মোশারফ মাহমুদ
প্রতিবেদক
উন্নত শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতি উন্নত, সমৃদ্ধ হতে পারে না। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তাই বলা হয় ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।’
আমাদের দেশে দুটি শিক্ষাধারা রয়েছে। দীনি শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা। এই দুই শিক্ষাধারায় বিপুল পরিমাণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিপুল শিক্ষার্থীও রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০১৫ সালের তথ্যানুযাই ৪ কোটির উপরে। এই শিক্ষার্থীদের উপরে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
একুশে বইমেলার সব বই দেখতে ও কিনতে ক্লিক করুন
গবেষণায় বলা হয়েছে, এসব শিক্ষার্থী তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষার মাত্র ৪০ শতাংশ পায় তাদের স্কুল থেকে। বাকি ৬০ শতাংশ শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়। শিক্ষার্থীদের এই আশঙ্কাজনক চিত্র দেখে অভিভাবক বিকল্প হিসাবে ‘কোচিং সেন্টার’ মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং একটি গলার ফাঁস হয়ে দেখা গিয়েছে। এতে করে অভিভাবকের টাকা নষ্ট হচ্ছে আর শিক্ষকরা খুঁজছেন অসৎ উপায়।
বর্তামানে একজন প্রাথমিক শিক্ষার্থীও আজ কোচিং ব্যতীত পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারে না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের মানসিকতা এমন যে, তারা এখানে চাকরি বা টাকা জন্যই পড়ান।
শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য তারা পড়ান না বা শিক্ষা দেন না। আর কোচিং সেন্টার একটা বিকল্প ব্যবসা বলা যেতে পারে।
দ্বিতীয় শিক্ষাধারা দ্বীনি শিক্ষা বা কওমি শিক্ষাধারা। এখানে কোনো কোচিং সেন্টার দেখা যায় না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কওমি মাদরাসায় কোচিং সেন্টারের বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। আর তাহলো ‘তাকরার’।
তাকরারের সিস্টেম হলো, প্রতিদিন তাদের ক্লাসের উস্তাদগণ যা কিছু পড়ান বা আলোচনা করেন, এসব নিয়ে মাগরিবের পর থেকে রাত ১০/১১ টা নাগাদ শিক্ষার্থী একত্রে বসে অধ্যয়ন করেন।
এটাও অনেকটা ক্লাস সিস্টেমে। তবে এখানে কোনো শিক্ষক থাকেন না। অপেক্ষাকৃত ভালো ও মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষক হিসেবে আলোচনাগুলো তুলে ধরেন।
এটাকে তাকরার বলা হয়। অর্থ্যাৎ পুনাবৃত্তি বা পুনরায় আলোচনা করা।
কওমি ছাত্রদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই তাকরার তাদের অনেক উপকারে আসে। এটা মাদরাসার পক্ষ থেকে বিশেষ নিয়ম। বাধ্যতামুলক এই তাকরার করতেই হয়। যাতে কোনো একজন শিক্ষার্থী সেই আলোচনা না বুঝে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।
অধিকাংশ কওমি মাদরাসাই আবাসিক নির্ভর এ কারণে রাতের বেলা বাধ্যতামূলক এ তাকরারে সবাইকে বসতে হয়। এতে করে ক্লাসে যারা কম বুঝেন তারা রাতের তাকরারে বিষয়গুলো পুরোপুরি বুঝে নিতে সক্ষম হন।
জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার ফজিলত ২য় বর্ষের (অনার্স ২ য় বর্ষ) ছাত্র মো. ইয়াসিন এর কাছে কওমি মাদরাসায় কোচিং সেন্টার নেই কেনো জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোচিং সেন্টার তো তখনই প্রয়োজন হয় যখন কোনো শিক্ষার্থী পড়া বুঝতে সক্ষম না হয়।
আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা। তাই শিক্ষক আমাদের ক্লাসেই ভালোভাবে পড়ান। যাতে সব শিক্ষার্থী ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হয়। কোনোরূপ অস্পষ্ট না থাকে।
যদি কোনো ছাত্র ক্লাসের আলোচনা বুঝতে না পারে কার বিকল্প ব্যবস্থা তাহলো তাকরার ।
কোচিং সেন্টার বা প্রইভেটের বিকল্প হিসেবে এ তাকরারকে উল্লেখ করা যায় কিনা জানতে চাইলে অপর শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। তবে কোচিং সেন্টারে মাসিক ভাতা দিয়ে পড়তে হয়। এখানে তেমন ভাতা নেই।
এমন কি কোনো ছাত্র কোনো বিষয়ে উস্তাজের স্মরণাপন্ন হলে তিনি ভালোভাবে তাকে বুঝিয়ে দেন। আর এই জন্যই এটা সম্ভব হয়, কারণ আমরা সবসময় মাদরাসায় থাকি।
তাকরারের উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে অপর শিক্ষির্থী মুজ্জাম্মেল হক বলেন, অনেক সময় ক্লাসের আলোচনা ক্লাসের দুর্বল মেধার অধিকারী ছাত্ররা পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারে না। তাই এই বিকল্প হিসাবে মাদরাসার পক্ষ থেকে বধ্যতামূলকভাবে তাকরার করতে হয়।
যাতে কম মেধার অধিকারী ছাত্ররা আলোচনা বুঝতে পারে। আর প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাই এই বিকল্প ব্যবস্থা। এই জন্যই কওমি মাদরাসার ছাত্রদের কোচিং করতে হয় না।
কওমি শিক্ষার্থীদের পরামর্শ- স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যদি এমন সিস্টেম চালু হয় সাথে একজন শিক্ষকের তদারকি থাকে তাহলে কোচিং নামের গলার ফাঁস আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে উঠে যেত। বন্ধ হতো শিক্ষকদের অসৎ উপায়ে উপার্জনের রাস্তা।
বেফাকের অধীনে ইফতার পরীক্ষা: আদৌ কী সম্ভব?
ছবি পরিচিতি: কভারে মাদরাসার তাকরারের ছবিটি সায়্যেদ মুজাম্মিল এর ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া। তিনজন হলেন, মাওলানা সুহাইল আহমেদ সিলেটী, মাওলানা ইমদাদুল্লাহ পটুয়াখালী ও মাওলানা মুজাম্মিল।