আতাউর রহমান খসরু: সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন ফিলিস্তিনের দু’জন মেহমান। তাদের একজন ড. ইকরিমা সায়িদ আস সাবরি। অপরজন শায়খ আলি ওমর ইয়াকুব আব্বাসি। দু’জন এসেছেন ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থাপনায়।
শায়খ আলি ওমর ইয়াকুব আব্বাসি এসেছেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আর বাংলাদেশ সরকারের মেহমান হিসেবে এসেছেন ড. ইকরিমা সায়িদ আস সাবরি।
দু’জনের পরিচয় প্রদান করা হচ্ছে বায়তুল মাকদিসের খতিব। আর এ নিয়েই জনমনে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন; আসল খতিব কে? এমনকি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে কেউ কেউ একে অপরের প্রতি দোষারোপও করছেন।
জনমনের এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রতিবেদক আরবি ও ইংরেজি গণমাধ্যমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে যে সত্য জানতে পেরেছে তাহলো, বাংলাদেশে আগমনকারী দু’জন সম্মানিত মেহমানই বায়তুল মাকদিসের ইমাম ও খতিব।
তারা উভয়-ই এখনও বায়তুল মাকদিসে খুতবা প্রদান করেন। যদিও উভয়ের পদ ও খুতবা প্রদানের সময়ে পার্থক্য রয়েছে।
শুধু তাই নয়; এ দু’জন ছাড়াও আরও তিন ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে তারাও বায়তুল মাকদিসের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন সময় খুতবাও প্রদান করেন। তারা হলেন, শায়খ মুহাম্মদ আহমদ হুসাইন, শায়খ ইউসুফ আবু সুনাইনাহ এবং শায়খ ইসমাইল নাহদাওয়া।
আলোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে ড. ইকরিমা সায়িদ সাবরি সবচেয়ে প্রবীণ ও ফিলিস্তিনের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা। তিনি ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সায়িদ সাবরিও ছিলেন আল আকসা মসজিদের কাজি (বিচারক) ও সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য।
ড. ইকরিমা বাগদাদে লেখাপড়া করেন। ১৯৬৩ সালে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর দেশে ফিরে এসে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপালন করেন।
পিএলও-এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাত ১৯৯৪ সালে তাকে ফিলিস্তিনের প্রধান মুফতি ও বায়তুল মাকদিসের প্রধান ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।
ড. ইকরিমা ফিলিস্তিনে আরব মুসলিমদের অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত স্পষ্টভাষী। ২০০০ সালে ইউরোপীয় গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউরোপে ৬০ লাখ ইহুদি নিধনের কথা অস্বীকার করেন এবং এর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইহুদিরা যদি শান্তি চায় তারা যেনো ফিলিস্তিন ভূমি ছেড়ে চলে যায়। কারণ আল্লাহ তাদের এ নির্দেশ দিয়েছেন।
২০০৫ সালে তিনি ইহুদি সংশ্লিষ্টতার দরুন লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির তীব্র সমালোচনা করেন। এতে আমেরিকা ও তার মিত্ররা প্রচণ্ড রকম রুষ্ট হয় এবং ফিলিস্তিন সরকারের উপর তাকে সরিয়ে দিতে চাপ প্রয়োগ করে।
ইসরাইল ও আমেরিকার চাপে ফিলিস্তিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তাকে তার পদ থেকে অব্যহতি দেন। তার স্থলে শায়খ মুহাম্মদ আহমদ হুসাইনকে নিয়োগ প্রদান করেন।
ড. ইকরিমা বর্তমানে ফিলিস্তিনের সর্বোচ্চ ইসলামিক পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৭ জুলাই ২০১৭ তারিখে আল জাজিরায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ড. ইকরিমা সায়িদ আস সাবরিকে আকসা মসজিদের খতিব হিসেবে পুনর্বহাল করা হয়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করার পর এক জুমায় খুতবা প্রদানের সময় শায়খ ইকরিমা ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমণে আহতও হন।
শায়খ আলি ওমর ইয়াকুব আব্বাসি আল আকসা মসজিদের অন্যতম প্রধান ইমাম ও ফিলিস্তিনের একজন প্রভাবশালী আলেম। পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন আল আকসা মসজিদের সেবা করে আসছেন। ঐতিহাসিককাল থেকে ‘আব্বাসি’ পরিবার আল আকসার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করছে।
শায়খ ইয়াকুব আব্বাসি ১৯৬০ সালে ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। তার লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা সবকিছুই ফিলিস্তিনের পবিত্র মাটিতে হয়েছে। তিনি ১৯৮৩ সালে আল কুদস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত শায়খ ইয়াকুব আব্বাসি ফিলিস্তিনের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এসময় তিনি বায়তুল মাকদিসের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে শরঈয়্যা-এর পরিচালক নিযুক্ত হন।
১৯৯৩ সালে তিনি আল আকসা মসজিদের জাহরি নামাজ (মাগরিব, এশা ও ফজর) ও তাবারির ইমাম পদে নিয়োগ পান। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল আছেন। তাকে বলা হয় আল আকসার স্থায়ী ইমাম। তিনি রেওয়ায়েতে হাফস অনুযায়ী কুরআন তেলাওয়াত করেন।
শায়খ আলি ওমর ইয়াকুব আব্বাসি আল আকসা মসজিদে খুতবাও প্রদান করেন। তবে তার মূল দায়িত্ব ইমামতি ও প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে আলোচনা পেশ করা।
ফিলিস্তিনের বর্তমান প্রধান মুফতি। ২০০৬ সালে তাকে এ পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ধারণা করা হয়, ফিলিস্তিনের প্রধান মুফতিদের মধ্যে তিনিই রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে সবচেয়ে নিরপেক্ষ।
ড. মুহাম্মদ আহমদ হুসাইন ২২ মার্চ ১৯৫০ সালে আল কুদস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শরঈ কলেজে লেখাপড়া করেন এবং ১৯৭৩ সালে জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়ালেখা শেষ করে তিনি আল আকসার শরঈ মাদরাসায় যোগদান করেন এবং তার পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৮২ সালে আল আকসার খতিব ও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮৬ সালে তিনি আল আকসার ম্যানেজর হন এবং ২০০৬ সাল খতিব ও ম্যানেজার পদেই দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের প্রধান মুফতি হওয়ার পর তিনি খতিব হিসেবে অনিয়মিত হয়ে যান। তবে এখনও তার নামের সাথে খতিব ব্যবহার করা হয় এবং তিনি কখনও কখনও খুতবা প্রদান করেন।
শায়খ ইউসুফ আবু সুনাইনাহ
মসজিদুল আকসার অন্যতম ইমাম ও খতিব শায়খ ইউসুফ আবু সুনাইনাহ। তিনি ১৯৬০ সালে আল কুদসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ফিলিস্তিন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে সেখান থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনে তিনি ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ১৯৯১ সালে আল আকসার ইমাম ও খতিব হিসেবে নিয়োগ পান। শায়খ আবু সুনাইনাহ এখনও আল আকসার খতিব হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
শায়খ ইসমাইল আন নাহদাওয়া
আরব গণমাধ্যমে তাকে বায়তুল মাকদিসের হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং বায়তুল মাকদিসে তার দেয়া একাধিক খুতবা ইউটিউবে পাওয়া গেলেও তার জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় নি।
মিশরের বইমেলায় প্রকাশ হচ্ছে বাংলাদেশি আলেমের ২৩ খণ্ডের বই