১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সোমবার রাজধানীর জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদরাসায় অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের ১০তম কাউন্সিল।
কাউন্সিলে আল্লামা আহমদ শফিকে সভাপতি, আল্লামা আশরাফ আলীকে সিনিয়র সহসভাপতি, আল্লামা আব্দুল কুদ্দুসকে মহাসচিব ও দেশের প্রখ্যাত ২৭জন আলেমকে সহসভাপতি করে গঠন করা হয় বেফাকের নতুন কমিটি।
নবগঠিত এ কমিটির কাছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনায় তরুণ আলেমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তাদের আশা-প্রত্যাশার কথা।
আওয়ার ইসলাম পাঠকদের জন্য ক’জন তরুণের মতামত তুলে এনেছেন প্রতিবেদক কাউসার লাবীব।
শিক্ষাবোর্ডের সুনির্দিষ্ট গবেষণা কমিটি না থাকা দুঃখজনক
মুফতি মুহাম্মদ শরীফ মালিক
মুশরিফ, দারুল ইফতা ওয়াল ইরশাদ, শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ঢাকা
সম্প্রতি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) এর ১০ম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো । গঠিত নতুন কমিটিকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
অনেক পুরোনো এবং অভিজ্ঞ সংগঠকদের সঙ্গে এবার বেশ কয়েকজন উদীয়মান আলেম বিভিন্ন পদে স্থান পেয়েছেন।
কওমি শিক্ষাধারাকে বাংলার সর্বস্তরের জনতার মাঝে বিস্তার ও সাংগঠনিকরূপে পরিচিতি করা এক প্লাটফর্মের নাম বেফাক। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের কওমি অঙ্গনে অবনমনের যে ধারা শুরু হয়েছে, তা এখনো চলছে।
যদিও প্রয়াত মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদীর নেতৃত্বে বিগত কমিটি কওমি শিক্ষার উন্নয়নে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, যা কখনো ভোলার নয়।
স্থবির কওমি শিক্ষায় গতি আনার জন্য সার্বিক দিক বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বিষয়ে বিগত কমিটির সুফল সকলের নজর কেড়েছে। কিন্তু তাদের ব্যর্থতাও কারো নজর এড়ায়নি।
নির্বাচিত নতুন কমিটিকে ঘিরে কওমি অঙ্গনের তরুণ আলেমদের প্রত্যাশা অনেক।
আমরা প্রত্যাশা করি-
০১. নব-নির্বাচিত কমিটি কওমির ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে সমাজে আলেমদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর হিম্মত অর্জনে সবধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
০২.দক্ষ ও পরিকল্পিত নেতৃত্বের হাত ধরে এগিয়ে যাবে আমাদের কওমি অঙ্গন। উঠে আসবে নতুন দিনের পথপদর্শক। তৈরি হবে জাতির দক্ষ জনবল।
০৩. কওমি শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা কারিকুলামে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন।
০৪. কওমি মাদরাসাসমূহের মাঝে নিবিড় সেতুবন্ধন স্থাপনে যুগোপযুগী পদক্ষেপ গ্রহণ।
০৫. কওমি শিক্ষার সুফল সর্বময় ছড়িয়ে দেওয়া ও দীনি দাওয়াতের প্রসার ঘটানো।
০৬. শিক্ষিত হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রয়াসে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।
০৭. বাতিল মতবাদের রোধকল্পে প্রত্যেক জেলায় ওলামা-তালাবা সেমিনারের ব্যবস্থা গ্রহণ।
০৮. ‘শুধু মুখস্ত নয়’ বুঝে পড়াই প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যম’ স্লোগানকে সামনে রেখে পরীক্ষার ধরণ নির্ণয় করা।
০৯. অসহায় ও মাজলুম ওলামা-তালাবার সহযোগিতায় একটি ‘কওমি হেল্প ডেস্ক’ গঠন করা।
১০. বেফাক একটি ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড। এ শিক্ষাবোর্ডের সুনির্দিষ্ট একটি গবেষণা কমিটি নেই। যা খুবই দুঃখজনক।
বেফাকের নতুন কমিটির কাছে অনুরোধ থাকবে ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, কালচার, সাংস্কৃতিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার জন্য একটি কমিটি গঠন করা এবং জাতির মেধাবী সন্তানদের ওই কমিটিতে রেখে তাদের মেধা থেকে উপকার হাসিল করার উদ্যোগ করা।
আশা করি নতুন কমিটি তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হবেন। আল্লাহ তাদের ঐক্যবদ্ধ থেকে ইখলাসের সঙ্গে আমাদের প্রত্যাশা আমলে নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সিলেবাসে যুগের প্রয়োজন বুঝে আরও বিষয় সংযোজন করতে হবে
মুফতি রেজাউল করিম আবরার
সিনিয়র মুহদ্দিস, জামিয়া আবু বকর রা. উত্তর যাত্রাবাড়ী ঢাকা
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের নতুন কমিটি করা হয়েছে। অল্প কিছু প্রশ্ন জাগা ছাড়া কমিটি বেশ সুন্দর হয়েছে। নবগঠিত এ কমিটির কাছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি-
০১. নতুন কমিটির কাছে প্রথম প্রত্যাশা হল কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়টি জোরদার করা। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের মতো যেন ঝুলে না থাকে।
আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ একেবারে শেষের দিকে। নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। নির্বাচনের ঢাকঢোলে স্বীকৃতি যেন হারিয়ে না যায়, সে সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সংসদে দ্রুত বিল পাশ করানোর বিষয়ে সর্বদা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।
০২. কওমি মাদরাসার নেসাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা হচ্ছে। এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার অনুরোধ থাকলো। কারণ যুগ চাহিদাকে ইসলাম বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে।
এক্ষেত্রে নতুন অনেক কিছু যোগ করা যেতে পারে আবার পুরাতন অনেক কিছু বাদ দেওয়া যেতে পারে। বেফাক এক্ষেত্রে বিজ্ঞজনদের মাধ্যমে অন্যান্য রাষ্ট্রের নেসাব সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে পারে।
বিশেষত দারুল উলূম দেওবন্দ এবং দারুল উলূম করাচির নেসাব সামনে রাখতে পারে।
০৩. ইফতা বিভাগকে বেফাকের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। আগামী বছর থেকে ইফতা বিভাগের ছাত্রদেরও বেফাকে পরীক্ষা দিতে হবে।
ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফূযাতের অন্যন্য অ্যাপ
বাংলাদেশে এমনিতে দারুল ইফতার অভাব নেই। মুফতিদের সংখ্যাও অনেক। শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ অনেকের মুখে শুনেছি, ইফতা এখন রুসুমি হয়ে গেছে। অধিকাংশ দারুল ইফতা মানসম্মত নয়।
বেফাকের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি খেয়াল করতে হবে সেটা হলো, অন্যান্য শ্রেণির মতো ইফতাও যেন ‘গাইড বা নোট’ নির্ভর না হয়ে পড়ে।
এছাড়া একেক দারুল ইফতার মানহাজ একেক ধরণের। এ বিষয়টি মাথায় রেখে মানহাজ তৈরি করতে হবে। আমাদের একটি দুর্বলতা হল হানাফি মাযহাবের দলিল সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা তেমন হয় না।
কারণ আমাদের পুরো পড়াশুনাই ফিকহ নির্ভর হয়। যুগের প্রয়োজনে “হিফজুন নুসুস” বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এজন্য ইফতার মানহাজে এ বিষয়টিও খেয়াল রাখা চাই।
আশা করি নতুন কমিটি বিষয়টিগুলো ভেবে দেখবেন।
আন্তর্জাতিক ইসলামিক শিক্ষা কনফারেন্স করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে
মুফতি হোসাইন আহমাদ কাসেমী
প্রধান মুফতি ও শিক্ষাসচিব, মারকাযু দা'ওয়াতিস্ সুন্নাহ বাড্ডা, ঢাকা।
বেফাক বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ঐতিহ্যবাহী ও পুরানো সংগঠন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হলো বেফাকের নতুন কমিটি। নবগঠিত এ কমিটির কাছে প্রত্যাশা করবো-
০১. বেফাক যেহেতু এদেশের কওমি ওলামাদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম তাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারনে এই ঐক্যযাত্রা যেন বিনষ্ট না হয়।
বেফাকের কোনো দায়িত্বশীলদের মধ্যে যেন নিজেদের দলীয় প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্য না থাকে। উম্মাহর স্বার্থে নিজ দল থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ থাকলো এই বৃহৎ স্বার্থকে।
প্রকৃত মাদরাসাপ্রেমীদের সমাগম হোক বেফাকের নতুন জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে। রাজনৈতিক বলয়মুক্ত থাকুক উলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম। তাহলেই এক একজন ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া তৈরি করে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবেন উলামায়ে কেরাম।
০২. কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ও সরকারি মান গ্রহণে কওমি শিক্ষা সিলেবাসে যেন সরকারের কোন হস্তক্ষেপ না থাকে। সম্পূর্ণ দারুল উলূম দেওবন্দের দরসে নেযামি ও সিলেবাস অনুযায়ীই যেন আমাদের শিক্ষা সিলেবাস বহাল থাকে।
০৩. কওমি শিক্ষাধারার প্রত্যেকটা বিভাগকেই বেফাকের অন্তর্ভুক্ত করে প্রত্যেকটা ছাত্রকে যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম হওয়ার সুযোগ প্রদান করা হোক।
০৪. প্রতি বছর ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের উদ্যোগে’ আন্তর্জাতিক ইসলামিক শিক্ষা কনফারেন্স করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে । এতে করে কওমি শিক্ষাধারার ব্যাপক প্রভাব বিস্তার ঘটবে। মানুষও ইসলামি শিক্ষাধারার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
০৬. বেফাক নিয়ন্ত্রিত মাদরাসাসমূহের ছাত্রদের এ বিষয়ে যত্নশীল হওয়া যেন কোনো ছাত্র আর্থিক সমস্যার কারণে ইলম হাসিল থেকে ছিটকে না পড়ে। এ বিষয়ে মাদরাসাগুলোর প্রিন্সিপালদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে।
০৭. কওমি মাদরাসা থেকে ফারেগ হওয়ার পর প্রত্যেকটা ফারেগিনকে জাতির খেদমত ও ইলমে দীনের খেদমতে লাগিয়ে দেওয়ার ফিকির করা।
শুধু তৈরি করে দিলেই হবেনা বরং তাদের কাজেও লাগিয়ে দেওয়ার ফিকির করা। যেন ফারাগাতের পর কোনো ছাত্র মানসিক হয়রানিতে না থাকে।
ইফোর্ট: টি শার্টে আধুনিকতা ও শালীনতার সমন্বয়
শিক্ষকদের মানোন্নয়নে সচেতন হওয়ার অনুরোধ
জুনাইদ শোয়েব
শিক্ষার্থী , ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগ
মারকাযুস সুন্নাহ সাইদ নগর, নতুন বাজার গুলশান, ঢাকা।
বেফাকের নতুন কমিটির কাছে তরুণ আলেম হিসেবে আমার চাওয়া -
০১.বেফাক কওমি মাদরাসা স্বীকৃতি বাস্তবায়নে জোড়ালো ভূমিকা পালন করবে এবং তা এই কমিটির মেয়াদ কালের মধ্যেই বাস্তবায়ন করবে।
০২. বেফাক ইতোপূর্বে যেভাবে সমস্ত কওমি মাদরাসার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছে, নতুন কমিটি তা আন্তরিকতার সঙ্গে ধরে রাখবে বলেই আশা করি।
০৩. নতুন কমিটি কওমি মাদরাসায় আরবি ভাষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সিলেবাস চালু এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়ার অনুরোধ করছি।
০৪. পাশাপাশি নতুন কমিটির কাছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে আরোও বেগবান, আরোও উন্নত মাধ্যম এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক শিক্ষক কারিকুলাম অনুসরণ করে শিক্ষকদের মানোন্নয়নে সচেতন হওয়ার অনুরোধ থাকলো।
সব সিলেবাসকে এক ও অভিন্ন করার অনুরোধ করছি
মুহাম্মদ মুরশিদুল আলম
শিক্ষার্থী , ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগ, দারুল আরকাম আশ্রাফাবাদ, কামরাঙ্গিরচর ঢাকা
বেফাকের নবগঠিত কমিটিকে জানাই মোবারকবাদ । সঙ্গে নতুন কমিটির কাছে তরুণ প্রজন্মের কিছু প্রত্যাশার কথা হলো-
০১. বেফাক আঞ্চলিক বোর্ডগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে এবং যে সব মাদরাসা এখনো বেফাকভূক্ত হয়নি সেগুলোকে বেফাক আওতাধীন করতঃ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানকে আরো উন্নতি করবে।
০২. এখনো দরসে নিজামির মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠানের সিলাবাসের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। আমি নতুন কমিটির কাছে আশাবাদী, এই সিলেবাসকে প্রয়োজনে পরিবর্তন করে দরসে নিজামির সব সিলেবাসকে এক ও অভিন্ন করার অনুরোধ করছি।
বেফাকের কাউন্সিল; যে বিষয়গুলো ভাবা একান্তই জরুরি