হাওলাদার জহিরুল ইসলাম : তাবলিগের মূল মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিনের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভির নেতৃত্ব ও তার কিছু বক্তব্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামাতে অস্থিরতা চলছে বেশ কিছু দিন ধরে।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল দেওবন্দও মাওলানা সাদ কান্ধলভির কিছু বক্তব্যের ব্যাপারে আপত্তি করেছে। যদি তারা তার আমির থাকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করে নি।
দারুল উলুম দেওবন্দ দাবি করেছে মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে প্রকাশ্যে তার বক্তব্য প্রত্যাহার বা রুজুর ঘোষণা দিতে হবে। গত ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল দারুল উলুম দেওবন্দে পৌঁছালে দেওবন্দ তাদের দাবির পুনরাবৃত্তি করে।
সে প্রেক্ষিতে গতকাল ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল দিল্লির নিজামুদ্দিন যান এবং দেওবন্দের বক্তব্য তুলে ধরেন। তখন দিল্লির মারকাজে মাওলানা সাদ নিম্নোক্ত বয়ান প্রদান করেন।
তার দেয়া ৮ মিনিটের ভাষণের হুবহু অনুবাদ তুলে ধরা হলো,
‘আমার প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! ইলম হলো আমলের মাপকাঠি। ইলমই আসল, উম্মতের কায়েদ-নেতা। নিজের সমস্ত কথা ও কাজকে ইলম ও উলামদের সামনে পেশ কর। উলামগণ ইমাম ও নেতা আর উম্মত মুক্তাদি।উলামাগণ অনুসরণীয় এবং উম্মত অনুসরণকারী।
উলামায়ে কেরাম এ কারণে অনুসরণীয় যে, ইলমই হলো আসল ইমাম এবং সব কথা, কাজ ও আমলই ইলমের অধীন।আমাদের প্রতিটি কথা, কাজ ও আমলের ক্ষেত্রে; মোট কথা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে উলামাদের রাহবারি ও তাদের দিক নির্দেশনা মেনে গ্রহণ করা আমাদের কর্তব্য। এটাই হলো মৌলিক কথা।কেননা, ইলম ছাড়া অন্য সবই মুর্খতা এবং পথভ্রষ্টতা।
তাই আমাদের সব কথা, কাজ ও বয়ানে দেখা উচিৎ এ ব্যাপারে উলাময়ে কেরাম কী বলেন।
সাহাবায়ে কেরাম ও খোলাফায়ে রাশেদিন এ বিষয়ে সর্বাধিক ভয় করতেন। তারা নিজেদের আমলের তুলনায় তা কবুল হওয়ার ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব দিতেন যে, আমার এ কথা ও কাজ ইলম অনুযায়ী হচ্ছে নাকি ইলমের পরিপন্থী হচ্ছে।
আামি ভূমিকা স্বরূপ কথাগুলো এজন্য আরজ করছি যে, কখনো কখনো বয়ানের মধ্যে এমন জিনিস এসে যায় যা কোন না কোনভাবে আম্বিয়া আ. এর পবিত্রতা, সম্মান ও মর্যাদার পরিপন্থী।
যেমন আমার বিষয়টিই বলছি, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বয়ানে হজরত মুসা আ. এর প্রসঙ্গ এসেছে। বিশেষত তার ব্যক্তিগত (ইনফেরাদি) আমলে লিপ্ত হয়ে যাওয়া।এ ব্যাপারে বয়ান করা হয়েছে। এমন যে কোন কথা যার দ্বারা আাম্বিয়া আ. এর বড়ত্ব, মাহাত্ম্য, মর্যাদা ও তাদের ওপর অর্পিত আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্বের ব্যাপারে সামান্য সন্দেহের সৃষ্টি করে তা থেকে সর্বাবস্থায়ই রুজু করা উচিৎ।
এ ঘটনায় যেহতেু নিশ্চিতভাবে এদিকে ইঙ্গিত আছে যে মুসা আ. তার স্বীয় জাতি থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার কারণে তার জাতি গোমরাহ হয়ে যায়।(নাউযু বিল্লাহ) এগুলোর বয়ান করা বা এর পক্ষে দলিল পেশ করা উচিৎ। বরং সর্বদা এ ধরনের কথা পরিহার করা উচিৎ।
এ ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই যে আম্বিয়া আ. তাদের ওপর অর্পিত দু’টি দায়িত্ব তথা দাওয়াত ও ইবাদত পূর্ণভাবেই আদায় করেছেন। এ কথার সামান্য সন্দেহও হওয়া উচিত নয় যে, কোন একটি ক্ষেত্রে তাদের ত্রুটি বা কমতি ছিলো।
তাই বয়ানের মধ্যে কোথাও যদি এ ধরনের কথা এসে থাকে তাহলে আমি তার থেকে রুজু করছি এবং এ ব্যাপারে অন্যদেরও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ।
সাহাবায়ে কেরাম ফতোয়া দেয়া বা কোন বিষয়ে উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে কতোই না সতর্কতা অবলম্বন করতেন!
দ্বিতীয় কথা হলো, এ কথার সমর্থন বা এ কথা সাব্যস্ত করার কোন ধরনের চেষ্টা করা এটাও একটি ভুল। যা ভুল তা ভুলই।সুতরাং এসব বিষয়ে বিশ্বাসগত (এ’তেকাদান) ও স্বীকারোক্তিমূলক (কওলান) উভয় দিক থেকেই রুজু করা উচিৎ।
ভাইয়েরা আমার! ভালো করে শুনে নিন! আমি তো বলি, আল্লাহ তায়ালা উলামায়ে কেরামকে উত্তম বিনিময় দান করুন। কেননা, এ ধরনের ভুলের ক্ষেত্রে তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকেন।
সুতরাং এ কথা খুব ভালো করে স্মরণ রাখবেন, উলামাদের এমন দৃষ্টি আকর্ষণ করা বা সতর্ক করার ক্ষেত্রে তাদেরকে নিজেদর প্রতি অনুগ্রহকারী স(মুহসিন) মনে করবেন। নিজের কথা সাব্যস্ত করতে গিয়ে তাদেরকে প্রতিপক্ষ মনে করা চরম মুর্খতা ও বোকামি।উলামাদেরকে সর্বদা মুহসিন মনে করুন। আর এ কথা তো সর্বজন বিদিত যে, যিনি ভুল ধরে দেন তাকে সব সময় অনুগ্রহকারী মনে করা উচিৎ।
সাহাবায়ে কেরাম তো ভুল ধরে দেয়ার জন্য লোক নির্দিষ্ট করে রাখতেন।হজরত মুআবিয়া রা. পরপর চার জুমায় এ ঘোষণা দেন যে (গনিমত বা বাইতুল মালের) সম্পদ আমার।আমি যাকে ইচ্ছে দিবো, যাকে ইচ্ছা দিবো না। চার জুমা পার হয়ে গেলেও কারও এই হিম্মত হয়নি যে তার এ কথার ভুল ধরে দেবেন।
পরবর্তী জুমায় ঠিকই এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে হজরত মুয়াবিয়ার কথা প্রতিবাদ করে বললেন, যে আমিরুল মুমিনিনের কথা সঠিক নয়।সম্পদ তো আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের।তাদের হুকুম অনুযায়ী-ই সম্পদ খরচ হবে।
হজরত মুয়াবিয়া রা. নামাজের পর তাকে নিজ কামরায় ডেকে পাঠালেন। তখন উপস্থিত সবাই ভাবছিলো এই বুঝি তার ওপর উত্তম মাধ্যম শুরু হবে! কেন সে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলো।
কিন্তু ওই ব্যক্তি ভেতরে গিয়ে ভিন্ন চিত্রই দেখতে পেলো। হজরত মুয়াবিয়া রা. তাকে বললেন, ‘আহইয়ানি আহইয়াকাল্লাহু।’ সে তো আমাকে শুদ্ধ জীবন দিয়েছে আল্লাহ তাকে শান্তি ও নিরাপদে রাখুন।আমি যেনো মরতে বসেছিলাম।
উম্মতের যে মহান যিম্মাদরি আমার ওপর রয়েছে কেউ যদি আমার ভুল না ধরে দেয় তাহলে এর মধ্যে কোন কল্যাণই থাকতে পারে! তারা এভাবেই এমন ব্যক্তি তৈরি করতেন যারা তদের ভুলগুলো শুধরে দেবেন। যার ফলে হজরত মুয়াবিয়া রা. চার জুমায় একই ঘোষণা করেছেন।
যাতে কেউ তার ভুল ধরিয়ে দেয়। তাই যেসব উলামা তোমাদের ভুল ধরিয়ে দেন তাদেরকে অনুগ্রহকারী মনে করুন। আল্লাহ আহলে হক উলামাদের উত্তম প্রতিদান দিন। তারা এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে সতর্ক করে আসছিলেন। যা বর্ণনা করলে আম্বিয়া আ. এর সত্তা, পবিত্রতা ও মর্যাদায় সামান্যতম আঁচড় লাগে।ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়।’
উল্লেখ্য, মাওলানা সাদ কান্ধলভির রুজু সংক্রান্ত বক্তব্যের ব্যাপারে আওয়ার ইসলামের দেওবন্দ প্রতিনিধি দারুল উলুল দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এখনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হন নি।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুকের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা পারস্পারিক পরামর্শের ভিত্তিতে তার বক্তব্য দেওবন্দের নিকট পেশ করবো। দেওবন্দের বক্তব্যের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
মাওলানা সাদ কান্ধলভীর উপর এখনও আস্থাশীল নয় দারুল উলুম দেওবন্দ