সম্প্রতি সৌদি আরবের উচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য শাইখ আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আল-মুতলাক ‘নারীদের বোরকা পরা আবশ্যক নয়’ বলে ফতোয়া দিয়েছেন মর্মে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়।
অথচ শাইখ আদৌ বোরকাবিরোধী কোনো ফতোয়া দেননি। বরং তিনি সৌদিতে ‘আবায়া’ নামে পরিচিত বিশেষ ধরনের বোরকা, যা মাথার ওপর থেকে পরা হয়, সেটা পরা আবশ্যকীয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন। কাঁধের ওপর থেকে যে বোরকা পরা হয় সেটা পরা জায়েজ বলেছেন।
এ বিষয়ে তার অভিমত পরিষ্কার করে তিনি একটি বিবৃতি দিয়েছেন। শাইখের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিটির অনুবাদ নিম্নরূপ :
‘নিদাউল ইসলাম নামক রেডিওর অনুষ্ঠানে আমি নারীদের কাঁধে পরিধেয় বোরকা (আবায়াতুল কাতিফ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছিলাম। তথা পোশাকের বিশেষ শ্রেণি হওয়া কি শর্ত? যেহেতু এই রেডিওটি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সব মুসলমানের উদ্দেশে সম্প্রচারিত হয় তাই আমার জবাবটিও এসেছে সব মুসলিম বোনদের উদ্দেশ করে।
একজন মুসলিম নারী শরিয়তসম্মত শর্তাবলি মেনে ইসলামি হিজাব মেনে চলাই আল্লাহ?র ইবাদত, নিজের সুরক্ষা এবং পবিত্রতার উপকরণ প্রসারের মাধ্যমে সমাজেরও সুরক্ষা।
এ কারণে যেসব পোশাকের মাধ্যমে আচ্ছাদন অর্জিত হয় এবং শরয়ি শর্তগুলো পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায় সেটাই গ্রহণযোগ্য হিজাব। চাই সেটা আবায়াতুর রাস (মাথার ওপর পরিধেয় বোরকা) হোক কিংবা আবায়াতুল কাতিফ (কাঁধের ওপর পরিধেয় বোরকা) হোক কিংবা অন্য কোনো পোশাক হোক; যদি সে পোশাকটি গোটা দেহকে আচ্ছাদনকারী হয়, ঢিলেঢালা হয়, শরীরের অঙ্গভঙ্গি ফুটিয়ে না তোলে, পুরুষের সঙ্গে কিংবা দুঃশ্চরিত্র নারীদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়, পোশাকটি এমন মোটা হয় যে, নিচের কিছু দেখা যায় না, সুগন্ধিমাখা না হয় এবং খ্যাতি কুড়ানোর পোশাক না হয়। ফিকাহ এর গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়টি সুবিদিত।
এ বিষয়ে মুসলিম আলেমরা অনেক গ্রন্থ লিখেছেন। যদি কোনো হিজাবের মধ্যে এ শরয়ি শর্তগুলো পরিপূর্ণ থাকে সে ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের সব নারীকে (তাদের দেশ ও মাজহাবের ভিন্নতা সত্ত্বেও) বিশেষ কোনো সমাজের নারীদের মাঝে প্রচলিত বোরকা পরতে বাধ্য করা উচিত হবে না। এই দাবিতে যে, এটাই ইসলামি হিজাব, অন্যগুলো নয়। কারণ প্রত্যেক সমাজের বিশেষত্ব থাকতে পারে।
উদ্দেশ্য হচ্ছে, হিজাব ফরজ করার গূঢ় রহস্য বাস্তবায়ন করা। আর তা হচ্ছে, ইসলামি হিজাবের শর্ত মোতাবেক আচ্ছাদন নিশ্চিত হওয়া।
মুসলিম নর-নারীর কর্তব্য তার ব্যক্তিত্ব রক্ষা করে চলা। কারণ ইসলামে ব্যক্তিত্ব রক্ষার উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। ব্যক্তিত্ব রক্ষার অর্থ হচ্ছে, যা ব্যক্তিকে সুন্দর ও সৌন্দর্যম-িত করে সেটা গ্রহণ করা এবং যা ব্যক্তিকে অসুন্দর ও অমার্জিত করে সেটা বর্জন করা।
মুসলিম নারীর ব্যক্তিত্ব রক্ষা হচ্ছে, কোনো দেশের মানুষ যে পোশাককে ভালো মনে করে এবং যে পোশাকের প্রতি আগ্রহ পোষণ করে সেটা যদি শরিয়তের আদর্শ মোতাবেক হয় তাহলে সেটা গ্রহণ করা।
অনেক নারী হিজাব বর্জন এবং দ্বীনের সঙ্গে হঠকারিতা করার মাধ্যমে কী উপকার লাভ করেছে! শুধু দুনিয়ায় নিজের মর্যাদাহানি করা এবং আখেরাতে আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তির উপযুক্ত হওয়া ছাড়া আর কী। আল্লাহ?র অনুগ্রহ ও অনুকম্পায় সৌদি আরবের অনেক নারী বিশ্বের অন্য মুসলিম নারীদের জন্য হিজাব ও আচ্ছাদন রক্ষার ক্ষেত্রে রোলমডেল।
ওই সব লোকের ব্যাপারে আমি বিস্মিত হয়েছি- যারা আমার কথার এমন ব্যাখ্যা করেছেন যার কোনো অবকাশ নেই, আমি যা বলিনি সেটাকে তারা আমার কথা বলেছেন, বরং কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, আমি হিজাব বর্জন, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার দিকে ডাকছি (আল্লাহ? তাদের ক্ষমা করুন)।
অথচ আমার কথা ছিল আমাদের সমাজে প্রচলিত মাথায় পরিধেয় আবায়া (বিশেষ ধরনের বোরকা) সম্পর্কে; তথা বিশ্বের সব নারীকে এই আবায়া পরতে বাধ্য করা উচিত হবে না; যদি তারা এমন কিছু পরেন যা শরিয়তসম্মত হিজাবের শর্ত বিরোধী নয়।
এ ইস্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রপাগান্ডার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব শুভাকাক্সক্ষী আমার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছেন এবং আমার প্রতি সুধারণা রেখেছেন তাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
ডক্টর শাইখ আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আল-মুতলাক সৌদি আরবের উচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য এবং সৌদি বাদশাহর উপদেষ্টা। তিনি ১৪০৪ হিজরি সালে রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ‘তুলনামূলক ফিকাহ’ বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবনে একই ইনস্টিটিউটের প্রভাষক, এরপর ভাইস-ডিন, এরপর দাওয়াত বিভাগের চেয়ারম্যান, তারপর ‘তুলনামূলক ফিকাহ’ বিভাগের চেয়ারম্যান, এরপর ফতোয়াবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সর্বশেষ উচ্চতর ওলামা কমিটির সদস্য হিসেবে কর্মরত হন এবং শেষোক্ত পদে এখনও বহাল আছেন।
তার রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছেÑ ‘আত-তাহকিক ফি জারায়িমিল আরাজ’ (ইজ্জত হরণ সংক্রান্ত অপরাধগুলোর তদন্ত), ‘শাহাদাতুল মারআ ফিল কাজা’ (বিচারকার্যে নারীর সাক্ষ্য), ‘বায়উল মাজাদ’ (নিলামে বেচাকেনা), ‘আস-সুকুক’ (বিচারিক রায়পত্রগুলো) ইত্যাদি।
সরাসরি শাইখের সাহচর্যে রয়েছেন এমন ছাত্ররা জানেন, তিনি দ্বীনদারি ও পরহেজগারির উন্নত স্তর রক্ষা করেন। শত ব্যস্ততা, সফর ও অসুস্থতা সত্ত্বেও নামাজের প্রথম কাতার, তাকবিরে তাহরিমা, নফল নামাজগুলো তার ছোটে না।
শাইখের বড় মেয়ে উস্তাদ নূরা প্রিন্স নূরা ইউনিভার্সিটির ইসলামি সাবজেক্টের টিচার। কত দ্বীনদার ও তাকওয়াবান, পর্দা রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি বা তার অন্য মেয়েরা সবার অনুকরণীয় আদর্শÑ শাইখের বিদেশি ছাত্রদের স্ত্রীরা অকপটে এ সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন। শাইখের ব্যাপারে এ ধরনের একটি অন্যায্য প্রপাগান্ডায় শাইখের ছাত্ররা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
বিবৃতির অনুবাদ ও গ্রন্থনা শাইখের সরাসরি ছাত্র সৌদি আরবের রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি গবেষক মুহাম্মদ নূরুল্লাহ তারীফ
সূত্র: আলোকিত বাংলাদেশ