আওয়ার ইসলাম: ইউসুফ ইসলাম। সাবেক ব্রিটিশ পপ-তারকা ক্যাট স্টিভেন্স। বর্তমান বিশ্বের এক বিস্ময়। কারণ সাবেক এই পপ-তারকা বিস্তর সুনাম কুড়িয়েছিলেন একদা। বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে এবং তারকাখ্যাতির শীর্ষে অবস্থান নিয়েও মনোজগতের শান্তি ও তৃপ্তি ছিল তাঁর কাছে অধরা। তাই শান্তির সন্ধান করলেন মরিয়া হয়ে। অবশেষে কিসের ছোঁয়ায় পেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি?
নিঃসন্দেহে সেটা ছিল আল্লাহর বাণী আল-কুরআন। কুরআনের পরশে ক্যাট স্টিভেন্স হয়ে গেলেন ইউসুফ ইসলাম। এ যুগের একজন বিখ্যাত নও-মুসলিম।
তার জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের এক খ্রিস্টান পরিবারে। তার বাবা ছিলেন একজন গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও মা ছিলেন সুইডিশ ক্যাথলিক। অথচ স্টিভেন্স ব্রিটেনের প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান সমাজে বসবাস করতেন প্রোটেস্টান্ট ধর্মমত অনুযায়ী। মায়ের উৎসাহ পেয়ে স্টিভেন্স গান শেখেন। গানের প্রতিভাও ছিল উঠতি তরুণের। ফলে ২০ বছর বয়স হওয়ার আগেই তার ৮টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, অর্জন করেন ব্যাপক খ্যাতি।
স্টিভেন্স ১৯৬৯ সালে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। তার শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ হয়ে পড়েছিল যে চিকিৎসকরা তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর ধরে হাসপাতালে থাকার পর তার মধ্যে বড় রকমের মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এ সময় তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রাচ্যের নানা ধর্ম সম্পর্কে পড়াশুনা শুরু করেন। এরপর থেকে তার গানের ভাবধারা ও পরিবেশ বদলে যেতে থাকে এবং সেগুলো হয়ে উঠতে থাকে আধ্যাত্মিক অর্থবহ।
স্টিভেন্স মরক্কো সফরে গেলে সেখানে আযানের সুমিষ্ট ধ্বনি তাকে বেশ আকৃষ্ট করে। এ সময় তার মনে যে ভাবনার উদয় হয়েছিল তা শোনা যাক তারই কথায়:
‘মনে মনে ভাবলাম, আল্লাহর জন্য সঙ্গীত? এমন বিষয় তো আর কখনও শুনিনি। অর্থের জন্য সঙ্গীত, খ্যাতির জন্য সঙ্গীত এবং ব্যক্তির গায়ের জোর বা শক্তির জন্য সঙ্গীত— এ ধরনের কথা তো শুনেছি; কিন্তু আল্লাহর জন্য সঙ্গীতের কথা কখনও শুনিনি।’
স্টিভেন্স-এর পরবর্তী গানের ক্যাসেটগুলো আরো বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ক্যাট স্টিভেন্সের ভাই ডেভিড জানতেন ক্যাট বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে খুব ভালোবাসেন। তাই মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় ডেভিড তার ভাইয়ের জন্য ইংরেজি ভাষায় অনূদিত পবিত্র কুরআনের একটি কপি সংগ্রহ করেন এবং দেশে ফিরে এসে ওই কপিটি তার ভাইকে উপহার দেন।
পবিত্র কুরআন পড়ে ক্যাট স্টিভেন্স এত অভিভূত হন যে, তিনি ইসলাম সম্পর্কে সার্বিক গবেষণা ও পড়াশুনা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘পবিত্র কুরআনের যে দিকটি সবকিছুর আগে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা হলো— এ মহাগ্রন্থের কভারের ওপর লেখকের কোনো নাম ছিল না। এ উপহার ছিল এমনই মূল্যবান সম্পদ যে তা আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে।
যাই হোক, এবার শুরু করলাম কুরআন অধ্যয়ন। যতবারই এ মহাগ্রন্থ পড়তাম ততবারই প্রশান্তি অনুভব করতাম। মনে হতো এ কুরআন যেন আমার জন্যই লেখা হয়েছে, তাই বার বার পড়েও তৃষ্ণা মিটতো না। পবিত্র কুরআন পড়ে বুঝতে পারলাম যে ইসলামই হল সেই ধর্ম যার সন্ধান আমি করছিলাম। কারণ, আমার মনের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছি এ মহান ধর্মে।
পবিত্র কুরআন আমার ওপর প্রভাব ফেলেছে কল্পনার চেয়েও অনেক গুণ বেশি। আমি বুঝতে পারলাম যে, কুরআনের শাশ্বত বাণী নাযিল হয়েছে গোটা মানব জাতির চিরন্তন সৌভাগ্যের জন্যই। এ মহাগ্রন্থের বাণী খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কুরআনের শব্দগুলো আমাকে খুবই বিস্মিত করে। এ পর্যন্ত জীবনে যত বই পড়েছি তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা বা ব্যতিক্রমধর্মী লেগেছে এ মহাগ্রন্থ।
পবিত্র কুরআন পড়ার আগে পার্থিব জীবনকে আমার কাছে এক দুর্বোধ্য রহস্য বা ধাঁধা বলে মনে হতো। এ বিশ্ব জগতের যে একজন স্রস্টা রয়েছেন তা বিশ্বাস করতাম। কিন্তু জানতাম না— এই যে স্রস্টা, যাকে চোখে দেখা সম্ভব নয়— তিনি কে। এটা জানার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কোনো ফল পাইনি। ঠিক যেন এমন এক নৌকার আরোহী ছিলাম যা উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু যখন পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করলাম তখন অনুভব করলাম যে, এ বই যেন আমার সঙ্গে কথা বলছে।
এভাবে এ মহাগ্রন্থের বাণীর মধ্যে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলাম।’
পবিত্র কুরআন অধ্যয়নের পর ধীরে ধীরে ইসলামী মূল্যবোধগুলোকে নিজ জীবনের ওপর প্রয়োগ করছিলেন ক্যাট স্টিভেন্স। মশগুল হতে থাকেন আল্লাহর ইবাদতে। মদ, ক্লাব ও পার্টি— এসব পাপপূর্ণ অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলছিলেন। অবশেষে গ্রহণ করেন পবিত্র ইসলাম ধর্ম। এভাবে ক্যাট স্টিভেন্স পরিণত হন ইউসুফ ইসলামে।
ইউসুফ নামটি যোসেফ নামের আরবী রূপ। এই নামটি বেছে নেয়া প্রসঙ্গে সাবেক ক্যাট স্টিভেন্স বা নও-মুসলিম ইউসুফ ইসলাম বলেছেন, ‘আমি সবসময়ই যোসেফ নামটি পছন্দ করতাম। যে স্কুলে আমি প্রথম ভর্তি হই ও পড়াশুনা করেছিলাম সেই স্কুলটির নাম ছিল সেন্ট যোসেফ। অবশ্য এই নাম বেছে নেয়ার মূল কারণটি হলো— কুরআনের সূরা ইউসুফ অধ্যয়ন। এই সূরা দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে আমার মনকে।’
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর ইউসুফ ইসলাম মুসলমানদের প্রথম কিবলা অধ্যুষিত বায়তুল মুকাদ্দাস শহর সফর করেন। এই পবিত্র শহর সফরের কারণ তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘এই পবিত্র স্থানে আমার ভাইয়ের জিয়ারতের সুবাদেই আমি সুপথ তথা ঈমানের সম্পদ পেয়েছি। মসজিদুল আকসা জিয়ারতের সময় যারা আমাকে নও-মুসলিম হিসেবে শনাক্ত করে ফেলেন, তারা আমার চারদিকে জড়ো হয়ে যান।
আমি এই মসজিদে নামাজ পড়লাম ও অনেক কাঁদলাম। হায় আল কুদস! এ পবিত্র স্থান মুসলিম বিশ্বের হৃৎপিণ্ড। যতদিন এ হৃৎপিণ্ড অসুস্থ থাকবে ততদিন গোটা মুসলিম বিশ্বই অসুস্থ থাকবে। এই মসজিদুল আকসাকে দখলমুক্ত করা আমাদেরই দায়িত্ব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জাতিগুলো যদি কুরআন ও এর শিক্ষার আলোকে চলে তাহলে কুদস মুক্ত হবে। আসলে ফিলিস্তিন সংকট কেবল ফিলিস্তিনি জাতির সংকট নয়। বরং গোটা মুসলিম বিশ্ব এই সংকটের সঙ্গে সম্পর্কিত।’
বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে একটি গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন ইউসুফ ইসলাম। অ্যালবামের গানগুলো রচনা করেছেন তিনি নিজেই। মহানবী [সা.]-কে সবসময়ই তার কাছে শান্তির প্রতীক বা আদর্শ বলে মনে হয়। নওমুসলিম ইউসুফ ইসলাম মনে করেন, ইসলাম এমন এক ধর্ম যা অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের কাছেও শান্তি ও সমঝোতার প্রসার ঘটাচ্ছে।
ইউসুফ বলেছেন, ‘বিশ্বনবী [সা.]-কে নিয়ে রচিত সঙ্গীতের (সিডি) অ্যালবামটিতে আমি গোলাপ ফুলের সুঘ্রাণ দিয়েছি। তাই সিডিটি খোলার সাথে সাথেই শ্রোতা সুগন্ধ পান। এটা করার কারণ, গোলাপ ফুল বিশ্বনবী মুহাম্মাদ [সা.]-এর অস্তিত্বের প্রতীক। আমি চাই শ্রোতারা যখন এই অ্যালবামের গান শুনবেন তখন যেন তারা এ মহামানবের প্রতীকি সুঘ্রাণ অনুভব করেন।’
নও-মুসলিম ইউসুফ ইসলাম এখন ইসলামী জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কঠোর প্রয়াস চালাচ্ছেন। মুসলমান হওয়ার পর তিনি কিছু দিন গান গাওয়া ও রেকর্ড করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেসময় লন্ডন সফরে গিয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি-গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মতিউর রহমান মল্লিক বিশ্বখ্যাত এই শিল্পীর সাথে সাক্ষাত করেন।
তিনি শিল্পীকে গান ছেড়ে দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেন। জবাবে ইউসুফ ইসলাম বলেন, আমি খুবই ভয়ে থাকি যে, গানে টান দিয়ে আবার না সেই বাতিলের পথে চলে যাই। জীবনে যে মহাসত্যের সন্ধান পেয়েছি তাকে না হারিয়ে ফেলি।
এই মহাতারকা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সফরে এলে এ দেশের ইসলামী গানের একটি সংগঠিত দল তাকে সংবর্ধিত করে। সে অনুষ্ঠানে খালি গলায় তার সদ্য লেখা কয়েকটি ইসলামী গান শুনিয়ে দর্শকদের আপ্লুত করেন ইউসুফ ইসলাম।
বিয়ে করার পর তিনি ব্রিটিশ মুসলিম সমাজের সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। পপ তারকা হিসেবে তার বার্ষিক আয় ছিল দেড় মিলিয়ন ডলার। তার জমানো সেইসব অর্থ ও ভবিষ্যত আয়কে লন্ডন ও অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের শিক্ষার কাজে ও অন্যান্য দাতব্য খাতে ব্যয় করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। মানব-দরদী শান্তি মিশন নিয়েও দেশে দেশে সফর করছেন সাবেক ক্যাট স্টিভেন্স। পৃথিবীর উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত হয়েছে তার সফর।
এটা সত্য যে, মুসলিম হওয়ার কারণে পাশ্চাত্যের শীর্ষস্থানীয় পপ তারকার তকমাটি এখন আর তার নামের পাশে নেই। কিন্তু তিনি যা পেয়েছেন তা যে অনেক বড় সম্পদ। বরং সেটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর তা হচ্ছে— ঈমান এবং আত্মার প্রশান্তি।
পার্সটুডে অবলম্বনে কামরুল ইসলাম হুমায়ুন