আতাউর রহমান খসরু
হজরত খান জাহান আলী রহ. কে আমরা চিনি একজন সুফি সাধক হিসেবে। বৃহত্তর খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে যিনি ইসলাম প্রচার করেছেন। বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন ষাটগম্বুজ মসজিদের নির্মাতা হজরত খান জাহান আলী রহ.।
তার বহুল প্রচারিত এ পরিচয়ের বাইরেও আরেকটি পরিচয় রয়েছে এবং সেটাই হলো তার আসল পরিচয়। তাহলো, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক ও নতুন সভ্যতার নির্মাতা।
হজরত খান আলী রহ. খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলের বনাঞ্চলকে আবাদযোগ্য করেন এবং নতুন সভ্যতার গোড়াপত্তন করেন। তার রাজধানী খলিফাতাবাদ ছাড়াও মুরালি, পৈগ্রাম ও বারো বাজারসহ একাধিক নগর গড়ে তোলেন তিনি।
মানুষের কল্যাণে একাধিক রাস্তা, জলাশয় ও স্থাপনা নির্মাণ করেন।
ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত, হজরত খান জাহান আলী রহ.যতো বড় পির ও সাধক ছিলেন তার চেয়ে বড় শাসক ও সভ্যতার রূপকার ছিলেন। খুলনা অঞ্চলে তার আগমন হয়েছিলো একজন সেনাপতি হিসেবে।
পরবর্তীতে তিনি একজন প্রাশসক ও শাসক হন। সব শেষে তিনি মন দেন আধ্যাত্মিক সাধনায়।
হজরত খান জাহান আলী রহ. এর কবরে উৎকীর্ণ ফলকে তার নামের সঙ্গে উলুঘ খান ও খান-ই-আজম যুক্ত রয়েছে। এ থেকে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন, তিনি তুর্কি বশোদ্ভূত। যদিও কারো কারো ধারণা তার পরিবার বাগদাদ থেকে ভারতবর্ষে আগমন করেন।
তার পরিবার ও পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। কিছু অসমর্থিত সূত্রে তার বাবার নাম আকবর খান ও মায়ের নাম আম্বিয়া উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে তার জীবনীকারগণ এ ব্যাপারে একমত যে তিনি চৌদ্দশো খ্রিষ্টাব্দের শেষ ভাগে (১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে) দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন।
দিল্লির বিখ্যাত আলেম শাহ নেয়ামতুল্লাহ রহ. এর কাছে কুরআন, সুন্নাহ, ফিকহশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এছাড়াও দিল্লির বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছে দর্শন ও স্থাপত্য বিদ্যা অর্জন করেন।
পরবর্তী জীবনে তার নির্মিত স্থাপত্যে যার ছাপ স্পষ্ট। ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুর লং দিল্লি আক্রমণ করলে তার পরিবার বাংলা অঞ্চলে চলে আসেন।
একুশে বইমেলার সব বই দেখতে ও কিনতে ক্লিক করুন
হজরত খান জাহান আলী রহ. ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনা বাহিনীতে সৈনিক পদে কর্মজীবন শুরু করেন। অতি অল্প সময়ে তিনি সেনাপতি এবং ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে জৈনপুর প্রদেশের গভর্নর নির্বাচিত হন।
তার বাংলায় আগমন নিয়েও রয়েছে নানা উপাখ্যান। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন, তিনি দিল্লির তুঘলকি সুলতানদের নির্দেশে বাংলা অঞ্চল জয় করেন।
আবার কেউ কেউ বলেন, গৌড়ের বিশিষ্ট বুযুর্গ হজরত নূর-ই-কুতুব-উল আলম রহ. এর অনুরোধে জৈনপুরের সুলতান ইবরাহিম শর্কি বিশ্বাসঘাতক রাজা গণেশকে শায়েস্তা করতে তাকে প্রেরণ করেন।
১৪০০-১৪১১ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুরের রাজা গণেশ গৌড়ের সুলতান সাইফুদ্দিন হামজা শাহকে পরাজিত করে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা ও মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালালে নূর-ই-কুতুব-উল আলম রহ. এ অনুরোধ করেন।
এ বর্ণনা মতে খান জাহান আলীর মূল নাম শের খান এবং তিনি রাজা গণেশের বিরুদ্ধে দুইবার অভিযান পরিচালনা করেন। সুলতান ইবরাহিম শর্কি শের খানের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে খান-ই-জাহান উপাধি দেন।
বাংলা অঞ্চলে তার আগমন যে উপলক্ষ্যেই হোক না কেনো তিনি এ অঞ্চলে এসে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
ধারণা করা হয়, প্রথমে তিনি দিল্লির সুলতান বা গৌড়ের সুলতানের প্রতিনিধিত্ব করলেও পরবর্তীতে স্বাধীনভাবে শাসন কাজ পরিচালনা করেন। প্রায় ৪০ বছর তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন।
তার শাসিত অঞ্চলের মূলকেন্দ্র ছিলো খলিফাতাবাদ। খুলনা-বাগেরহাটের ভৈরব নদী থেকে নড়াইলের উত্তরে নলদি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তার রাজ্য।
প্রত্নতাত্ত্বিকগণ বর্তমান বাগেরহাট শহরের সাথে ভৈরব নদীর তীরে প্রাচীন খলিফাতাবাদ নগরকে শনাক্ত করেছেন।
ধারণা করা হয়, সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুহ শাহ (১৪৩৫-৩৬ ও ১৪৫৯-৬০ খ্রি.) আমলে খান জাহান আলীর হজরত খান জাহান আলী রহ. এ শহর গড়ে তোলেন।
ষোল শতকে তৈরি ডি. ব্যারস, ব্লাইভ এবং ভেন ডেন ব্রুকের পর্তুগিজ মানচিত্রে শহরটিকে ‘কুইপাটাভাজ’ -যা খলিফতাবাদের বিকৃত উচ্চারণ- নামে দেখানো হয়েছে।
বর্তমানে বাগেরহাটের চারদিকের এলাকা আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত হাওয়েলি খলিফতাবাদ বা উপ-শাসকের আবাসস্থল নামে পরিচিত ছিল। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে খুলনা-যশোর অঞ্চলকে এ নামেই উল্লেখ করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটনের ‘দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ গ্রন্থে হজরত খান জাহান আলী রহ. অবদান তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘এটা পরিষ্কার যে খান জাহান একজন দক্ষ নেতা ছিলেন।
ঘন জঙ্গলপূর্ণ একটি এলাকাকে ধান চাষের জমিতে পরিণত করতে উন্নত সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিপুল লোকবলের প্রয়োজন। লোনা পানিকে দূরে রাখতে নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করতে হয়েছে। বন পরিষ্কার করতে হয়েছে। পানি সরবরাহ ও সংরক্ষণের জন্য পুকুর খনন করতে হয়েছে। শ্রমিকদের আবাস নির্মাণ করতে হয়েছে।
এখানেই শুয়ে আছেন হজরত খান জাহান আলী
এসব কাজ শেষ করার পরে দ্রুত ধান চাষ শুরু করতে হয়েছে, নতুবা ফের জঙ্গল গজিয়ে যেত। এসব কাজ ছিল অত্যন্ত দুরূহ, কারণ ছিল জ্বর এবং বাঘের আক্রমণের ভয়। ’
হজরত খান জাহান আলী রহ. তার শাসিত অঞ্চলে যেসব স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন তার অধিকাংশই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। বাগেরহাটকে কেন্দ্র করে ৫০টির বেশি স্থাপনা তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন।
স্থানীয় মৌখিক ইতিহাসে বলা হয়, খান জাহান ৩৬০টি মসজিদ এবং অনেকগুলো বড় দীঘি খনন করিয়েছিলেন। যশোর শহর থেকে ১০ মাইল উত্তরে বারোবাজারে ১২৬টি দীঘি খনন করেছিলেন।
সেনাপতি ও শাসক হিসেবে তার আগমণ ঘটলেও ক্রমেই হয়ে ওঠেন জননায়ক। উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘বাঙালীর ধর্ম ও সমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘খান জাহান আলি বাংলার এক গাজি। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি যশোহর ও খুলনা জয় করেন। তিনি যোদ্ধা হলেও বাগেরহাট অঞ্চলে সাধকের জীবন যাপন করতেন।
তাঁর বহু শিষ্য ছিল। বহু হিন্দুকে তিনি ইসলামে দীক্ষিত করেন। তাঁর প্রধান মুরীদ শেখ মুহাম্মদ তাহির, পীর আলি নামে পরিচিত। তিনি আগে ব্রাহ্মণ ছিলেন।’
এ থেকে বোঝা যায় তিনি যোদ্ধা হিসেবে আগমন করলেও এ অঞ্চল তিনি তার চারিত্রিক মাধুর্য, উন্নয়ন ও অবদানের মাধ্যমেই জয় করেছিলেন।
এ অঞ্চল জয়ে তাকে উল্লেখযোগ্য কোনো বাধারও সম্মুখীন হতে হয় নি। তাই তিনি তার সঙ্গে আনা বিপুল সংখ্যক সৈনিককে (প্রথমে ৬০ হাজার। বর্ধিত হয়ে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ পর্যন্ত হয়) তিনি উন্নয়নমূলক কাজে লাগিয়ে দেন।
আধুনিককালের সেনা বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর যেমন দেশের উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করছে।
সতীশচন্দ্র মিত্র রচিত ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে এ বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘খাঁ জাহান আলি একজন অদ্ভুতকর্মা পুরুষ ছিলেন।
লোকে বলে খাঁ জাহানের ষাটহাজার সৈন্য ছিল, উহাদের অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের মত একখানি বাজে অস্ত্র ছিল কোদাল। যুদ্ধবিগ্রহ সব সময়ে চলিত না, আবশ্যকও হইত না, লোকে পাঠান সৈন্য দেখিলে বশ্যতা স্বীকার করিত।
বিশেষত লোকে খাঁ জাহানের জন-হিতৈষণায় মোহিত হইয়া তাঁহাকে ভক্তি করিত। সুতরাং সৈন্যদিগকে অনেক সময় নিষ্কর্মা থাকিতে হইত; খাঁ জাহান তাহাদিগের হস্তে কোদাল দিয়া কর্ম দিয়াছিলেন।
যুদ্ধ বাধিলে সৈন্যেরা যুদ্ধ করিত, নতুবা কোদাল কেহ কাড়িয়া লইত না, অবাধে রাস্তা নির্মাণ ও পুষ্করণী খনন করিতে করিতে দেশময় পুণ্যকীর্তি রাখিয়া সৈন্যদল অগ্রসর হইত। এই প্রণালী একটি শিক্ষার বিষয়; এমনভাবে দেশের ও দশের স্থায়ী উপকারের উপায় আর নাই।’
খান জাহান আলী রহ. মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরসূরীর অভাবে তার স্বাধীন শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পরে। মুসলিম সুলতানদের কাছেও নিম্ন জলা ও জঙ্গল ভূমি গুরুত্ব হারায়।
ব্রিটিশ সরকার বাগেরহাট একজন ম্যাজিস্ট্রেটের শাসনাধীন ছিলো। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট রেজিওনাল্ড স্টার্নডেল ছিলেন স্থানীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহী ব্যক্তি।
তিনি বাগেরহাটের স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন এবং বেশকিছু জলরঙের চিত্রও আঁকেন। তাঁর বর্ণনায় ছিল, খান জাহান আলীর সমাধি ঠিকঠাক থাকলেও আশপাশের অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ঐতিহাসিকদের অনুসন্ধানে হজরত খান জাহান আলী রহ. এর যেসব কীর্তির সন্ধান পাওয়া যায় তাহলো, মুরলিকসবা, পয়গ্রাম কসবা ও খলিফাতাবাদ নগর।
ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগেনীর এক গম্বুজ মসজিদ, চুনাখোলা এক গম্বুজ মসজিদ, খান জাহানের বসতবাটী রণবিজয়পুর মসজিদ, খান জাহানের মাযার, পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের মাযার, দরগা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, সিঙ্গারা মসজিদ, মসজিদ কুড় মসজিদ, তিন গম্বুজ মসজিদ, বাবুর্চি খানা, খাঞ্জালীর জাঙ্গাল, ঠাকুর দীঘি, ঘোড়া দীঘি, করে দীঘি ইত্যাদি।
হজরত খান জাহান আলী রহ. জীবনের শেষভাগে আধ্যাত্মিক সাধনা ও ইসলাম প্রচারে মনোযোগী হন। এ সময় তিনি সাধকের জীবনযাপন শুরু করেন।
ড. এমএ রহিম লিখেছেন, ‘তিনি বঙ্গদেশে মুসলিম শাসন সম্প্রসারণ ও ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। জনপ্রবাদে তাঁকে আধুনিক খুলনা জেলার দুর্গম অঞ্চলগুলো জয়ের এবং ঐ এলাকাসমূহে আবাদি গড়ে তোলার কৃতিত্ব দান করে।
এই অঞ্চলসমূহ আয়ত্তাধীনে আনয়ন করার পর, তিনি লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।’
খান জাহান ১৪৫৯ সালের ২৫ অক্টোবর (২৭ জিলহজ্ব, ৮৬৩ হি) ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর নিজের তৈরী সৌধে সমাহিত হন।
আদর্শ শাসক ও ধর্মপ্রচারক হজরত খান জাহান আলী রহ. কে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন। আমিন।
তথ্য সূত্র :
১. বাংলা পিডিয়া ২. উইকিপিডিয়া
৩. প্রবন্ধ : মো. তালহা তারীফ, ইসলাম প্রচারে খান জাহান আলী (রহ)।
৪. প্রবন্ধ : শানজিদ অর্ণব, খান জাহান আলী আউলিয়া না সভ্যতার নির্মাতা।
৫. প্রবন্ধ : ড. মাহমুদুল হাসান, খুলনা অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস।
কওমি মাদরাসায় কোচিং করতে হয় না কেনো?