পীর যুলফিকার আহমাদ নকশবন্দী
দুনিয়া হলো হক আদায়ের স্থান। এখানে মানুষকে পাঠানো হয়েছে হক আদায়ের জন্য। হক দুই ভাগে বিভক্ত। আল্লাহর হক। বান্দার হক। আমরা অনেকেই আল্লাহর হক আদায়ে যথাযথ চেষ্টা করলেও বান্দার হক আদায়ে অত্যন্ত গাফেল। এজন্য নামাজ-রোজা সহ অন্যান্য এবাদত ঠিক থাকলেও দেখা যায় সংসারে ও পরিবারে দারুণ অশান্তি। হাকিমুল উম্মত থানভি রহ, বলেছেন, দুনিয়াতে সবাই যদি আপন আপন হক আদায়ে তৎপর হয়ে যায় তাহলে আর অশান্তি থাকবে না।
আলোচনা করেছিলাম আদর্শ স্বামীর গুণাবলী নিয়ে। হাদিসের প্রায় সবগুলো কিতাবে স্বামীর উপর স্ত্রীর কী কী হক রয়েছে স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে। আদর্শ স্বামী হতে হলে সে হকগুলো আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। এজন্য কিছু গুণ অর্জন করতে হবে।
স্বামীর দশটি করণীয় নিয়ে পীরে কামেল মাহবুবে ওলামা যুলফিকার আহমাদ নকশবন্দী দশটি সোনালী গুণের কথা বলেছেন। যে গুণগুলো অর্জন করলে একজন স্বামী আদর্শ স্বামী হতে পারে। সে গুণগুলিই সংক্ষেপে উল্লেখ করছি
তিনি স্বামীদের উদ্দেশ্য করে বলছেন–
১. সবসময় মৃদু হেসে ঘরে প্রবেশ করবেন। এবং সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করবেন।
আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ঘরে প্রবেশ কালে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেন। এবং তার পবিত্র ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির ঝিলিক লেগে থাকতো। মনে রাখবেন সালাম মানে শান্তির দোয়া। আপনি তার জন্য শান্তির দোয়া করলে তিনিও আপনার জন্য শান্তির দোয়া করবেন। ফলে আল্লাহ উভয়ের উপরই শান্তি ও রহমত বর্ষণ করবেন।
আর ঘরের বাইরের ঝগড়া-কলহ, খারাপ হালত ও দুশ্চিন্তা বাহিরেই রেখে আসবেন। কারণ সেসবের কারণ আপনার স্ত্রী নয়। ঘরে সুন্দর মন ও মনন নিয়ে প্রবেশ করবেন। তাহলে দেখবেন আপনার দীলের অশান্তিও আল্লাহ দূর করে দিয়েছেন।
২. স্ত্রীর ভালো ও উত্তম কাজের প্রশংসা করবেন।
তার ভালো রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ভালো চিন্তা ও কথা ইত্যাদির প্রশংসা করবেন। কারণ সারাদিন যে মানুষটি আপনার ঘর গুছিযে রাখলো, সন্তানদের খাইয়ে-পড়িয়ে সুস্থ রাখলো, আপনার খাবারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে আগুনে পুড়ে রান্না করলো তার মন চায় আপনি একটু হলেও আপনি তার প্রশংসা করুন।
অনুগ্রহ ও ইহসানকারীর প্রশংসা করা মানে আল্লাহর প্রশংসা করা। হাদিসে এরশাদ হয়েছে- ‘যে অপরের প্রশংসা করে না, তার প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত হয় না সে যেন আল্লাহরও প্রশংসা করলো না, তার প্রতি কৃতজ্ঞ হলো না।
৩. স্ত্রীর কাজের প্রতি মনোযোগ দিন।
স্ত্রীর আরাম ও বিশ্রামের প্রতি লক্ষ্য রাখুন। শুধু নিজের আরাম নিয়েই ব্যস্ত খাকবেন না। কারণ তারও আরাম ও বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। সে আপনার চাকরানী নয়। আপনার অর্ধাঙ্গীনী। যতটুকু করছে ততটুকু তার পক্ষ থেকে ইহসান। তার কাজের প্রতি একটু মনোযোগ দিলেই সে খুশীতে বাগবাগ হয়ে যাবে।
নবীগণ স্ত্রীদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ রাখতেন। হযরত নবী মূসা আ, স্বীয় স্ত্রীর জন্য আগুন আনতে গিয়েই নবুওতের মর্যাদা লাভ করেছিলেন।
অনেক স্বামীই আছেন যারা শুধু তিনবেলা খেতে ও ঘুমোতে পছন্দ করেন। অথচ দেখা যায় রান্নাঘরে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে স্ত্রী রান্না করতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ছে। ঘরে প্রয়োজনীয় বস্তুর অভাবে ঘর গোছানো সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সেসব স্বামীরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।
খেয়াল করুন, আম্মাজান আয়েশা রা, নিজেই বলছেন, প্রিয় নবী সা, ঘরে সংসারের কাজ করতেন। তাহলে চিন্তা করে দেখুন এত বড় যিম্মাদারী আদায় করেও তিনি ঘরের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখেছেন।
৪. স্ত্রীকে মাঝে মাঝে উপহার দিন। গিফট দিন।
স্ত্রীর বলার আগেই তার প্রয়োজনীয় কোন বস্ত বা প্রিয় কোন বস্ত তাকে উপহার দিন। তার প্রিয় বস্তুটি যদি সে না চাইতেই তাকে উপহার দেন তাহলে দেখবেন তার খুশীর কোন সীমা থাকবে না। আর প্রয়োজনীয় বস্তু তো দিতেই হবে তাহলে ঝগড়া পর্যন্ত গড়ানোর কী মানে আছে!
উপহার দিলে ভালোবাসা বাড়ে। সম্পর্ক গাঢ় হয়। কারণ নবী কারিম সা, এরশাদ করেছেন, তোমরা পরস্পরকে হাদিয়া প্রদান করো। এর দ্বারা তোমাদের পরস্পরের ভালোবাসা ও হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
স্বামীর উপহার দামী না কম দামী তা নিয়ে সতী স্ত্রীর কোন মাথাব্যথা থাকে না। স্বামী উপহার দিয়েছে এটাই তার কাছে অনেক বড়।
৫. স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণ প্রকাশ করুন।
আচরণে বা উচ্চারণে এমন কিছু করুন যাতে স্ত্রী অনুভব করে আসলেও আপনি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। দুঃখের বিষয় হলো আজ আমরা স্বামীরা ঘরে এমন একটা পরিবেশ তৈরী করেছি যেন আমরা স্বৈরশাসক। স্ত্রীরা আমাদের হুকুমের গোলাম।
প্রিয়নবী সা, কত আবেগের সাথে স্ত্রীর প্রতি মুহাব্বত ও প্রেম প্রকাশ করতেন। আম্মাজান আয়েশা রা, যে পাত্রে পান করতেন নবীজী সা, সেই পাত্রেই একই স্থানে ঠোট লাগিয়ে পান করতেন। একই বালতির পানি দিয়ে একসাথে উভয়ে গোসল করতেন। প্রিয় স্ত্রী আয়েশা রা. কে মুহাব্বতের সাথে হুমায়রা বলে ডাকতেন। হুমায়রা অর্থ সুন্দরী।
অনেক স্বামী মনে করে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলে তারা মাথায় চরে বসবে- এটা ঠিক নয়। দ্বীনদার স্ত্রীরা কখনো স্বামীর মাথায় চড়ে বসে না।
৬. স্ত্রীর সাথে মনকাড়া কথা বলা। তাকে আকৃষ্ট করার মতো কথা বলা।
অপরের সাথে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সুন্দর কথা বলাকে হাদিসে সদকা বলা হয়েছে। রুক্ষ মেজাজ কর্কশ কণ্ঠ ইসলামী শিষ্টাচারের পরিপন্থী।
আমাদের প্রিয় নবী সা, স্ত্রীদের সাথে মনকাড়া কথা বলতেন। একবার তিনি আম্মাজান আয়েশা রা,এর দিকে ভালোবাসার হাসিমাখা চেহারায় তাকালেন। আম্মাজান বললেন, কী ব্যাপার? তাকিয়ে কী দেখছেন? হুজুর সা, বললেন, আয়েশা! তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে যেমন খেজুর মধুর সাথে মিশিয়ে খেতে ভালো লাগে। খুশীতে আম্মাজানের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনিও নবীজীকে বললেন, আপনাকেও আমার এতো ভালো লাগে যেমন মধু দিয়ে মাখন খেতে ভালো লাগে।
এছাড়াও আল্লাহর নবী সা, স্ত্রী আয়েশা রা,এর মন জয় করার জন্য দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন-এঘটনা আমাদের অনেকেরই জানা।
৭. স্ত্রীর সাথে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার আচরণ করা।
মনে রাখতে হবে মানুষ মাত্রেই ভুল। স্ত্রী সংসারের এতো কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে। এক্ষেত্রে তার দুয়েকটা ভুল হয়ে যেতে পারে। সেগুলোকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বড় ধরনের ভুল করলে শাসন করা যেতে পারে। ছোটখাটো ভুলের ক্ষেত্রে ক্ষমা করে হিতোপদেশ দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। শাসন করার ও শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকার পরও যখন কেউ ক্ষমা করে দেয় তার প্রতি অপরাধীর মর্যাদাবোধ বৃদ্ধি পায়। এবং তার প্রতি সে পূর্বের চেয়েও বেশি কৃতজ্ঞ হয়।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-দুনিয়াতে যে অপরকে ক্ষমা করবে আখেরাতে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করবেন।
৮. নিজেকে শরীয়তের অনুশাসন অনুযায়ী চালানো এবং সংসারেও শরীয়তের পরিপূর্ণ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা।
বলাবাহুল্য যে, শরীয়তের অনুশাসন ও নির্দেশনা মানলেই একজন মানুষ দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে সফল হতে পারবে। শরীয়ত ছাড়া কোন মুক্তি নেই। শরীয়ত না মানলে ভবিষ্যতে শুধু ধ্বংস ও বরবাদি।
অনেক পরিবারে স্বামী চায় স্ত্রী রাবেয়া বসরী হয়ে যাক। অথচ তার নিজের ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই।
এমন হলে সংসার কখনো শরীয়ত অনুযায়ী চলবে না। স্ত্রীকে শরীয়তের হুকুমের কথা বললে সে রেগে যাবে। স্বামীকে উল্টো ধমক দিবে- উহ্ নিজের নামাজ-কালামের খবর নাই আর আমাকে উপদেশ দিচ্ছে !
বর্তমানে পর্দা পালনের বিষয়ে স্বামীরা অনেক অবহেলা করে। ঘরে চাচাতো-ফুফাতো ভাইদেরকে অবাধে যাতায়াতের সুযোগ প্রদান করে। অথচ এটা শরীয়তের সম্পূর্ণ খেলাফ ও বিরোধী। সুতরাং নিজেকেও পুরাপুরিভাবে পর্দা মেনে চলতে হবে। স্ত্রীও যেন পূর্ণাঙ্গ পর্দা পালন করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৯. স্ত্রী যখন রাগ করবে স্বামী তখন আত্মসম্বরণ করবে। রাগ করা হতে বিরত থাকবে।
পরস্পরে সমঝতার ভিত্তিতে এই নিয়ম বানিয়ে নিবে যে, আমরা পরস্পরে একই সাথে রাগ করবো না। একজন রাগ করলে আরেকজন ধৈর্যধারণ করবে।
এক্ষেত্রেও আমাদের প্রিয় নবী সা,এর অনুপম আদর্শ রয়েছে। একবার আম্মাজান আয়েশা রা. রাগ করলেন। রাসূল সা. তখন আদর করে আয়েশা রা. এর কানে আল্ত করে ছোয়া দিলেন আর বললেন, হে ছোট্টমাণি আয়েশা! তুমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। এবং দোয়া করো- হে আল্লাহ! আপনি আমার ক্রোধ কমিয়ে দিন।
দেখুন স্ত্রীর রাগের সময়ও প্রিয় নবী সা. কী সুন্দর আচরণ করছেন। এবং উম্মতকে শিখিয়ে গিয়েছেন, রাগের সময়ও স্ত্রীর সাথে কেমন আচরণ করতে হবে। সুবহানাল্লাহ।
১০/ কখনো মনোমালিন্য হলে মিটমাট না হওয়া পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী শুতে যাবে না।
সংসারে কখনো বাকবিতন্ডা ও মতানৈক্য হওয়া অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। কিন্তু এটাকে জিইয়ে রাখা ক্ষতিকর। সুন্দর সংসারের জন্য বিদজ্জনক। যদি উভয়ে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে তখন থেকেই সংসারে বিশৃংখলার সূচনা হলো।
যা কিছুই হোক ঘুমানোর পূর্বে সমোঝতা করে নেয়া উচিত। রাগের অবস্থায় স্বামীর উচিত স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা আর স্ত্রীরও উচিত স্বামীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা। তাহলে সহজে সমাধান সম্ভব।
একটা কবিতা বলে ইতি টানছি–
অর্থ: ভালোবাসার জন্যই তো জীবনের মূহুর্তগুলো স্বল্প ও অপ্রতুল
ঘৃণার জন্য, ঝগড়ার জন্য সময় কই পায় মানুষ !!!!
সংকলনে: আব্দুল্লাহ তালহা
এসএস/