রকিব মুহাম্মাদ
আওয়ার ইসলাম
ইখওয়ানুল মুসলিমিনের আধ্যাত্মিক নেতা বিশ্ববরেণ্য আলেম ড. ইউসুফ আল-কারজাভির আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মিসরীয় বুদ্ধিজীবী। তবে বর্তমানে কাতারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।জেরুসালেম বিশ্ব মুসলিম সমস্যা, দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম, ইসলামী শরিয়তের বাস্তবায়ন, ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন তিনি।
জেরুসালেম, ফিলিস্তিন একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পাশ্চাত্যবাসী খৃস্টানরা তুর্কী মুসলমানদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে ফিলিস্তিনী আরবদের দান করবে বলে ওয়াদা করলেও, পরবর্তীতে তারা চালাকি করে পাশ্চাত্যের ইহুদীদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র বানায় ফিলিস্তিনে।
আর বিতাড়িত হল, এখনও হচ্ছে, স্থানীয় মুসলমানরা। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও, ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোন খবরই নেই, বরঞ্চ পাশ্চাত্য এখন ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীর ও সিরিয়ার গোলান হাইটস স্থায়ীভাবে গ্রাসে এগিয়ে যাচ্ছে।
ড. কারযাভী একজন জ্ঞানী মানুষ। তিনি জেরুসালেম তথা, ফিলিস্তিনী সমস্যা সমাধানে মুসলমানদের নিকট সাত দফা কর্মসূচি দিয়েছেন তার এ খ্যাত ‘জেরুসালেম : বিশ্বমুসলিম সমস্যা’ বই-এ।
আল-আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে যে ‘‘ইন্তিফাদা’’ প্রতিহত-আন্দোলন শুরু হয়েছে, তাকে বেগবান করতেই এই সাত দফা। আমাদের সবারই এই সাত দফা জানা চাই। নিচে আমরা ড. কারযাভীর প্রস্তাব উপস্থিত সাত দফা তুলে ধরা হলো।
এক. মসজিদের বিপ্লব যা পরবর্তীতে ‘ইন্তিফাদা' নামে খ্যাত যা ইসরাইলকে এই মুক্তি সংস্থাকে স্বীকার করতে এবং তার সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে, একে আরো শক্তিশালী ও বেগবান করতে হবে। এতে সকল ফিলিস্তিনির সমর্থন- জনগণ ও কর্তৃপক্ষ এবং সকল আরব এবং মুসলমানদের সমর্থন যোগাতে হবে এবং বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের এর প্রতি সমর্থন নিতে হবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হলো ইসরাইল। এটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বা সন্ত্রাসের রাষ্ট্র। এটি এমন রাষ্ট্র যার ভিত্তিই হলো জুলুম ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি ধ্বংস করা এবং ব্যক্তি ও পরিবারের অধিকার নস্যাৎ করা। ফিলিস্তিনী জনগণের সামনে একটিমাত্রই পথ- তা হলো প্রতিরোধ করা। প্রত্যেক জাতিরই অধিকার রয়েছে জবরদখলকারীকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার।
মেনাহেম বেগীন যখন স্লোগান তুলে, ‘‘আমি লড়াই করব তাহলেই আমার অস্তিত্ব থাকবে।’’ তখন শায়খ আহমাদ ইয়াসীন (রহ.) এর পাল্টা স্লোগান তুলেন, ‘‘আমি প্রতিরোধ করব, তাহলেই আমার অস্তিত্ব থাকবে।’’ অবশ্যই আহমাদ ইয়াসীনের সত্য মেনাহেম বেগীনের বাতিলকে পরাভূত করবে।
দু্ই. ্ইসরাইলের সাথে কথিত সর্বপ্রকার সমাঝোতাকে প্রখ্যাখ্যান করা ওয়াজিব রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। সুতরাং ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক লেনদেনও করা যাবে না এবং ইসরাইলী কোন অফিস খোলার অনুমতি দেয়া যাবে না।
তেমনিভাবে ইসরাইল সফর করাও জায়েজ হবে না, যদিও তা মসজিদুল আকসায় নামায আদায়ের দাবিতে করা হয়ে থাকে। কেননা কোন মুসলমান এ মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর তখনই করবে, যখন তা ইসরাইলী কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হবে।
আমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য হবে আরব ও ইসলামী বিশ্বের ইসরাইলী আগমন প্রতিহত ও প্রত্যাখ্যান করা তা যে রূপেই বা ব্যানারে আসুক না কেন। আমাদেরকে অবশ্যই নব্য ইসরাইলী আগ্রাসন ও আক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে এবং আমাদের স্বকীয়তাকে অাঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। তারা যেন একে কোনভাবেই কুলুসিত করতে না পারে।
তিন. ইসরাইলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বয়কট আরো প্রবলভাবে জারি রাখতে হবে এবং এর ক্ষেত্র আরো প্রশস্ত করতে হবে যেন বয়কট হয় আরবি ইসলামী। সুতরাং কোন মুসলমানের জন্য বৈধ হবে না তার নিকট থেকে কোনকিছু কেনা বা বিক্রি করা। এ কাজটি করা মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর ওয়াজিব এবং প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির ওপর অবশ্য কর্তব্য।
প্রত্যেক মুসলমানকে একথা জানতে হবে যে, দীনার বা দিরহাম অথবা পাউন্ড কিংবা রিয়াল বা টাকাটি ইসরাইলে যাবে তা ক্ষেপণাস্ত্র বা বুলেট অথবা বোমায় রূপান্তরিত হয়ে আমাকে হত্যা করবে, বা তা দ্বারা ইসরাইল আমাকে হুমকি দিবে। বরং এই বয়কট আরো প্রশস্ত করতে হবে এবং যারা ইসরাইলকে সাহায্য সহযোগিতা করছে তাদেরকেও শামিল করতে হবে।
বিশেষ করে আমেরিকাকে, যে তার সর্বশক্তি দিয়ে ইসরাইলের পিছনে রয়েছে। সমস্ত মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব হবে, আমেরিকার পণ্য বর্জন করা, প্লেন থেকে শুরু করে- গাড়ি, যন্ত্রপাতিও। এমনকি হ্যামবার্গার, পিজা, কোকাকোলা, সিগারেট ইত্যাদি।
চার. আরব ও মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব হলো নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা এবং নিজেদের ছোটখাট ঝগড়ার কথা ভুলে যাওয়া এবং একে অপরের সাথে এক কাতারে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো দাঁড়ান। কেননা যুদ্ধ হলো মহাযুদ্ধ কোনক্রমেই যেন ছোটখাট ঝগড়া-ঝাটি এ মহাযুদ্ধের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে পারে। কবি বলেন- বড় বিপদসমূহ বিপদগ্রস্তদের একত্রিত করে দেয়।
তাহলে যদি সব বিপদের মূল ইসরাইল হয় এবং জমিনের বুকে তার উদ্ধত্ব হয়। তাহলে আমরা কেন ঐক্যবদ্ধ হবো না? মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা সারিবদ্ধভাবে আল্লাহর পথে লড়াই করে যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর।’’ (সূরা সফ : ৪)
আমাদের ওপর ওয়াজিব হবে এই শতধাবিচ্ছিন্ন উম্মতকে (আরো) টুকরা টুকরা করার প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করা এবং সবাইকে তাওহীদের ছায়াতলে একতাবদ্ধ করা। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে না পারি তাহলে কমপক্ষে তাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে, আর এটা হচ্ছে দুর্বল ঈমানের পরিচয়।
ধর্মীয় ভেদাভেদ ছড়াবার কোন অবকাশ নেই : শিয়া সুন্নী বলে, বংশীয় ভেদাভেদ : আরব কুর্দী বলে, আরব অনারব বলে, অথবা আদর্শিক ভেদাভেদ : ডানপন্থী বামপন্থী বলে কিংবা সামাজিক ভেদাভেদ : ধনী গরীব বলে।
আমাদের ওপর ওয়াজিব হলো ফিলিস্তিনী বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলোর ভেদাভেদ প্রতিরোধ করা, কেননা, সকলে একই গর্তে আটকা পড়েছে, তা হলো যায়নবাদী শত্রুর আগ্রাসন ও জবরদখল।
শায়খ আহমাদ ইয়াসীন রহ. কাতারে একবার কত সুন্দর কথাই না বলেছিলেন, যদি ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে হত্যা করে, তাহলে আমরা তাদের হত্যা করব না। যদি তারা আমাদের সাথে দুব্যবহার করে কষ্ট দেয় তাহলেও আমরা তাদের মত আচরণ করব না।
আমরা হব আদমের দুই সন্তানের মধ্যে উত্তমটার মত যখন তাকে তার ভাই বলেছিল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আপনি আমাকে হত্যা করার জন্য হাত তুলেন, তাহলে আমি আপনাকে হত্যা করার জন্য হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। (সূরা মায়েদা : ২৮)
পাঁচ. আমাদের ওপর ওয়াজিব হল যে, আমরা ইসলামী জিহাদের কথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করব। কেননা কুদ্স শুধুমাত্র ফিলিস্তিনীদের ব্যাপারে নয়, আর শুধুমাত্র আরবদের নয় বরং তা ইসলামের ব্যাপার। এ জন্য আমরা এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করি যা মাঝে মধ্যে বলা হয়ে থাকে যে, কুদস ফিলিস্তিনীদের ব্যাপার।
আমরা যতটুকু অধিকারী তার চেয়ে বেশি অধিকারী বলে দাবি করতে হবে। কুদ্স হলো গোটা মুসলিম উম্মাহর ব্যাপার, সে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ যেখানকারই অধিবাসী হোক না কেন।
যদি ফিলিস্তিনীরা দুর্বল হয়ে একে সমর্পণ করে, তাহলে গোটা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য হবে তা প্রত্যাখ্যান করা এবং স্বয়ং ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ করা। তেমনিভাবে একথা বলা বৈধ হবে না যে, মক্কা, কাবা বা মসজিদুল হারাম সৌদীর ব্যাপার, সমস্ত মুসলমানদের ব্যাপার নয়, এভাবেই বলা হবে জেরুসালেম এবং মসজিদুল আকসার ব্যাপারে।
ছয়. আমাদের ওপর ওয়াজিব হল যেন আমরা ‘বিশ্ব ইসলামী গণপরিষদ' গঠন করি কুদসকে উদ্ধারের জন্য। যদি মুসলমানদের বাইয়াতকৃত ‘খলিফা থাকত তাহলে তিনি উম্মতকে একত্রিত করে নেতৃত্ব দিতেন যেমনটি তেরশ বছর পূর্বে ছিল।
তিনি মুসলমানদের আহবান জানাতেন এই বলে, আসুন, সকলে ফিলিস্তিনীকে মুক্ত করার জন্য ছুটে আসুন। তাহলে মিলিয়ন মিলিয়ন মুসলমান তার ডাকে সাড়া দিত এবং সকলেই একযোগে ইসরাইলী শক্তির বিরুদ্ধে ইসরাইলী অস্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত এবং তাদেরকে হাজারে হাজারে লাখে লাখে হত্যা করত, পক্ষান্তরে তারা সমস্ত মুজাহিদকে হত্যা করতে এবং সকল মুসলমানের মোকাবিলা করতে সমর্থ হতো না।
যেহেতু বর্তমানে আমাদের খেলাফত নেই যা দিক নির্দেশনা দিতে পারত সে জন্য এর বিকল্প হিসেবে ‘বিশ্ব ওলামা সম্মেলন'-এর পক্ষ থেকে এ আহবান জানানো যেতে পারে, স্থানীয় রাজনীতি এবং সরকারি নির্দেশনা থেকে দূরে থেকে তারা তাদের বক্তব্য ও নির্দেশনা উম্মতকে দিতে পারেন। এই পরিষদই কাক্মিখত ‘আকসা উদ্ধার পরিষদ' গঠন করতে পারে।
সাত. এই পরিষদ ‘কুদ্স ফান্ড' গঠন করবে বিশ্ব মুসলিমের গণতহবিল হিসেবে। সকল মুসলমান এতে অংশ গ্রহণ করবে। সমস্ত মুক্তিকামী মানুষ দুনিয়ার সমস্ত প্রান্ত থেকে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়ে। কেননা, অল্প অল্প করতে করতেই বেশি হয়।
আর এটা হবে মসজিদুল আকসা ও কুদসকে উদ্ধারের জন্য, ইসরাইলের বসতি স্থাপনের মোকাবিলায় এবং জেরুসালেমবাসীর নিঃশব্দ গমনের এবং মসজিদুল আকসাকে ধ্বংস করা।
আমরা এই প্রস্তাবনাসমূহ সমস্ত ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ ও তার বিরোধিরা সমস্ত আরব ও অনারব এবং সমস্ত বিকেবান ও ভদ্র এবং শান্তিপ্রিয় মানুষের নিকট প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নিকট পেশ করছি যেন তারা আমাদের এই ন্যায়ের যুদ্ধে সহযোগিতা করে এবং সত্যের পক্ষে এসে দাঁড়ায়। সত্য অবশ্যই বিজয়ী হবে যদিও তা কিছুকাল পরে হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য।
সূত্র : জেরুসালেম: বিশ্ব মুসলিম (বই)