আওয়ার ইসলাম: নারী ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ এবং ফেমিনিজম বর্তমান সময়ে জীবনযাত্রার সবচাইতে বেশী ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছের মাঝে অন্যতম। এই সকল শব্দের গুরুত্ব সঠিকভাবে আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না এবং ক্ষেত্র বিশেষে বুঝতে চাইও না।
একজন নারীর সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, পারিপার্শিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন, প্রতিটি নারীকেই লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয়।
বর্তমান অবস্থাটা যখন এমন তখন নিজের দিক থেকে কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন ভারতের পুনের ডা. গণেশ রাখ। ছয় বছর পূর্বে তিনি একটি ক্যাম্পেইন চালু করেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তি সময়ে আরও অনেকেই একই কাজ করেছেন। ডা. রাখের দারুণ এই প্রয়াসটি হলো- তার হাসপাতালে কোন প্রসূতি মা কন্যা সন্তানের জন্ম দিলে তার চিকিৎসার জন্য এক রূপিও গ্রহণ করা হয় না!
দারুণ এই প্রয়াসটি কীভাবে শুরু হলো? এর পেছনের গল্পটি জানতে চাইলে যেতে হবে ২০০৭ সালে। এই সালে ডা. রাখ পুনের হাদাপ্সার এলাকায় তার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর থেকেই তিনি সকল মায়েদের মাঝে অদ্ভুত আচরণ খেয়াল করেন। যা তাকে বিস্মিত করে তোলে।
তিনি লক্ষ করে দেখলেন, গর্ভাবস্থার সময়ে এমনকি সন্তান জন্মদানের মুহূর্তেও অধিকাংশ মায়েরা গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। পুত্র সন্তান হবে কিনা- এই ব্যাপার নিয়ে তাদের মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা অসীম। ডা. রাখ জানান, সন্তান জন্মদানের কষ্ট অনেক মায়েরাই মুহূর্তের মাঝেই ভুলে যেতেন পুত্র সন্তান হবার আনন্দে। অন্যদিকে কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়ার ফলে তাদের কষ্ট যেন দ্বিগুণ বেড়ে যেত।
পুত্র সন্তান জন্ম নেওয়া যেখানে একটি পরিবারের খুশির সংবাদ হিসেবে বিবেচিত হতো, কন্যা সন্তানের জন্ম সেখানে অভিশাপ হিসেবে দেখা হতো। প্রায়শই দেখা যেত, কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়ার কথা শুনে অনেক আত্মীয়রা শিশুর মুখ না দেখেই চলে গিয়েছে।
এমনকি, হাসপাতালের বিল দেবার ক্ষেত্রেও নানান রকম সমস্যা তৈরি করত কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়ার কারণে। এই সকল ঘটনা ও আচরণের কারণে ডা. রাখ মানসিকভাবে খুব কষ্ট পান। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন এমন কিছু তিনি করবেন, যার ফলে খুব অল্প হলেও মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তন করা যায়। এইভাবেই ডা. রাখ-এর এমন চমৎকার ক্যাম্পেইনের সূচনা।
২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি এমন অভিনব সিদ্ধান্ত নেন- কন্যা সন্তান জন্ম নিলে হাসপাতালের ডেলিভারি ফির জন্যে কোন বিল করা হবে না। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ’শর বেশী কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে একেবারেই বিনামূল্যে। হাসপাতালের সকল রোগীর মাঝে মিষ্টি বিতরণের মাঝে দিয়ে প্রতিটি কন্যা সন্তানের জন্ম আনন্দ নিয়ে পালন করেন হাসপাতালে কর্তব্যরত ৩৫ জন কর্মী।
কন্সট্রাকশন সাইটের দিনমজুর রাহুল খালসে বলেন, "আমাদের বাসার কাছেও অনেক হাসপাতাল আছে। কিন্তু আমরা দূর থেকে এই হাসপাতালে এসেছি। কারণ ডা. রাখ কোন টাকা গ্রহণ করেন না।" একেবারে ছোট একটি পদক্ষেপ পরবর্তীতে অনেক বড় আকারে ধারণ করেছে। ১০০ জনের বেশী ডাক্তার বর্তমানে কন্যা সন্তানের জন্মের ব্যাপারে পরিবারকে উৎসাহিত করছেন।
ডা. রাখ কখনোই ভাবেননি, তার এতো ছোট একটি পদক্ষেপ এমনভাবে আলোড়ন তুলবে সকলের মাঝে। বিভিন্ন সরকারী অফিস তার কাজের প্রশংসা করেছে। বিখ্যাত বলিউড সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন ডা. রাখ-এর ব্যাপারে বলতে গিয়ে তাকে ‘রিয়েল হিরো’ বলে অভিহিত করেন। "আমি খুবই ছোট একটি কাজ শুরু করেছিলাম। কখনোই আশা করিনি তার প্রভাব এতো বিশাল হবে। আসলে খুব ছোট কিছুও মনের উপরে অনেক বড় প্রভাব তৈরি করে দিতে পারে," বলেছেন ডা. রাখ।
নিজের ব্যাপারে বলতে গিয়ে ডা. রাখ জানান, প্রথমে তিনি কখনোই ডাক্তার হতে চাইতেন না। তিনি সবসময় একজন কুস্তীগির হবার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি বলেন, "আমার মা অলকা শাহজি খালসে আমাকে সবসময় এক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতেন।
তিনি বলতেন যে কুস্তীগির হলে আমি অন্য সকলের খাবার একাই খেয়ে ফেলব।" তার বাবা আদিনাথ ভিঠাল রাখ পেশায় ছিলেন একজন কুলিমজুর। অন্যদিকে মা অন্যের বাসাতে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতেন। দুইজনের এই স্বল্প আয়ে ডা. রাখ এবং তার দুইভাইসহ পরিবারের পাঁচজনের খাওয়া কোনমতে জুটে যেত। ছোটবেলা থেকে বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন বলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হবেন তিনি।
ডা. রাখ শুরুর দিকে যখন এমন চমৎকার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, তার পরিবারের সকলেই দুশ্চিন্তাতে পড়ে গিয়েছিল। কারণ, ডা. রাখ নিয়েই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না সে সময়ে। ডা. রাখের স্ত্রী ত্রুপ্তি রাখ বলেন, "আমরা অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিলাম না।
যে কারণে, তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানার পর আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, কীভাবে নিজের ঘরের খরচ চালাবো।" এ সময়ে সাহস ও সমর্থন দেওয়ার জন্য তার বাবা পাশে এসে দাঁড়ান। এমনকি, ছেলেকে সাহায্য করার জন্য তার পুরনো পেশা কুলিমজুর হতেও তার আপত্তি ছিল না! এখন ডা. রাখ কে নিয়ে তার পুরো পরিবারের মানুষ গর্বিত এবং তাকে সকল ক্ষেত্রেই সমর্থন করেন।
ডা. রাখ জানান, তিনি সকলের আচরণকে বদলে দিতে চান। তিনি বলে, "যেদিন কন্যা সন্তানের জন্ম নিয়ে সকলেই আনন্দিত হবেন সেদিন থেকে আবারও বিল গ্রহণ করা হবে।" এরপরে কিঞ্চিৎ মজা করে তিনি বলেন, "বিল ছাড়া কীভাবে আমার হাসপাতাল চালাবো আমি?"
বিবিসি নিউজ