তাওহীদ মাদানী
দেওবন্দ থেকে
নিজামুদ্দিনের পরিবর্তে দেওবন্দ গেলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল
তাবলিগের নেতৃত্ব নিয়ে চলমান সংকট নিরসন ও বিবাদমান দুটি গ্রুপের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম ও কাকরাইল শুরার একটি প্রতিনিধি দল গতকাল স্থানীয় সময় রাত সাড়ে এগারটায় টায় দেওবন্দে পৌঁছেছেন।
গতকাল সকাল ১০.১৫ মিনিটে তারা দিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।
প্রতিনিধি দলের দিল্লির মারকাজ নিজামুদ্দিনের মেহমান হওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণবশত তারা নিজামুদ্দীন মারকাজে না গিয়ে প্রথমে দেওবন্দে যান এবং সেখানে রাতে অবস্থান করেন।
যারা আছেন প্রতিনিধি দলে
প্রতিনিধি দলে রয়েছেন, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, কাকরাইলের শুরার মুরব্বি মাওলানা যুবায়ের আহমদ, কাকরাইল শুরার মুরব্বী সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, কাকরাইলের কারী মাওলানা যুবায়ের আহমদ ও কাকরাইলের মাওলানা জিয়া বিন কাসেম।
ভারত সফরের উদ্দেশ্য
প্রতিনিধি দলের কাছে তাদের ভারত সফরের কারণ জানতে চাওয়া হলে দেওবন্দে অবস্থানরত আওয়ার ইসলাম প্রতিনিধিকে তারা জানান, তাবলিগ জামাতের দিল্লি মারকাজের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভীর কিছু বয়ান ও মতামতের ব্যাপারে যে আপত্তি উঠেছে সে বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের মতামত নিতেই তারা দেওবন্দ এসেছেন।
এছাড়াও ইজতেমায় ভারতের তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বিদের অংশগ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির করার চেষ্টা করবেন তারা।
মাওলানা মাহফুজল হক আওয়ার ইসলামকে জানান, বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, উলামায়ে কেরাম এবং কাকরাইলের শুরার সমন্বিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুটি বিষয়কে সামনে রেখেই আমরা ভারতে এসেছি।
১. মাওলানা সাদের রুজুনামা বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের স্পষ্ট মতামত জানা। প্রতিনিধি দলের দেওবন্দের শীর্ষ উলামা ও মুরব্বিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা । মাওলানা সাদের বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দ আশ্বস্ত কিনা তা সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া।
২. এরপর আগামী জানুয়ারিতে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় উভয় ধারার শীর্ষ মুরব্বিদের উপস্থিত থাকার মতো পরিবেশ তৈরি করা।
মাওলানা সাদ, মাওলানা আহমদ লাট ও ইবরাহিম দেওলাসহ শীর্ষ মুরব্বিদের অংশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে এটাই আমাদের আশা। তবে দেওবন্দ মাওলানা সাদের ব্যাপারে অনাস্থা প্রকাশ করলে তিনি হয়তো অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
শেষরাতে বৈঠক
প্রতিনিধি দল দেওবন্দ পৌঁছানোর পরপরই দারুল উলুম দেওবন্দের দায়িত্বশীল শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিলো। কিন্তু প্রতিনিধি দলের সফরের ক্লান্তির দরুন তা হয়নি।
বিশ্রামের পর ফজরের পূর্বেই প্রতিনিধি দল দেওবন্দের মুহতামিম মুফতী আবুল কাসেম নোমানী এবং দেওবন্দের সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন৷
দীর্ঘক্ষণ বৈঠকের পর প্রতিনিধি দল দেওবন্দের প্রধান শিক্ষক (সদরুল মুদাররিসিন) মুফতী সাঈদ আহমাদ পালনপুরীসহ অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
মাওলানা সাদ কান্ধলভীর উপর আস্থাশীল নয় দেওবন্দ
বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, আল্লামা আরশাদ মাদানী আমাদেরকে জানিয়েছেন, দেওবন্দ এখনও মাওলানা সাদ কান্ধলবীর উপর আস্থাশীল নয়৷ কারণ মাওলানা সাদ আজ পর্যন্ত একবারও স্পষ্ট শব্দে রুজু করেন নি৷ দেওবন্দ তাকে প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করে ঘোষণা দিতে বলেছিলো।আজ পর্যন্ত তা করেন নি।
এ বিষয়ে মাওলানা যুবায়ের আহমদ বলেন, ‘আমাদেরকে দেওবন্দের মুহতামিম মুফতী আবুল কাসেন নোমানী বৈঠকের মাঝে বলেছেন, আমরা দেওবন্দের পক্ষ থেকে মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে বলেছিলাম, আপনি যেভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মজমায় মুসা আ. এর উপর অপবাদ আরোপ করেছেন তদ্রূপ উক্ত বিষয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে রুজু করতে হবে৷ তবেই দেওবন্দ আপনার রুজু মেনে নিবে। কিন্তু প্রায় এক বছর কেটে গেলেও আমাদের কাছে তার এমন কোনো রুজুর খবর পৌঁছে নি৷ তাই লিখিত রুজুনামা দিলেও তা গ্রহণ করেনি দেওবন্দ। দেওবন্দ তার নিজস্ব সিদ্ধান্তে এখনো অটল।’
রুজুনামা গ্রহণের খবর ভিত্তিহীন
প্রতিনিধি দলের সদস্য জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুফতী উবায়দুল্লাহ ফারুক জানান, দেওবন্দের শায়খুল হাদীস মুফতী সাঈদ আহমাদ পালনপুরী আমাদের বলেছেন, ‘মাওলানা সাদ কান্ধলবীর মনগড়া মতবাদের ব্যাপারে দেওবন্দ তার পূর্বের সিদ্ধান্তেই অটল৷ তিনি নবীর শানে বেয়াদবী করেছেন৷ এ থেকে উত্তরণের পথ তার বেছে নেয়া উচিৎ৷ তিনি তা না করায় দেওবন্দের পক্ষ থেকেও মাওলানা সাদ কান্ধলবীর অস্পষ্ট শব্দের লিখিত রুজুনামা মেনে নেয়া হয়নি৷ আর দেশব্যাপী যে প্রচারণা চালানো হয়েছে যে দেওবন্দ তার রুজুনামা গ্রহণ করেছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন৷’
লিখিত নোটিশ দিয়েছে দারুল উলুল দেওবন্দ
দেওবন্দের মুহতামিম মুফতী আবুল কাসেম নোমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাংলাদেশ থেকে দেওবন্দে যে প্রতিনিধি দল এসেছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল মাওলানা সাদ কান্ধলবীর ব্যাপারে দেওবন্দের মতামত যাচাই করা৷
আমরা প্রতিনিধিদেরকে জানিয়ে দিয়েছি, দেওবন্দ মাওলানা সাদের উপর আস্থাশীল নয়৷ আমরা বিষয়টি প্রতিনিধিদের কাছে লিখিত নোটিশ আকারে দিয়ে দিয়েছি৷
তবে লিখিত নোটিশে কী আছ সে ব্যাপারে মাওলানা মাহফুজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি৷ তিনি বলেছন, বিষয়টি আমরা পরামর্শের মাধ্যমে প্রকাশ করবো।
আজ যাবেন নিজাজুদ্দিন, কাল গুজরাট
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল আজ দেওবন্দে তাদের নির্দিষ্ট কাজ শেষ করে রওয়ানা হবেন তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ নিযামুদ্দীনের পথে৷ সেখানে রাতে অবস্থান করবেন এবং বৈঠক করবেন মাওলানা সাদ কান্ধলবীর সঙ্গে৷
আগামীকাল তারা গুজরাট যাবেন৷ গুজরাটে সাক্ষাৎ করবেন মাওলানা ইবরাহীম দেওলার সঙ্গে৷ সেখানেও প্রয়োজনীয় আলোচনা সেরে রওয়ানা হবেন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে৷
মাওলানা সাদের টঙ্গী ইজতেমায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে মন্তব্য করতে চায় না দেওবন্দ
অন্যদিকে প্রতিনিধি দল ও কাকরাইল শুরার সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম আওয়ার ইসলামকে ভয়েস বার্তায় বলেন, আমরা সরাসরি দারুল উলুম দেওবন্দে যাই। ফজরের সময় দেওবন্দের মুহতামিম মুফতী আবুল কাসেম নোমানী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস সাইয়েদ আরশাদ মাদানীর সঙ্গে বৈঠক হয়।
সেখানে আমরা তাদের জিজ্ঞেস করি, মাওলানা সাদ বাংলাদেশের টঙ্গী ইজতেমায় অংশগ্রহণ করলে আপনাদের কোনো আপত্তি আছে কি? তারা বলেন, আমরা এগুলোর পেছনে পড়তে চাই না।এটা একান্তই তাবলিগের দুই পক্ষের ব্যাপার। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই এবং এ বিষয়ে কিছু বলতেও চাই না।
মাওলানা সাদ-এর বয়ান, বক্তৃতা ও দারুল দেওবন্দের ইতমিনান বা সন্তুষ্টির ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন আমরা তাকে বিভিন্নি সভা-সমাবেশে এবং বয়ানে ই’লান (ঘোষণা) করতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি কোথাও কোনো ই’লান করেন নি। তাই আমরা তার উপর সন্তুষ্ট হতে পারছি না।
তার পক্ষ থেকে কেউ কেউ কোনো কোনো বিষয়ে দলিল প্রমাণ দেয়া বা স্পষ্ট করার চেষ্টা করছে। আমরা মনে করেছিলাম তিনি নিজেই বিষয়গুলো তাওজিহ বা স্পষ্ট করবেন অথবা বিষয়গুলো অস্বীকার করে রুজু করবেন।
সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বলেন, আমি বললাম তিনি যদি কোনো মজমা বা সভা-সমাবেশে এসব বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা করেন তাহলে আর কোনো অসুবিধা থাকবে? দেওবন্দের দায়িত্বশীলরা বলেন, তিনি যদি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।
এসব বিষয়ে দেওবন্দ আমাদের প্রতিনিধি দলকে একটি লিখিত পত্র দিয়েছে। আমরা তা নিয়ে নিজামুদ্দিন যাচ্ছি। আশা করছি, মাওলানা সাদ এক বা একাধিক বৈঠকে বিষয়গুলো স্পষ্ট করে দিবেন।
উল্লেখ্য, গত ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকাররে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসভবনে আলেম-উলামা ও কাকরাইলের মুরব্বিদের সমন্বিত বৈঠকে সঙ্কট নিরসনে ৫ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়।
কমিটিতে রয়েছেন,
১. মজলিসে দাওয়াতুল হকের আমির, গুলশান আজাদ মসজিদের খতিব মহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান।
২. কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি ও জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগের মুহাতামিম আল্লামা আশরাফ আলী
৩. জামিয়া ইকরার শায়খুল হাদিস ও শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
৪. জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদের মুহতামিম মাওলানা আবদুল কুদ্দুস,
৫. মারকাজুদ দাওয়াহর আমিনুত তালিম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
অতপর এ কমিটি গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় আলেম-উলামা ও কাকরাইলের শুরার সদস্যদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকে কাকরাইলের শুরাসহ সর্বসম্মতিক্রমে এই ৫ জন আলেমকে উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়।
এইচজে