হাসিব আর রহমান
লেখাটা একটা মজার গল্প দিয়ে শুরু করি, এক মহিলা প্রচুর স্বামীভক্ত। স্বামীর নাম রহমাতুল্লাহ! মহিলা কোত্থেকে যেন শুনেছে স্ত্রীর জন্য স্বামীর নাম মুখে নিতে নেই। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর সালাম ফেরাতে গিয়ে তো তাকে ‘রহমাতুল্লাহ’ বলতেই হবে কিন্তু কিভাবে সে এই নাম নেবে বলেন! তাঁই একটা সুন্দর বিকল্প ব্যাবস্থা করে নিয়েছে বুদ্ধিমতী ঐ স্ত্রী।
প্রতি ওয়াক্তে নামাজের পর সালাম ফেরাতে গিয়ে সে ‘আসসালামু আলাইকুম' এর পর ‘অরহমাতুল্লাহ' না বলে ‘আসসালামু আলাইকুম আমগো ঘরের উনি’ বলে!!
গল্পটার সাথে বর্তমান বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মিল যে কতটা তা শেষে বুঝতে পারবেন আশা করি।
গত দিন তিনেক আগে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হয়ে গেলো। বিগত সংসদ নির্বাচনের আগে সারা বাংলাদেশে হাসির খোরাক বনে যাওয়া এরশাদ সাহেবের দল জাতীয় পার্টি বড় দানের একটি বিজয় পেয়েছে সেখানে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ রকমের আত্মতৃপ্তিতে ভূগতে থাকা আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেখানে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবধানে হেরেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করা আমি জানতামই না বাংলাদেশের কোন যায়গায় এত ব্যাবধানে আওয়ামী লীগ এমনকি বিএনপিরও পরাজয় হতে পারে।
পরাজয়টা অস্বাভাবিক লাগেনি বরং ব্যবধানটা অস্বাভাবিক লেগেছে। বিএনপি তো বাদই দিলাম আওয়ামী লীগই জাতীয় পার্টির চেয়ে অর্ধেকেরও অনেক কম ভোট পেয়েছে সেখানে।
বিএনপির ভোট সংখ্যা তো জাতীয় পার্টির প্রার্থীর তুলনায় পাঁচ ভাগের এক ভাগও না। এই ব্যবধানটাতে কিছুটা অবাক লেগেছে। তবে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অভাবনীয়ভাবে জোর কদমের একটা ‘পায়ের আওয়াজ’ দিয়েছে এদেশের পরিচিত একটি ইসলামি রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
প্রথম আলোর ভাষায় যে সংগঠনের নাম হলো, বরিশাল ভিত্তিক চরমোনাই সিলসিলা!! রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এই সংগঠনের মনোনীত প্রার্থীর ‘হাতপাখা' প্রতীকের ভোট সংখ্যা ছিলো চব্বিশ হাজার ছয় (২৪,০০৬) ভোট। যে সংখ্যাটা নতুন কারো জন্য চমকে দেয়ার মতই।
ভেতরে ভেতরে অনেকেই যে চমকে গেছে তা একাত্তর টিভির ‘একাত্তর জার্নাল অনুষ্ঠানসহ’ অনেক গনমাধ্যমের মিনমিনে চমকানো অবস্থায় বুঝা গেছে। প্রথম আলোর নির্বাচন বিশ্লেষণ দেখেও কিছুটা আঁচ করা গেছে যে তারাও কিছুটা চমকানো অবস্থায় আছে।
তবে চমকানোটার ধরণটা বেশ আলাগ হয়েছে তাদের। অবশ্য কিছুটা দৈন্যতার প্রমাণ রেখেছেন তারা। যে বিষয়টাই এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য।
খোদ নির্বাচন নিয়ে যদি কিছু বলতে হয় তবে বলতেই হবে রসিক নির্বাচন বস্তুত সুষ্ঠই হয়েছে, বাংলাদেশের অন্যান্য নির্বাচনের মত রসিকতা তেমন হয়নি। কারণ বিএনপি তাদের গতানুগতিক রাজনৈতিক অভিযোগ ছাড়া তেমন কিছু বলেনি বরং তারা অনেকটা আনন্দিতই তাদের ভোট সংখ্যায়!!
মিডিয়াও তেমন কোন নেগেটিভ কথা ছড়াতে পারেনি সর্বোপরি সোস্যাল মিডিয়ায় যেহেতু রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন নেগেটিভ মন্তব্য আসেনি সে হিসেবে নির্বাচনটা সুষ্ঠই হয়েছে বলা চলে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তো আরো একধাপ এগিয়ে ভোট গননার মাঝপথেই পরাজয় মেনে নিয়ে উন্নত (!) গণতন্ত্রের উদহারণ রাখতে চেয়েছে। আমেরিকার নির্বাচনে হিলারি যেটা করছিলো আর কি! এই উন্নত গণতন্ত্রের উদহারণ রাখতে চাওয়া, নির্বাচনে তেমন কোন হস্তক্ষেপ না করা এটা যে হরিণ দেখিয়ে বাঘ শিকারের কৌশল তা যে কোন কেহই বুঝতে পারবে।
বাঘ বলে আগামী সংসদ নির্বাচনকেই বুঝানো হয়েছে। সে যাত্রায় কে কতটুকু সফল হবে না হবে তা সময় বলে দেবে। এবং সেগুলো নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি যারা করে তাদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা চিন্তা আসতে পারে কিন্তু যাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা নয় তাদের অন্তত আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আগে এসবের ব্যাপারে চিন্তা করার খুব একটা প্রয়োজন দেখি না।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একটি ইসলামি দলের এককভাবে এমন অভাবনীয় সাফল্য রাজনীতি সচেতন যে কোন কারোরই পিলে চমকে দেবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেই বেশ খানিকটা অবাক হওয়ার পর্যায়ে গিয়ে এই সফলতাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
দেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যম চরম দৈণ্যতার সাথে হলেও ব্যাপারটাকে মূল্যায়ন করেছে এভাবে, ... “এই নির্বাচনে একটি ইসলামপন্থী দলের প্রার্থী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে ভালো করেছেন। চরমোনাই-ভিত্তিক একটি ইসলামি সিলসিলা বরিশাল অঞ্চলে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে আছে। কিন্তু তাদের একজন প্রার্থী যে রংপুরে ২০ হাজার ৬ ভোট পেতে পারেন, সেটি সত্যি অভাবনীয়। এই ‘অগ্রগতিতে’ পায়ের আওয়াজ কেউ পাবেন কি না কেউ জানি না, তবে রংপুরের আগেকার ইতিহাসে এমনটা ঘটেনি”।
এই বিশ্লেষণের দুইটা পয়েন্ট নিয়ে যদি কথা বলা হয় তবে তা প্রথম আলোর দৈন্যদশার সাংবাদিকতার একটা প্রমাণ বহন করে। আর একটা পয়েন্টে বুঝা যায় তারা বেশ ভয় পাওয়ার অবস্থায় আছে! “পায়ের আওয়াজ”টা তারা পাচ্ছে বেশ!!
প্রথমত: চরমোনাই ভিত্তিক একটি ইসলামি-সিলসিলা বরিশাল অঞ্চলে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে আছে তারা কিভাবে বরিশাল থেকে এত (গুগল মানচিত্র অনুযায়ী রংপুরের দুরত্ব প্রায় ৫১২ কিলোমিটার) দূরে গিয়ে এমন অভাবনীয় সফলতা পেলো। তাদের কাছে এই ভোটপ্রাপ্তি যেন বরিশাল ভিত্তিক আঞ্চলিক এক সিলসিলার প্রাপ্তী।
যদি তারা এভাবে বিচার না করে এদেশের ত্রিধারার একটি সংগঠন হিসেবে ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র নাম নিয়ে সঠিক মূল্যায়নটা করতো তবে অবাক হওয়ার কিছু ছিলো না কারণ এ সংগঠনের অবস্থান সারা বাংলাদেশে এখন আর বরিশাল ভিত্তিক আঞ্চলিকতায় নেই।
রাজনৈতিকভাবে তারা তাদের অবস্থান একটু একটু করে জানান দিয়েই যাচ্ছে যা বিগত হওয়া প্রতিটা সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য নির্বাচনে ভোটের সংখ্যার দিকে তাকালেই বুঝা যায়। এই ভোটপ্রাপ্তীকে তারা কেমন যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়া মনে করেছে অথচ সংগঠনের আশা এবং প্রচেষ্টা ছিলো ভোট প্রাপ্তী ত্রিশ হাজার ছাড়াবে এবং সেভাবেই তারা গণসংযোগ করেছিলো।
সবচেয়ে মূল পয়েন্ট হলো, ... দেশের প্রচলিত ধারায় অর্থ বা প্রভাব ছড়িয়ে তাদের ভোট কালেক্ট হয় না। তাদের ভোট প্রাপ্তী পুরোটাই হয় একদম সাদামাটাভাবে। যেখানে থাকে স্বচ্ছ রাজনীতির একটা সুন্দর পরশ। যে পরিমাণ অর্থ আর মিডিয়া সাপোর্ট অন্যান্য দল পায় তার সিঁকিভাগও যদি এই সংগঠন পেতো তবে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যা হতো তাতে সাংবাদিকগণ কেবল ‘পায়ের আওয়াজ’ই না স্পষ্ট তুফানের আওয়াজ পেতো।
দ্বিতীয়ত: পত্রিকাটি এ সংগঠনের নাম নিতেই কেবল কার্পণ্য করেননি তাদের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা বর্ণনাতেও অসত্যের আশ্রয় নিয়েছে। কিভাবে যেন তারা চার হাজার ভোট কমিয়ে ফেলেছে নিমিষেই! ভোট পেয়েছে চব্বিশ হাজার ছয় (ভেতরে কথা আরো আছে) কিন্তু তারা বলছে বিশ হাজার ছয় ভোট!
কেন? এটা যে কতটা অস্বচ্ছ সাংবাদিকতা তা তাদের লজ্জা থাকলে ঠিকই বুঝতো। সংগঠনের নাম না হয় তারা ওই পতিভক্ত স্ত্রীর অনুসরণে নেয়নি কিন্তু ভোট সংখ্যা কেন কমিয়েছে তা জানা নেই। এটাকে তাদের ভয়ের অংশ হিসেবেই নিচ্ছি।
তৃতীয়ত: এই ‘অগ্রগতিতে’ পায়ের আওয়াজ কেউ পায়নি কেবল আপনারাই পেয়েছেন এটা ভাবাটা ভুল। এই পায়ের আওয়াজ সাধারণ জনগন অনেক আগেই পেয়েছে বলেই অগ্রগতিটা এমন হয়েছে। আওয়াজটা বরং আপনারাই অনেক দেরিতে পেয়েছেন। এখন সেই আওয়াজটা গনমাধ্যম হিসেবে জন-গণের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটা পালন করবেন আশা করি।
এই পায়ের আওয়াজ দিনে দিনে আরো বাড়ছে.. ব্যাপক আকারেই বাড়ছে এটা স্পষ্ট করেই বলে দেয়া যায়।
লেখার মুল পয়েন্ট: ...সংবাদ মাধ্যমের এই এগিয়ে আসাটা সংগঠনের জন্য নতুন করে অনেক কিছু ভাবাতে বাধ্য করবে। কিছু ব্যাপারে পুর্ণ সতর্কতা অবলম্বন এখন অনেক বেশি প্রয়োজনের হয়ে দাঁড়াবে।
একাত্তর জার্নালে একজন উজবুক বহুত চেষ্টা করছে জামায়াতের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রমাণ করতে কিন্তু সেটা পেরে উঠেনি বেচারা। এমন অনেক ‘মিডিয়া আঘাত’ ধারাবাহিকভাবে এখন আসবে।
ওরা এই ‘পায়ের আওয়াজ’ স্বাভাবিকভাবে নেবে বলে মনে হয় না। বামরা নড়েচড়ে বসবে এখন। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং স্ট্রং নেতৃত্বের সাথে বুদ্ধিভিত্তিক এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
[video width="400" height="224" mp4="http://ourislam24.com/wp-content/uploads/2017/12/isha.mp4"][/video]