রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই: তারেক রহমান জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেন শায়খ মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন আগামীকাল মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে চরমোনাই পীরের শোক প্রকাশ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী রহ.-এর বর্ণাঢ্য জীবন কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে: নাছির বড় ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা আইফোনে ‘টাইপ টু সিরি’ ফিচার যেভাবে ব্যবহার করবেন  স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা আল্লাহকে পেতে হলে রাসূলের অনুসরণ অপরিহার্য: কবি রুহুল আমিন খান

যেভাবে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মিজানুর রহমান
শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ

উলামায়ে দেওবন্দ দেড়শ বছর ধরে দীন-ধর্ম এবং ইলম ও আমলের প্রতিবিম্ব স্থাপন করে রেখেছেন দুনিয়াজুড়ে ৷ পৃথিবীর বুকে ছায়া ও ফলদার বৃক্ষের মতো জ্ঞানের দীপাধার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যুগ যুগ ধরে ৷ মহান প্রভুর দেয়া জ্ঞানের আলোতে আলোকময় করেছেন পুরো বিশ্বকে ৷

নিঃসন্দেহে উলামায়ে দেওবন্দ উম্মাহর একটি নির্বাচিত কাফেলা যারা নিজের সবটুকু বিলীন করে দিয়েছেন আল্লাহর পথে, দীনের জন্য ৷ ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন, ইতিহাস কোনোটাই বাদ পড়েনি তাদের পরিব্যাপ্ত জীবন কর্ম থেকে ৷

নীরবে, নিরালয়ে সমাজের হীতে, বিশ্ব সংসারের কুশল কামনায়, বিদআত, কুসংস্কারমুক্ত রাষ্ট্র গঠনে যারা তিলে তিলে বিলিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের পুরো জীবন৷ নিজেদের সবটুকু শ্রম ও নিরলস সাধনা ব্যয় করে দীন রক্ষায় যারা বদ্ধপরিকর৷ ফলে যশ-খ্যাতি তাঁদের গলায় মালা পরিয়ে দেয় মানবতার টানে ৷ তারা চির নন্দিত,পরম সমাদৃত ৷

আমাদের এ লেখা মুবারক কাফেলার এক মহা মনিষার জীবন চরিত নিয়ে ৷ তিনি আমাদের সবার হৃদয়ের স্পন্দন, মুরশিদে মিল্লাত মুফতি আবুল কাসিম নুমানি৷ মুহতামিম ও মুহাদ্দিস, দারুল উলুম দেওবন্দ ৷

জন্মেছেন যেখানে

নামজাদা, প্রথিতযশা, বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দীন মাওলানা নুমানির জন্ম উত্তর প্রদেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শহর বেনারসে। ২২ সফর ১৩৬৬ হিজরি মুতাবেক ১৯৪৭ সনে মদনপুর মহল্লার এক অভিজাত খান্দানে জন্ম নেন তিনি ৷ যে বেনারস ইলম ও আমল, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দেশজুড়ে প্রসিদ্ধ ও ভারতীয় মুসলমানদের মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু ৷

পড়ালেখা

মাওলানা নুমানি ইবতেদায়ি তথা প্রাথমিক শিক্ষা নিজ পরিবারেই অর্জন করেন ৷ স্নেহময়ী মা ও শ্রদ্ধেয় দাদাজান মরহুম মাওলানা কারি নিজামুদ্দিন রহ. এর কাছে কায়েদায়ে বুগদাদি, নাজেরায়ে কুরআন, এবং উর্দু অংকের প্রাথমিক কিতাবাদি আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেন ৷

এরপর নিজ গ্রামে জামিআ ইসলামিয়া মদনপুরে প্রাইমারি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ৷ প্রাইমারি শেষ করে আরবি প্রথম বর্ষ-ও সেখানে শেষ করেন ৷ তারপর চলে যান দারুল উলুম মিউতে ৷ সেখানে পূর্ণ কৃতিত্বের সঙ্গে আরবি তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত শেষ করেন ৷

দারুল উলুম দেওবন্দে

১৩৮২ হিজরির শাওয়ালে মাওলানা নু ‘মানি জ্ঞান ভাণ্ডারের মাতৃক্রোড় উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে আরবি চতুর্থ বর্ষে ভর্তি হয়ে এ মহান ইদারায় শিক্ষার্জনের সৌভাগ্য অর্জন করেন ৷ ওই বছর দারুল উলুমে শতবর্ষী সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ৷

পড়ালেখা, কৃতিত্বে ঈর্ষণীয় সাফল্যের সাথে ১৩৮৭ হিজরিতে সর্বোচ্চ নাম্বার অর্জন করে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন ৷ ফারাগাতের পর একবছর তাকমিলে ইফতার কোর্সও সম্পন্ন করেন ৷

তিনি দারুল উলুমে শান্ত, সুবোধ, মার্জিত চরিত্রের অধিকারী, মেধাবী ছাত্র হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন ৷ আরবি ও উর্দূ সাহিত্যে তাঁর যোগ্যতা ছিল স্বভাব যাত ৷ জ্ঞানোদ্যান দারুল উলুম তা আরো শানিত করে তুলল৷ তাঁর যোগ্যতা, অসাধারণ প্রতিভা ছড়িয়ে যায় শিক্ষক ছাত্র সর্ব মহলে ৷ দারুল উলুমের ইলমি আঙ্গিনায় এর বেশ চর্চা শুরু হয় ৷

আরবি সাহিত্যে অসম্ভব দক্ষতার কারণে আসাতিযায়ে কিরামের অন্তরে প্রিয় ছাত্রের বিরল প্রতিভার প্রতি পূর্ণ ভরসা জন্মে ৷ ফলে তাকমিলে ইফতার বছর মাওলানা ওয়াহিদুয যামান কিরানবি রহ. এর নির্বাচনে আরবি সাহিত্যে পাঠদান করেন তিনি ৷

তখনকার ছাত্রদের অন্যতম হলেন বিশ্ব নন্দিত আরবি সাহিত্যিক মাওলানা নুর আলম খলীল আমিনী ৷

আধ্যাত্মিকতা

জ্ঞানের আঁধার, ইলম ও আমলের সমাহার এ সুমহান ব্যক্তিত্ব ছাত্র জীবনেই মিশকাতের বছর যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদীস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবীর হাতে বাইয়াত হন৷ কিন্তু কিছুদিন পর হজরতের ইন্তেকাল হয়ে যায় ৷

তারপর তিনি ফকীহুল উম্মত মুফতি মাহমুদুল হাসান গাঙ্গুহী রহ. এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন  এবং হজরতের কাছেই ইজাজতপ্রাপ্ত হন ৷ নিজের সবটুকু উজাড় করে প্রিয় শাইখের খিদমাতে আত্মনিবিষ্ট হন ৷ তিনি হজরতের আজাল্লে খুৃলাফাদের একজন ৷

এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকায় শাইখের ইন্তিকালে জানাজার জন্য হজরতকে ইমাম বানানো হয় ৷

অধ্যাপনা ও কর্মজীবন

১৩৮৯ হিজরী মুতাবেক ১৯৬৯ ইংরেজিতে দারুল উলুম থেকে একাডেমিক শিক্ষা সমাপনের পর জামিআ ইসলামিয়া, রিউরি পুকুর, বেনারসে শিক্ষকতা শুরু করেন ৷ ২০১১ ইংরেজিতে দারুল উলুমের ইহতিমামের ভার গ্রহণের আগ পর্যন্ত উক্ত মাদরাসাতেই সাফল্যের সাথে পাঠ দান পরিচালনা করেন ৷ সুদীর্ঘ সময় শাইখুল হাদিসের পদ অলংকৃত করে ছিলেন ৷

বেনারসে বিদআদ- রুসুমাতের খুব প্রচলন ছিল ৷ মাওলানা একা তা মূলোৎপাটনের সংকল্প করে কাজ শুরু করেন ৷ দাওয়াহ, ইসলাহ, ও ইরশাদের মায়দানে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান দুই যুগেরও বেশি সময় ৷ প্রতিকুল পরিবেশে দ্বীন- ধর্মের বাণী পৌঁছে দিতে বিছানাপত্র, মাইক, চাটাই নিয়ে নিজেই ছুটে যেতেন জন সাধারণের দ্বারে দ্বারে ৷

পুরো সপ্তাহ মেহনাত করে কারো ঘরে মাহফিলের আয়োজন করতেন ৷ তিলাওয়াত, নাশিদ, আলোচনা সব নিজেকেই করতে হত ৷

ইসলাহি কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করার লক্ষে তিনি -আন্জুমানে ইসলাহুল মুসলিমীন-নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ৷ পাশাপাশি নিজ এলাকা মদনপুরে স্বীয় মুরশিদের নামে খনকায়ে মাহমুদিয়া প্রতিষ্ঠা করেন ৷ যেখানে তিনি বাইয়াত ও সুলুকের সাথে দরসে কুরআন ও দরসে হাদীসেরও ব্যবস্থা করেন ৷

এ ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে ৷ বর্তমানে মাওলানার মুরিদান ও মুতাআল্লিকীনদের সংখ্যা কয়েক হাজারে ঠেকেছে ৷ তাঁর ফুয়ুজ শুধু ভারতে নয় বরং পুরো পৃথিবীর দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে৷

দারুল উলুমের সাথে সম্পৃক্ততা

১৯৯২ সনে মাওলানাকে দারুল উলুমের ব্যবস্থাপনার কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্যে মজলিসে শুরা ও মজলিসে আমেলার সদস্য পদে নিযুক্ত করা হয় ৷ ২০১১ পর্যন্ত সুদীর্ঘ বিশ বছর এ ধরাবাহিকতা অব্যাহত ছিল ৷

২০১১ এর জুলাই মাসে তখনকার মুহতামিম মাওলানা মারগুবুর রহমানের ইন্তেকালের পর পরিচালনা কমিটি হজরতকে নির্বাহী মুহতামিম হিসেবে নিযুক্ত করেন ৷ তিনি নির্বাচিত হওয়ায় কয়েকদিনের মাথায় আলহামদুলিল্লাহ পরিস্থিতি পরিপূর্ণ শান্ত হয়ে যায় ৷

ইসলামি আন্দোলন

মাওলানা নু‘মানি ইসলামি আন্দোলনেও একজন প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্ব ৷ ভারতীয় মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অঞ্চল ও প্রদেশ ভিত্তিক বহু কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন৷ এখন দারুল উলুমের ইহতেমামের গুরুদায়িত্বের কারনে মাঠ পর্যায়ে যদিও সক্রিয় নন তিনি৷

তবু জমিয়তের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ব্যক্ত করে মাঝে মাঝে বলেন- আমি তো শৈশব থেকেই জমিয়তের সদস্য আছি ৷ পৃথক হব কিভাবে?

লেখালিখি ও রচনা সমগ্র

শিক্ষকতা,মুহাদ্দেসি, ইহতিমাম এত সব ব্যস্ততার পাশাপাশি লেখালিখি অনেকটা কঠিন ব্যাপার৷ তবু হজ, ওমরার মাসাঈল, মা‘মুলাতে ইয়াওমিয়াহসহ জাতীয় দৈনিক, মাসিক, সপ্তাহিক সাময়িকীতে প্রকাশিত এবং বিভিন্ন কনফারেন্সে প্রদত্ত বিষয় ভিত্তিক, গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ-নিবন্ধ তাঁর জীবনের মূল্যবান পুঁজি ৷

রিউরি পুকুর, জামিআ ইসলামিয়াতে মাওলানা দীর্ঘদিন সহিহ বুখারির দরস দেন ৷ হজরতের দরসি তাকরির,আসবাকে হাদিস নামে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হতে চলেছে ৷ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়ে দ্বিতীয় খণ্ড আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় ৷

হজরতের বিষয় ভিত্তিক প্রবন্ধ - নিবন্ধ মাকালাতে নু‘মানি এবং বিভিন্ন মাহফিলের বয়ান সংকলন মাওয়ায়েজে নু‘মানী নামে সদ্য প্রকাশিত হয়ে উলামা, তুলাবা ও জনসাধারণ সর্ব মহলে বিপুল সমাদৃত হয়েছে ৷

উলামায়ে দেওবন্দের কিংবদন্তি সিপাহসালার, উম্মাহর অতন্দ্র প্রহরী, মুরশিদে মিল্লাত মুফতি আবুল কাসিম নু‘মানী বর্তমানে ইহতিমামের পাশাপাশি তিরমিজি শশিফ প্রথম খণ্ডের পাঠদানও করছেন ঈর্ষণীয় দক্ষতার সঙ্গে ৷ হজরতের নেতৃত্বে দারুল উলুমের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক, সাফল্যের শীর্ষচূড়ায় আরোহণ করুক এ কামনা করি ৷

পরিশেষে রব্বে কারিমের দরবারে হযরতের সুস্থ, সুন্দর ও দীর্ঘ নেক হায়াত কামনা করি৷

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ