে হাতড়ে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। নিরবচ্ছিন্নভাবে কষ্টসাধ্য এ কাজ শেষ করে প্রশ্ন ফাঁসের শেকড়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। আপাতত তারা কোনো চুনোপুঁটি ধরতে চান না।
পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস করা প্রশ্ন ছড়ানো হয়েছে এমন ১২টি সুনির্দিষ্ট গ্রুপ সম্পর্কে তারা বিস্তারিত তথ্য পেয়েছেন। এর বাইরে আরও কিছু ভুয়া গ্রুপও রয়েছে; যারা প্রশ্ন দেওয়ার কথা বলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মো. শহীদুল্লাহ সমকালকে বলেন, শুধু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আটক করতে চাই না। কারণ, তাদের সামনে প্রশ্ন থাকলে ভালো ফলাফলের জন্য তারা সেই পেজে ঢুকতেই পারে। তবে যারা তাদের প্রলুব্ধ করছে তারাই মূল অপরাধী। শনাক্ত করে সেই রাঘববোয়ালদের ধরার চেষ্টা চলছে। আশা করি, শিগগির তারা ধরা পড়বে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আগামী শনিবার শেষ হবে এবারের এসএসসি পরীক্ষা। আজ এবং শনিবার তিন বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ওই তিন বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো না গেলেও গোয়েন্দাদের মূল লক্ষ্য আসল অপরাধীদের ধরা। সেটা করতে না পারলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা ও একাগ্রতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠবে। সমকাল।