হাবিবুর রহমান মিছবাহ : মতলব ফেরীঘাট। বেশ পরিচিত একটি এলাকা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পৌঁছি মতলব ফেরীঘাটে। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ একটি মটরসাইকেল ডান দিন থেকে এসে আমাদের গাড়ির সামনের বাম্পারে লাগিয়ে দেয়।
মটরসাইকেলটিতে তিনজন যুবক ছিলো। এর মধ্যে চালক ছেলেটিকে দেখতেই ফালতু মনে হয়েছিলো। একটি ছেলে পায়ে আঘাতও পায়। দু’চার কথা শুনিয়ে দেয়া দরকার ছিলো ওদের। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামেনি।
দোষ ওদের হলেও যেহেতু ব্যথা পেয়েছে, ওদের কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনি সে। তিন যুবকের একজন এসে গাড়ির গ্লাসে জোরে জোরে নক করতে শুরু করে। ড্রাইভার গ্লাস খুলে জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা? ছেলেটি বললো, না কোনো সমস্যা নেই। তাহলে গ্লাসে এভাবে আগ্রাসীরুপে নক করলে কেনো? ছেলেটি কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলো।
এদিকে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশীর ভূমিকায় এক সিএনজি ড্রাইভার আমাদের ড্রাইভারকে উত্তেজিত ভাষায় উল্টাপাল্টা বকতে শুরু করে। আমি সিএনজি ড্রাইভারকে অকারণে উত্তেজিত হতে নিষেধ করলাম।
এর মধ্যে মটরসাইকেল আরোহী যে যুবক ব্যথা পেয়েছে, সে ছেলেটি সিএনজি ড্রাইভারের সাথে তাল মিলিয়ে তেড়ে আসে আমাদের গাড়ীর দিকে। আমি ছেলেটিকে একেবারেই শান্ত মেজাজে বললাম, তুমি চোখ রাঙাচ্ছো কেনো? নিজেদের দোষে ব্যথা পেয়েছো, সেখানে উল্টা পার্ট নিচ্ছো?
ছেলেটি আমার দিকে আপত্তিকর ভঙ্গিতে এগুচ্ছিলো। তা দেখে আমার সফরসঙ্গী ওকে একটি ধমক দিলো। ব্যস! এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম ওরা সন্ত্রাসী টাইপের পোলাপান। ছেলেটি আমার সফরসঙ্গীকে তুই তুকারি শুরু করে দিলো এবং বলে ফেললো তুই পারলে গাড়ি থেকে নেমে আয়!
পরিবেশটা এমনভাবে ঘোলাটে করে ফেললো, তখন আমার গাড়ির লোকজন যদি প্রতিবাদ না করে, তাহলে ওরা হয়তো আজীবন হুজুরদের সাথে এ আচরণ অব্যহত রাখবে। আমার ছোটভাই জাবেরও ছিলো আমার গাড়িতে। ঐ যুবক ছেলেটির অতিরিক্ত উশৃংখলতায় আমার সফরসঙ্গী ও ছোট ভাই জাবের গাড়ি থেকে নেমে যায়।
বুঝতে পারিনি ঘটনাটা এতোদূর গড়াবে। ছেলে তিনটি যে এতোবড় বেয়াদব ও মাস্তান তাও বুঝতে পারিনি। ওদের গাড়ি থেকে নামতে দেখে আমিও নামলাম। আমার ইচ্ছা ছিলো ফেরীঘাটে উপস্থিতিদের বিষয়টি অবগত করে ছেলেটিকে দু’চার কথা বলে ছেড়ে দিবো।
কিন্তু আমার সফরসঙ্গী ও ছোট ভাই গাড়ি থেকে নামতেই মাস্তান তিন যুবকের দু’জন ওদের উপর হামলা শুরু করে দিলো। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনি। কেউ যদি ছোটভাইকে বিনা কারণে মারতে আসে, কোনো ঠাণ্ডা মাথার মানুষও স্থীর থাকতে পারবে না। কেউ পারলেও আমি পারিনি।
আমার ভাইকে কেউ মারবে আর আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবো তা আমার দ্বারা কখনও সম্ভব নয়। আমার সফরসঙ্গীও আমার আপন মামাতো ভাই। ছোট দুই ভাইর উপর হামলা করায় আমিও উত্তেজিত হয়ে পড়ি। ছেলেটি হাতে ইট নিয়ে ছোট দুইভাইকে মারতে উদ্যত হলে, আমার ড্রাইভার আব্দুস সাত্তার ভাই তাতে বাধা দেয়।
আমি মাস্তান ছেলেটিকে ধরে বললাম, চল তোকে পুলিশে দেবো। এ কথা শুনে তিন যুবকের একজন এসে বললো, হুজুর আমি পুলিশের লোক। কার্ড দেখালো। আমি কতোক্ষণ ওকে বকলাম। তুমি পুলিশের লোক হয়ে নিয়ম বহির্ভূত গাড়ী চালাচ্ছো কেনো? তুমি কি মাস্তান নিয়ে ঘোরো?
তোমরা আইনের লোক হয়ে আইন রক্ষা করছো না কেনো? তোমাদের থেকে সাধারণ মানুষ কী আচরণ আশা করবে? তোমরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আর কতো এভাবে মাস্তানী করে যাবে? তুমি পুলিশ দেখেই তোমার সাথের ছেলে দু’টি যা তা ব্যবহার করে যাচ্ছে সেই শুরু থেকে। তুমি একবারও ওদেরকে নিষেধ করলে না কেনো? যাক মোটামুটি ওরা শান্ত হলো। কিছুটা অনুতপ্তও।
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই পরিবেশটা পূর্ণ উল্টে দিলো স্থানীয় আরেক মাস্তান ও তার কিছু চামচা। হয়তো হুজুর দেখলে ওদের এলার্জি শুরু হয়। শুনেছি সে নাকি মতলব ফেরীঘাটের সিএনজি স্ট্যান্ডে চাঁদা তোলে। আবার কেউ কেউ বলেছে, না চাঁদা আদায়কারীর ভাই। আবার একজন থেকে শোনলাম উনি নাকি ওখানেরই একজন দোকানদার।
সে যেই হোক, তার কথা ছিলো হুমকিমূলক। হুজুরদের লক্ষ্য করে যা তা বকে যাচ্ছিলো লোকটি। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, দেখুন! শুরু থেকে আপনি কিছুই দেখেননি। তাহলে গায়ে পড়ে একপক্ষ নিয়ে কেনো ঝগড়া বাঁধাচ্ছেন? আপনার ওপর কেউ হামলা করলে কি আপনি প্রতিবাদ করবেন না? আত্মরক্ষা করবেন না নিজেকে? কিন্তু লোকটি কোনো কথাই শুনতে চাইলো না।
উনি বললো, আমি এই এলাকার সন্তান! সাবধানে কথা বলবেন! এমন হুমকি শুনলে আমি যেন নিজেকে ঠিক রাথতে পারি না। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রেখেই বললাম, দেখুন! এ সমস্ত হুমকি দিয়ে লাভ নেই। আপনাদের মতো মাস্তানদের বিন্দু পরিমাণ পরোয়া করি না আমি। আর আপনি এই এলাকার লোক তাতে কী হয়েছে?
আমি হাঙ্গামা চাই না। চাই না দ্বন্দও। আমি সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ব চাই। কিন্তু অযথা মাস্তানী করতে এলে ছেড়ে কথা বলবো না। মাস্তানী করবেন কেনো? আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ। সেখানে আমি এই এলাকার, আমার দুলাভাই অমুক, আমার মামু চুলছেড়া নেতা, এসব পরিচয় দেন কেনো? নিজের পরিচয়ে চলতে শিখুন!
স্থানীয় মাস্তানদের নাক গলানোয় মটরসাইকেলের সেই মাস্তানরাও আবার উল্টা পার্ট নিতে শুরু করলো। এবার নেতৃত্ব দিচ্ছে পুলিশ ছেলেটি! তবুও আমরা আর কথা না বাড়িয়ে ফেরীতে উঠে গেলাম। ফেরীতে উঠে যুবক তিনটি দেখিয়ে দেবে, এই করবে সেই করবে ইত্যাদি বলতে লাগলো। স্থানীয় মাস্তান ও চামচারাও বোঝাপড়া করবে, দেখে নেবে আরো কতো কী! ফেরী থেকে উঠেই যুবক তিনটি পুলিশের কাছে গিয়ে আমাদের নামে কী যেনো বললো।
পুলিশের ছেলেটি হয়তো ভেবেছিলো ও নিজে পুলিশ হওয়ায় আমাদের বেকায়দায় ফেলতে পারবে, আর দায়িত্বরত পুলিশও ওর পক্ষে কথা বলবে। কিন্তু পুলিশ আমাকে দেখে বললেন, হুজুর আপনি চলে যান। আর ওদেরকে মাফ করে দেন।
বলছিলাম ১৪/০২/১৮ চাঁদপুরের ঐতিহাসিক হাসান আলী হাইস্কুল মাঠে ছাওতুল কোরআন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তাফসীরুল মাহফিলে যাবার পথে মতলব ফেরীঘাটে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত একটি ঘটনার কথা। প্রশ্ন হলো, আর কতোকাল এভাবে মাস্তানদের যাতাকলে পৃষ্ঠ হতে হবে আমাদের? আমরা কি ঐক্যবদ্ধবাবে মাস্তান দমনে এগিয়ে আসতে পারি না? মুহূর্তেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সংবাদটি।
পরবর্তীতে অসংখ্য অনুরাগী জড়ো হয় মতলব ফেরীঘাটে। খুঁজে বেড়ালো ঐ মাস্তানদের। কিন্তু ততোক্ষণে হয়তো ঐ মাস্তানরা স্থান ত্যাগ করে চলে গেছে। আমি খবর পেয়ে মতলবের বাগিচাপুরের পীর সাহেব বন্ধুবর মাওলানা আনসার আহমদ ভাইকে সেখানে পাঠালাম।
বললাম, আমার পক্ষ হয়ে সেখানে কেউ যেনো বিশৃংখলা সৃষ্টি না করে। কোনো প্রতিশোধের দরকার নেই। ওরা ওদের ফল নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে। আমি কোনো ধরণের দ্বন্দ চাই না। আনসার ভাই দ্রুত সেখানে গিয়ে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনেন। আমার অনুরাগীদের নিয়ে চলে আসেন সেখান থেকে।
তবে অনেকে দাবী করেছেন, ঘটনাটি কোনো পরিকল্পিত ঘটনা কী না, সেটি ক্ষতিয়ে দেখা সময়ের দাবী। কিন্তু আমার মনে হয় না এ দেশে কোনো হুজুরের ওপর হামলার তদন্ত হবে।
এইচজে