প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে দীন ও ইসলামের প্রদীপ জ্বলিয়ে আসছে দেশের মাদরাসাগুলো। এ প্রদীপ আলো বিলাচ্ছে দেশ-বিদেশ, শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ ও পাড়া-মহল্লায়।
দীর্ঘদিন ধরে চলা আসা মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার একজন দক্ষ নাবিক মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া। যিনি চট্টগ্রাম আল জামিয়া আল ইসলামিয়া জমিরিয়া কাসেমুল উলুম পটিয়া’র শিক্ষাসচিব। তার অসংখ্য শীষ্য দেশ-বিদেশে দীনের খেদমত করে যাচ্ছেন।
ইলমে নববী অঙ্গনের এ দক্ষ ও প্রাজ্ঞ নাবিক মাদরাসার তালিম, তরবিয়ত এবং পড়ালেখার মান উন্নয়ন বিষয়ে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলাম এর সঙ্গে। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন আওয়ার ইসলাম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব।
আওয়ার ইসলাম : কওমি মাদরাসার শিক্ষার মান পর্যায়ক্রমে উন্নতির দিকে যাচ্ছে নাকি অবনতির দিকে?
আপনার দৃষ্টিতে উন্নতির দিকগুলো কী এবং অবনতির দিকগুলো কী?
মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া: আমাদের লেখাপড়া কিছু বিষয়ে উন্নতি হচ্ছে আর কিছু বিষয়ে অবনতি হচ্ছে।
যেসব বিষয়ে উন্নত হচ্ছে তাহলো, আগে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা নিজেদের মাতৃভাষায় যতটা যত্নশীল ছিল, এখন তার থেকে অনেক বেশি যত্নশীল। আগে তারা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে শুধু উর্দুনির্ভর ছিল। কিন্তু এখন এমনটি নয়।
বর্তমান ছাত্রদের আরেকটি উন্নতির দিক হলো, ছাত্ররা এখন লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বাহ্যিক জ্ঞানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যা খুবই ইতিবাচক।
আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা দেখেছি, ছাত্ররা এসব বিষয়ে আগ্রহী ছিল না। উস্তাদগনও এসব বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না।
বর্তমান ছাত্ররা বক্তৃতা, সাহিত্যচর্চা, লিখনী শক্তিতে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে তাদের উস্তাদগণও সহযোগিতা করছেন।
বক্তৃতা, লিখনি, সাহিত্যচর্চা আমাদের আকাবিরদের মাঝেও ছিল। কিন্তু মাঝখানে আমরা তা থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছিলাম । যা এখন আবার ছাত্ররা খুব জোড়ালোভাবে চর্চা করতে শুরু করেছে। আর এটা দরকারও । কেননা ‘যে তার যুগ সম্পর্কে অজ্ঞ সে মূর্খ।’
কিন্তু এসব দিকে আমরা এগুতে গিয়ে অনেক বড় একটি জিনিস থেকে সরে আসছি।
তাহলো কিতাব থেকে সরাসরি ইলম হাসিল করা। কিতাব থেকে সরাসরি ইলম হাসিল করার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান ছাত্ররা অনেক পিছিয়ে।
বিভিন্ন উর্দু সরাহ, বাংলা নোট আমাদের ছাত্রদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমি বলবো, উর্দু ও বাংলা শরাহগুলো ছাত্রদের জন্য ‘বিষের মতো’।
উর্দু শরাহ এর কথা এইজন্য বললাম, বর্তমান বাজারে প্রচলিত অনেক উর্দু শরাহতেই নতুন কিছু ইলেম যুগ করবে তো দূরের কথা, তারা আরবি মূল কিতাবের হাশিয়ায় যা আছে, তাও তুলে আনে না। সহজ ও মামুলি কিছু বিষয় লিখে, শরাহগুলো বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে।
পৃথিবীর সব শিক্ষাব্যবস্থা যখন গাইডবুক আর নোটের বিষয়ে সতর্ক হচ্ছে, আমাদের সরকার যখন জেনারেল শিক্ষার ক্ষেত্রে নোটের বিষয়ে সতর্কতার বার্তা দিচ্ছে। আমরা ঠিক সেই সময় ওই পথে নতুন করে পা বাড়াতে যাচ্ছি। এটা আমাদের জন্য খুবই হতাশা ও অবনতির বার্তা।
তবে আরবি শরাহ অবশ্যই উপকারী। আরবি শরাহ থেকে ছাত্ররা কিতাব বোঝার ক্ষেত্রে সাহায্য নিতে পারে। আর এটাই কর্তব্য।
আমি তো বলি, আমাদের মাদরাসার পাঠ্যবইগুলো শুধু আরবি হওয়া দরকার। তাতে কোনো উর্দু হাসিয়া বা বাইনাস সতর থাকবে না। যদি থাকতে হয় , তাহলে আরবি হাশিয়া থাকবে।
এর পাশাপাশি আরেকটা কথা বলতে চাই, বেফাক, ইত্তেহাদসহ বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষা কেন্দ্র করে এখন কিছু প্রশ্নোত্তর সম্বলিত বই বেরুচ্ছে। যা আমাদের ছাত্রদের আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
কিতাবের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে থাকে না। এতে শুধু ভাসাভাসা কিছু বিষয় তুলে এনে ছাত্রদের মূল কিতাব থেকে দূরে সরিয়ে আনা হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। গাইডবুক, নোটবুক থেকে ছেলেদের দূরে সরিয়ে আনতে হবে।
আওর ইসলাম : শোনা যাচ্ছে, ছাত্ররা এখন পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে লেখাপড়া করছে। তারা বড় আলেম হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কিংবা মুজতাহিদ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, শায়খুল হাদিস হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অধ্যায়ন করছে না। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া : আপনার প্রশ্নের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। তবে কিছু কথা আমি এর সঙ্গে যুক্ত করবো।
শুধু ছাত্ররা নয়, অনেক উস্তাদও পরীক্ষার জন্য পড়াচ্ছেন। কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফলাফলের জন্য প্রশ্ন সহজ করছেন। যে মাদরাসাগুলো আর্থিক সহায়তা দিয়ে বোর্ড পরিচালনা করে, তারা প্রশ্ন সহজ করার জন্য বোর্ডকে চাপ সৃষ্টি করে। তাদের চাপে প্রশ্ন হচ্ছে সহজ। কিন্তু ছাত্রদের ইলেমি যোগ্যতা কমে যাচ্ছে।
এমনও দেখেছি, অনেক মাদরাসার সাময়িক পরীক্ষার চেয়ে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন সহজ হয়। যা খুবই দুঃখজনক।
আর পরীক্ষার কথা কী বলবো? কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় বিভিন্ন কেন্দ্রে সাময়িক পরীক্ষার গার্ডের চেয়ে ঢিলেঢালাভাবে গার্ড দেওয়া হয়। ছাত্রশিক্ষক মিলে পরীক্ষা দেয়। আমানতদারীর প্রতি খেয়াল রাখা হয় না। যার ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মান ও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার আগ্রহ একেবারেই কমে যাচ্ছে।
আওয়ার ইসলাম : এ অবস্থা থেকে বের হতে আমাদের কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত? একজন প্রবীণ শিক্ষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনার কী দিকনির্দেশনা থাকবে?
মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া : এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, আমাদের মুরব্বিদের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমে প্রত্যেক মাদরাসার মুহতামিমকে তাদের শিক্ষকদের একথা বুঝাতে হবে, আমাদের পড়ালেখার উদ্দেশ্যটা কী? আমাদের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা মানে পাশের বন্যায় ভাসা নয়।
কেন্দ্রীয় পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো, তাদের কিতাবি যোগ্যতায় পরিপক্ব করে তোলা। তাদের যোগ্য আলেম বানিয়ে উম্মত ও ইসলামের খেদমতে নিবেদন করা। অতএব আমাদের ওইভাবেই পরীক্ষাগুলো নিতে হবে।
আরা প্রশ্নের ক্ষেত্রে আমি বলবো, ছাত্রদের কাছে কিছু কিছু জায়গা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। যা পড়লে তারা পরীক্ষায় ভালো নাম্বার তুলে ফেলে।
এরজন্য দরকার, পুরো কিতাব থেকে বিক্ষিপ্তভাবে প্রশ্ন করা। যার ফলে ছাত্ররা পুরো কিতাব মুতালাআ করে পরীক্ষা দিতে হয়।
সর্বশেষ আমি ভিন্ন একটি কথা বলবো, আমাদের ছাত্ররা এখন বাংলায় খুব চর্চা শুরু করেছে। কিন্তু উর্দুর ক্ষেত্রে তা অনেকটা ভাটা পড়েছে। আমাদের কিন্তু উর্দুতে ভালো একটা দখল রাখা আবশ্যক। কেননা, উর্দু আমাদের পদে পদে দরকার হয়।
তবে তা কিতাব মোতালাআর ক্ষেত্রে উর্দু সরাহ ব্যবহার করে নয়। বরং আলাদাভাবে উর্দু বিভিন্নকিতাব অধ্যায়ন করে। [শ্রুতি লিখন : কাউসার লাবীব]
‘দাওয়াতের কাজ হলো শরীর উলামায়ে কেরাম হলেন মাথা’