সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
রাজধানীকে বলা হয় কোনো দেশের ‘মুখ’। কেননা, রাজধানীর চিত্র দেখেই বুঝতে পারা যায় দেশটি কতটা উন্নত। তাই রাজধানীকে সুন্দর করে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা উচিত। কিন্তু আমাদের রাজধানী যে দিন দিন বেহাল হয়ে পড়ছে।
পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএ’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে প্রথমে নেপাল, তারপর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান ও কঙ্গোর নাম ওঠে এসেছে। আর নির্মল বায়ুর দেশ হিসেবে প্রথমে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। এরপর রয়েছে বার্বাডোজ, জর্ডান, কানাডা ও ডেনমার্ক।
রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের জন্য এখন আলোচিত। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএ’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রতিবেদনটি ইপিএ গত ২৩ জানুয়ারি প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটি বিশ্বের ১৮০টি দেশ সামগ্রিকভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় কী ধরনের ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে একটি সূচক তৈরি করেছে। তাতে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯তম স্থানে নেমে এসেছে। ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম ওই সূচকটি তৈরি করা হয়েছিল, সে বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। অর্থাৎ গত এক যুগে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫৪ ধাপ নিচে নেমেছে। কী ভয়ঙ্কর বাস্তবতা! ১৮০তম স্থানে নেমে যেতে কি খুব সময় লাগবে?
পরিবেশ আইন অনুযায়ী, বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা ‘পিএম ২.৫’-এর মানমাত্রা হচ্ছে প্রতি কিউবিক মিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। ‘পিএম ১০’ বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মানমাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৫ সালে রাজধানীতে পিএম ২.৫-এর গড় ছিল ৮১ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৬ সালে ছিল ৭৬ মাইক্রোগ্রাম। পিএম ১০-এর গড় ২০১৫ সালে ১৪৮ মাইক্রোগ্রাম ও ২০১৬ সালে আরও বেড়ে হয়েছে ১৫৮ মাইক্রোগ্রাম।
প্রসঙ্গত, একটি আদর্শ রাজধানীর সুযোগ-সুবিধা কেমন, এ অভিজ্ঞতা ঢাকার মানুষের নেই বললেই চলে। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত সিটি করপোরেশনসহ যেসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ট্যাক্স নগরবাসী দিলেও তার বিপরীতে যে ন্যূনতম সেবা পাওয়ার কথা, তা প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
নগরবাসীর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার দায়িত্ব যে ওয়াসার, প্রতিষ্ঠানটি তা নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং তাদের সরবরাহকৃত পানি ময়লা-আবর্জনাপূর্ণ, ঘোলা ও দুর্গন্ধযুক্ত। রাজধানীর উন্নয়ন ও দেখভাল করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের দূরদৃষ্টির অভাব, অদক্ষতা, দুর্নীতি, ভূমিদস্যুদের নির্বিচার দখলদারিত্ব এবং ব্যাপক সমন্বয়হীনতার ফলই আজকের এই পরিণতি নয়?
আমাদের রাজধানী ঢাকা দেশটির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিকসহ সবকিছুরই প্রাণকেন্দ্র। তাই যত সমস্যাই থাকুক কেউ ঢাকা ছেড়ে যেতে চায় না। বরং প্রতিদিন এখানকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
সরকারি হিসেবে বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ লোক। বেসরকারি হিসেবে আরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের দিকে এ জনসংখ্যা দাঁড়াবে আড়াই কোটি। এই বিপুলসংখ্যক নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধার ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ডও নিশ্চিত করা যাচ্ছে কি?
যানজটের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ শহর। বলা হয়, যানজটই ঢাকাকে অচল ও স্থবির একটি শহরে পরিণত করেছে। শুধু যানজটে আটকা পড়ে ঢাকা শহরে প্রতিদিন মানুষের লাখ লাখ শ্রম ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
এই শ্রম ঘণ্টার মূল্যমান গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা। কারও কারও মতে আরও বেশি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে যদি শুধু যানজটের কারণে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান হয়, তবে উন্নয়নের চাকাটি সচল থাকবে কীভাবে?
ক্ষতিকর বিভিন্ন গ্যাস ও বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ধূলিকণার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ২৩তম। এই দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ যানবাহন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে ঢাকাকে টিকিয়ে রাখা সম্পূর্ণরূপেই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবর ও গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে জানতে পেরেছি, বর্তমানে ঢাকা শহরে শুধু গাড়ির ধোঁয়া থেকে বছরে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ টন সূক্ষ্ম বস্তুকণা (এসপিএম) বাতাসে মিশছে। এসব ভাসমান কণার আকার ১০ মাইক্রনের কম। যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাতাসে এসব সূক্ষ্ম বস্তুকণার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ হাজার ৯০০ টন।
এসব যানবাহন থেকে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ ধোঁয়া নির্গত হবে, এতে বাতাসে বেড়ে যাবে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি। বাড়বে ধূলিকণাও। এসব ধূলিকণার ৯৫ শতাংশের আকার হবে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার। আকারে ছোট হওয়ায় সহজেই মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করবে এসব ধূলিকণা। শ্বাস ও খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে এসব ধাতু মানবদেহে প্রবেশের ফলে তা রোগব্যাধি বাড়িয়ে তুলতে পারে। এসব ভারী ধাতু, গ্যাস ও ধূলিকণা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের বার্ষিক গড় সহনীয় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৮০ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু রাজধানীর মহাখালীতে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৩৪৯ মাইক্রোগ্রাম, ফার্মগেটে ৪৩৫, মগবাজারে ৪৮৯, কারওয়ান বাজারে ৩৫৭ ও সায়েন্স ল্যাবে ৪৩৮ মাইক্রোগ্রাম।
নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইডও রয়েছে সহনীয় মাত্রার অনেক উপরে। সহনীয় মাত্রা ১০০ মাইক্রোমিটার হলেও ঢাকার মহাখালীতে বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ ৩৭৬ মাইক্রোগ্রাম, ফার্মগেটে ৭৫২, মগবাজারে ৩৩৯ ও সায়েন্স ল্যাবে ১১৩ মাইক্রোগ্রাম।
সহনীয় মাত্রা ৫০০০ মাইক্রোগ্রাম হলেও মহাখালীতে কার্বন মনোঅক্সাইডের পরিমাণ ৫ হাজার ২১৯, ফার্মগেটে ৭ হাজার ৭৩০, মগবাজারে ৫ হাজার ৭২৬, কারওয়ান বাজারে ৫ হাজার ৩৪৩ ও সায়েন্স ল্যাবে ৫ হাজার ৭২৬ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে।
বর্তমানে ঢাকার সব স্থানে শব্দদূষণও গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বহুগুণ বেশি। শব্দদূষণের ৮০ শতাংশের জন্যই দায়ী যানবাহনের হর্ন। গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবেল হলেও বিভিন্ন হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা ১২০-এরও বেশি পাওয়া গেছে।
লগ স্কেলে পরিমাপযোগ্য শব্দ গ্রহণীয় মাত্রার বহুগুণ বেশি। এছাড়া প্রায় সব ক্ষেত্রেই দিন, সন্ধ্যা ও রাতের গড় শব্দের মাত্রা ১০০ ডেসিবেলের উপরে রয়েছে, যা গ্রহণীয় মানমাত্রার বহুগুণ বেশি।
ভবিষ্যতে রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল চালুসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতেও বাড়বে শব্দদূষণ। এভাবে চলতে থাকলে যানবাহন থেকে তৈরি হওয়া ধূলিকণা, বিষাক্ত গ্যাস ও শব্দদূষণে ঢাকা তখন বাসযোগ্য শহর থাকবে বলে মনে হয় না। এজন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন কি?
গণমাধ্যমে প্রকাশ, বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় সরকার নির্মল বায়ুর জন্য শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেই টাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের বহুতল ভবন, সড়কে উন্নত মানের ফুটওভার ব্রিজ, অনেক কর্মকর্তার বিদেশ সফর হয়েছে। কিন্তু সরকারি ওই তথ্য প্রমাণ করছে দূষণ কমেনি, বরং বেড়েছে। হায় স্বদেশ!
আমরা সুন্দর পরিবেশে, সুন্দরভাবে বাঁচার সুযোগ চাই। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিষয়টি সুবিবেচনা করবেন যেন।
লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
২০.০২.২০১৮