বিছানায় শুধু শোয়ার অপেক্ষা। কান পাততে হয় না, কিছুক্ষণ পরই কর্ণকুহরে আছড়ে পড়ে ‘খড়ড়ড়ড়, খড়ড়ড়ড়’। অনেকটা উচ্চাঙ্গসংগীতে বিভিন্ন রাগের অবরোহণ-আরোহণের মতো। হাজার হাঁকাহাঁকি-ডাকাডাকি করে জাগায় কার সাধ্য! অথচ এই মানুষটাই সারা রাত ‘সশব্দ নিদ্রা’ শেষে সকালে উঠে ভীষণ বিস্ময়ের সঙ্গে বলবে, ‘কে নাক ডাকে, আমি!’
আসলে ঘুমের মধ্যে যিনি নাক ডাকেন, তিনি টের পান না। এমন কারও সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোতে গেলে কিন্তু রাতের ঘুমের দফারফা! বিরক্তির একশেষ। হাসির খোরাক। কিছু ক্ষেত্রে ঈর্ষার পাত্রও। অনেকে ভেবে নেন, নাক ডাকা মানেই ভীষণ গভীর ও নিশ্চিত ঘুম। ভুল। বহু ক্ষেত্রেই নাক ডাকা মানে দৈহিক সমস্যার ‘সতর্কসংকেত’। শ্বাসযন্ত্র ও অন্য কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে মানুষ নাক ডাকতে পারে। চিকিৎসকেরা বলেন, নাক ডাকা নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিরও আলামত।
নাক ডাকার মধ্য দিয়ে শরীর জানিয়ে দেয়, ঘুম একেবারেই ভালো হচ্ছে না। ঘুমন্ত ব্যক্তির শ্বাসনালিতে বাতাসের যাতায়াত কোথাও বাধা পাচ্ছে। পরিণামে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়ে ঘুমের মধ্যে মৃত্যুও আশ্চর্য নয়! জেনে রাখা ভালো, নাক ডাকার আওয়াজটা আসলে নাক থেকে বের হয় না। এর উৎস গলা থেকে নাকের মধ্যবর্তী অংশে। নানা কারণে এ জায়গায় বাতাস যাতায়াতে বাধা পায় বলেই মানুষ নাক ডাকে। আসুন জেনে নিই নাক ডাকা থেকে মুক্তির কয়েকটি উপায়—
শোয়ার ভঙ্গি পাল্টান
আপনি কি চিত হয়ে ঘুমান? এভাবে ঘুমালে জিব কিছুটা পেছনে চলে গিয়ে শ্বাসনালি বন্ধ করে দেয়। এতে শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়ে শ্বাসযন্ত্রে কম্পনের সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষ নাক ডাকে। কাত হয়ে শোয়ার মাধ্যমে এ সমস্যা দূর করা যায়। কাত হয়ে শুতে সমস্যা হলে মাথার নিচে অতিরিক্ত বালিশ দিয়েও কাজ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির জেএফকে মেডিকেল সেন্টারের নিউরোফিজিওলজি ও স্লিপ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সুধাংশু চক্রবর্তীর পরামর্শ, চিত হয়ে শোয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে পায়জামায় কোমরের কাছে টেনিস বল রাখতে পারেন। এতে ঘুমের মধ্যে আপনা-আপনি চিত হয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পাবেন।
ওজন কমান
শরীরের অতিরিক্ত ওজন নাক ডাকার সাধারণ কারণগুলোর একটি। তবে শুকনো মানুষও কিন্তু নাক ডাকেন। যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটা প্রমাণিত যে শরীরের ওজন যত বেশি হবে, নাক ডাকার শঙ্কাও ততই বাড়বে। ঘাড়ের চারপাশের মেদ নাক ডাকার অন্যতম একটি কারণ। গলার ভেতরে অতিরিক্ত চর্বি জমলেও এটা হতে পারে। তবে এই অবস্থাটা মারাত্মক। কেননা, গলার মধ্যে চর্বি জমা মানে শ্বাসনালিতে বাতাস কম ঢুকবে। এতে শরীরে অক্সিজেনও কমবে। ৬০ শতাংশের নিচে অক্সিজেনের মাত্রা নামলেই ঘুমের মধ্যে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অ্যালকোহল ও ধূমপান পরিহার করুন
অ্যালকোহল কিংবা মদজাতীয় পানীয় জিবের পেশিগুলো শিথিল করে দেয়। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসের নালি সংকুচিত হয়ে পড়ে, ফলে মানুষ নাক ডাকতে পারে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে যাঁরা অ্যালকোহল পান করেন, তাঁদের নাক ডাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। রাতে ঘুমোনোর আগে অ্যালকোহল পান থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে এ সমস্যা দূর করা যায়।
অবশ্য শুধু অ্যালকোহল নয়, ধূমপায়ীদের মধ্যেও নাক ডাকার প্রবণতা সাধারণের চেয়ে বেশি। প্রতিনিয়ত ধোঁয়া গেলার কারণে বায়ুপ্রবাহের স্থান সরু হয়ে আসতে পারে। এ ছাড়া ধূমপানের কারণে নাকের টারবাইনেটস নামে বিশেষ ধরনের টিস্যু স্ফীত হয়ে যায়। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতার কারণে নাক ডাকার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।
ভালো ঘুমের চেষ্টা করুন
নিশ্চিন্ত ও গভীর ঘুমের মূল্য শুধু অনিদ্রায় ভোগা রোগীরাই বুঝতে পারবেন। মানুষের সুস্থ-সবল দেহের নেপথ্যে রয়েছে ভালো ঘুম। অনিদ্রার অনেকগুলো কুফলের মধ্যে একটি নাক ডাকা। একটু ভেবে দেখুন তো, আপনার ভালো ঘুম হচ্ছে কি না?
প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যাওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করুন। এতে ঘুমের সঙ্গে শরীরের একধরনের সামঞ্জস্য তৈরি হবে। ফলে নাক ডাকার অভ্যাস থাকলে সেটারও পরিবর্তন ঘটবে। বিছানা পরিষ্কার রাখুন। বিছানায় ধুলাবালু থাকলে, ঘর বেশি ময়লা থাকলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। এতে নাকের নালিতে ময়লা সংক্রমিত হয়ে নাকের পেশি ফুলে উঠতে পারে। এতে নাক ডাকার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
জিব ও গলার ব্যায়াম
নাক ডাকা বন্ধে শরীরের এ দুটি অঙ্গের পেশি শক্তিশালী করতে হবে। বয়সের কারণে টিস্যুর স্থিতিস্থাপকতা ও শক্তি কমে আসে। এতে গলায় বাতাস প্রবাহে সমস্যা হয়। এ সমস্যা কাটাতে দরকার ব্যায়াম। যেমন চোয়ালের নিচের অংশ ওপরের অংশ থেকে সামনে প্রসারিত করুন। আবার আগের অবস্থানে নিয়ে যান। টানা ১০ বার কাজটি করুন। এভাবে দিনে ৭ থেকে ১০ বার ব্যায়ামটি করতে পারেন। জিবের ব্যায়াম করতে পারেন কথা বলে। কোনো একটা বাক্য ধীরে ধীরে বলে যান। এভাবে দিনে ৭ থেকে ১০ বার এ ব্যায়াম করুন।
শেষ কথা
যাঁদের ঠান্ডা লেগেই থাকে এবং এ কারণে নাক বন্ধ থাকে, তাঁদের নাক পরিষ্কার করে ঘুমোতে যাওয়া উচিত। ঘুমোনোর এক-দুই ঘণ্টা আগে চা-কফি পান করবেন না। এ সময় মসলাযুক্ত খাবারও পরিহার করুন। প্রচুর পানি পান করলে নাসারন্ধ্রে লেগে থাকা আঠার মতো পদার্থগুলো দূর হবে। এতে নাক ডাকার আশঙ্কাও কমে আসবে। এ ছাড়া প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস দুধে দুই চা-চামচ হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে খেয়ে ফেলুন। এটা নাক ডাকা বন্ধের কার্যকর টোটকা। ঘুমানোর আগে দুধের সঙ্গে এলাচির গুঁড়ো মিশিয়েও খেতে পারেন। তবে এসব চেষ্টা করেও যদি নাক ডাকার সঙ্গে পেরে না ওঠেন, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো। সূত্র : প্রথম আল