মুফতি হেলাল উদ্দীণ হাবিবী
মহান আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত আদর করে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য দিয়ে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। দান করেছেন অফুরন্ত সব নেয়ামত। প্রতিক্ষণে আমরা তাঁর হাজারো নেয়ামত ভোগ করছি। তাঁর দাক্ষিণ্য আনুকল্য ও অনুগ্রহ ছাড়া কারো পক্ষে এক মুহূর্ত বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাঁর নেয়ামতের কোন সীমা পরিসীমা নেই। কেউ কোনোদিন গণনা করেও শেষ করতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, তোমরা যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে তা গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ। (সুরা ইবরাহীম, আয়াতঃ ৩৪) মহান স্রষ্টা মানবজাতিকে সৃষ্টি করে বিভিন্ন শ্রেণী, গোত্র ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেছেন। দান করেছেন বৈচিত্রময় ভাষা এবং বর্ণ। আর এর মধ্যে রয়েছে প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার বিশেষ রহস্য।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’আলা মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ করেন, হে মানব সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক খোদাভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞাত, সব কিছুর খবর রাখেন। (সুরা হুজরাত, আয়াত: ১৩)
আল্লাহ তা’আলার বানী, তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সুরা আর রূম, আয়াত: ২২) দয়াময় প্রভূর অগণিত নেয়ামত থেকে অন্যতম একটি নেয়ামত হলো মাতৃভাষা। মহান আল্লাহ তা’আলা হেদায়াতের পতাকাবাহী জামাত সকল নবী-রাসুলকে মাতৃভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন।
‘মাতৃভাষা’ শব্দের সরল অর্থ হচ্ছে, মায়ের ভাষা। হযরত আদম আ. ও হযরত হাওয়া আ. জান্নাত থেকে দুনিয়াতে এসে সর্বপ্রথম আরবী ভাষায় কথা বলতেন এবং তাদের সন্তানেরাও আরবী ভাষায় কথা বলতেন। সে হিসেবে মানবজাতির সর্বপ্রথম মাতৃভাষা ছিল আরবী। তবে সে সময়ে ভাষা শুধু ধ্বনি বা আওয়াজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর কোন লিখিত রূপ ছিল না। অতঃপর হযরত আদম আ. এর নিকটবর্তী নবী হযরত ইদরিস আ. সর্বপ্রথম বর্ণ আবিষ্কার করেন। কালের বিবর্তনে পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষা আবিষ্কার হয়।
বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভাষা প্রচলিত আছে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান চতুর্থ। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়ীয় প্রাকৃত অপভ্রংশ হতে বাংলা ভাষা উৎপত্তি লাভ করেছে। আর ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, মাগধী প্রাকৃত-অপভ্রংশ হতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি।
এই পৃথিবীতে এক লক্ষ মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রাসুল আগমন করেছেন। তাঁরা সকলেই নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতেন। তাদের প্রতি নাযিলকৃত আসমানী কিতাব এবং ছহিফাসমূহ তাঁদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তাঁরা মাতৃভাষায় সেগুলো প্রচার করতেন।
যেমন হযরত মুসা আ. এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল হিব্রু। তাই ‘তাওরাত’ কিতাব হিব্রু ভাষায় নাযিল হয়। হযরত দাউদ আ. এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইউনানী। তাই ইউনানী ভাষায় ‘যাবুর’ কিতাব অবতীর্ণ হয়। হযরত ঈসা আ. এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল সুরিয়ানী। তাই সুরিয়ানী ভাষাতেই ‘ইঞ্জিল’ কিতাব নাযিল হয়। অধিকন্তু সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর মাতৃভাষা ছিলো আরবী। তাই ‘মহাগ্রন্থ আল-কোরআন’ তাঁর মাতৃভাষায়-ই অবতীর্ণ হয়।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, আমি সকল নবী-রাসুলকেই তাদের স্বজাতীর ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন আর যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।(সুরা ইবরাহীম, আয়াতঃ ০৪) যদিও সকল নবী-রাসুলের ভাষা এক ও অভিন্ন ছিলো না। তবে তাঁরা প্রত্যেকেই সুন্দর, মার্জিত, রুচিসম্মত ও যুগের সর্বোচ্চ সাহিত্যপূর্ণ ভাষা দিয়ে মনের ভাব ব্যক্ত করতেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী। এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সা. এর খিদমতে হাযির হলেন এবং বাইরে থেকে সালাম আরয করে বললেন, ‘আআলিজু?’ মহানবী সা. খাদেমকে বললেন, যাও, তাকে অনুমতি চাওয়ার নিয়ম শিক্ষা দাও যে, বলো, আসÑসালামু আলাইকুম, আÑআদখুলু? সাহাবী শিক্ষা পেয়ে তাই বললেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে
অনুমতি দিলেন। (আবূ দাউদ) লক্ষণীয় ব্যাপার যে, প্রবেশ করা অর্থে দু’টো শব্দ-ই সমার্থক। কিন্তু প্রবেশের অনুমতি চাওয়ার ক্ষেত্রে ‘উলূজ’ অপেক্ষা ‘দুখূল’ উচ্চাঙ্গ সাহিত্যপূর্ণ শব্দ। তাই মহানবী (সা.) সাহাবীকে এ ব্যাপারে পথনির্দেশ করলেন। অন্যান্য নবীদের মত আমাদের প্রিয়নবী (সা.) বিশেষ কোনো গোত্র, জাতি বা সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হননি। বরং তিনি সমগ্র জাহানের সকল বর্ণ ও ভাষার মানুষের পথপদর্শক। মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, আমি আপনাকে উভয় জাহানের জন্য রহ্ধসঢ়;মত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া, আয়াতঃ ১০৭) আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (সূরা সাবা, আয়াতঃ ২৮) তথাপি আল্লাহ তা’আলা প্রিয়নবী (সা.)Ñকে মহাগ্রন্থ আলÑকোরআন মাতৃভাষায়েই দান করেছেন।
মুফ্ধসঢ়;তি শফি (রহ.) তাফ্ধসঢ়;সিরে মা’আরেফুল কোরআনে লিখেন, ‘মহান আল্লাহ তা’আলা ইচ্ছে করলে সর্বজনবোধগম্য একটি ভাষায় নবী ও কিতাব পাঠাতে পারতেন’। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তা না করে মাতৃভাষায় তাঁর প্রিয়বন্ধু হযরত মুহাম্মদ (সা.)Ñকে প্রেরণ করেছেন এবং মহাগ্রন্থ আলÑকোরআন নাযিল করেছেন। এ থেকেই মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়। ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রিয়নবী (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, ও মনিষীগণ মাতৃভাষাকে ভালোবাসতেন এবং তাঁরা নিজ ভাষা সম্পর্কে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। বাংলা ভাষার বিকাশে মুসলিম মনিষী ও শাসকদের অবদান
অনস্বীকার্য।
১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট সকল ভ্রæকুটি অগ্রাহ্য করে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পাকিস্তান গণপরিষদে সর্বপথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে মায়ের ভাষার প্রতি আকুন্ঠ ভালোবাসার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মায়ের ভাষার প্রতি অবহেলা রেখে কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। মায়ের ভাষাকে মায়ের মতোই আপন মনে করতে হবে, ভালোবাসতে হবে হৃদয়ের গভীর থেকে। সুতরাং আমাদের মাতৃভাষা বাংলা সম্পর্কে ব্যাপক যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে চর্চা এবং গবেষণা করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। মায়ের ভাষার সুগন্ধি ছড়িয়ে পরুক বিশ্বময়। অবশেষে মাতৃভাষা নিয়ে আমার রচিত একটি ছড়া পাঠকদের খেদমতে উপস্থাপন
করলামঃ-
মাতৃভাষা বাংলা আমার
খোদার সেরা দান,
বাংলা ভাষা আমার ভাষা
বাংলা আমার প্রাণ।
বাংলা ভাষা মায়ের ভাষা
বাংলা আমার মান,
বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায়
করিসনে ভাই গান।
বাংলা ভাষা সবার ভাষা
বাংলা খোদার শান,
বাংলা ভাষার জন্যে মানুষ
জান করিল দান।
মুফ্ধসঢ়;তি হেলাল উদ্দীন হাবিবী
মুফাস্ধসঢ়;রিরে কুরআন ও ইসলামী গবেষক
খতিব, মাসজিদুল কুরআন জামে মসজিদ
কাজলা(ভাঙ্গাপ্রেস), যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
প্রিন্সিপাল, মারকাযুল উলূম আজিজিয়া মাদরাসা
কাজলা(ভাঙ্গাপ্রেস),যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
মোবাইলঃ ০১৯১১-৭৯৫৯১৬