আওয়ার ইসলাম: স্রেব্রেনিৎসায় হত্যা করা হয় আট হাজার পুরুষ ও বালককে। প্রতি গ্রীষ্মেই তাদের গণকবরে স্বজনহারাদের শোকের মাতম ওঠে।
নাজিম এসকেলসেন। ১৬ বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে জার্মানি চলে এসেছিল উদ্বাস্তু হিসেবে বসনিয়া থেকে। এখন বন শহরেই থাকে। মাঝেমধ্যেই নাজিমের সঙ্গে দেখা হয়। কথা হয় টুকটাক। জিজ্ঞাসা করি, বসনিয়া যুদ্ধের কথা মনে আছে কি না? স্বল্পভাষী নাজিম কখনোই এসব বিষয়ে খুব একটা বিস্তারিত বলে না। হু-হা করে পার করে দেয়।
কিছুদিন আগে জানতে চেয়েছিলাম, স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার দায়ে রাতকো ম্লাদিচের বিচার হচ্ছে। তুমি কি জানো? নাজিম জানায়, তার বাড়ি স্রেব্রেনিৎসার কাছেই এক গ্রামে ছিল। সেখান থেকে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে এসে রক্ষা পায়।
কথাপ্রসঙ্গে নাজিমের প্রশ্ন: এই গণহত্যার দায় কি শুধুই সার্বদের? ম্লাদিচের? পশ্চিমাদের নয় কি? স্রেব্রেনিৎসায় তো জাতিসংঘের নিরাপদ-ঘোষিত অঞ্চলেই গণহত্যা সংগঠিত হয়। জাতিসংঘই-বা কী করল? রাতকো ম্লাদিচের বিচারে আমরা খুশি। কিন্তু এতে করে জাতিসংঘসহ পশ্চিমারা কখনোই দায় এড়াতে পারে না।
২২ নভেম্বরে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধ-বিষয়ক ট্রাইব্যুনাল বসনিয়ার কসাই হিসেবে খ্যাত জেনারেল রাতকো ম্লাদিচকে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার দায়ে আজীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।
সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল ম্লাদিচের সাজার খবর। তাঁর বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন আদালত। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালের বসনিয়া যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ হত্যার মূল হোতা এই নৃশংস সার্ব জেনারেল ম্লাদিচ।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে ম্লাদিচের বাহিনী স্রেব্রেনিৎসা ও সেপে দখল করে নেয়। আট হাজার পুরুষ ও বালককে হত্যা করা হয়। ৩০ হাজার অধিবাসী পালিয়ে যায়। যদিও জাতিসংঘ-ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চল ছিল স্রেব্রেনিৎসা। ওই সময় স্রেব্রেনিৎসার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ডাচব্যাট নামে নেদারল্যান্ডসের একটি ট্রুপস।
অভিযোগ রয়েছে ডাচব্যাটের দায়িত্বহীনতার কারণেই ম্লাদিচের বাহিনী গণহত্যা পরিচালনার সুযোগ যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ম্লাদিচের বাহিনী কি সুযোগ পেয়েছিল, না সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল? শুধু স্রেব্রেনিৎসা কেন? গোটা বসনিয়া যুদ্ধের সময়ই জাতিসংঘের একধরনের নীরব ভূমিকা লক্ষ করা যায়।
বলা হয়ে থাকে, জাতিসংঘ বা পশ্চিমারা যদি শুরু থেকেই সক্রিয় থাকত, তবে বসনিয়ার গণহত্যা অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব হতো। পশ্চিমা শক্তির ভূমিকা কি ছিল, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীই-বা কেন নিরাপদ-ঘোষিত অঞ্চল থেকে সরে এসেছিল—ফরাসি সাংবাদিক ফ্লোরেন্স হুর্টমান তাঁর দুটি বই ‘দ্য স্রেব্রেনিৎসা অ্যাফেয়ার: দ্য ব্লাড অব রিয়েলপলিটিক’ ও ‘পিস অ্যান্ড পানিশম্যান্ট’-এ বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
২০১৫ সালের জুলাইয়ে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এক গবেষণার উল্লেখ করে জানায়, ম্লাদিচ বাহিনীর হাতে স্রেব্রেনিৎসার পতন হবে—এটা আগে থেকেই ওই সময় তিন ‘গ্রেট পাওয়ার’ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স আঁচ করতে পেরেছিল।
আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, জাতিসংঘের নেতৃত্বে তিন বড় শক্তি ইচ্ছা করেই সার্ব বাহিনীকে ঢুকতে দিয়েছিল। এটা ছিল তাদের যুদ্ধকৌশল। শান্তি আনার জন্য ‘এন্ড গেম’ হিসেবে তারা সার্ব বাহিনীকে কিছুটা জায়গা দিয়েছিল। কী ছিল সেই কৌশল এবং এর কারণ কী ছিল?
গার্ডিয়ানের আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্রেব্রেনিৎসার অধিকার সার্বদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্যই পশ্চিমা শক্তি ম্লাদিচের বাহিনীকে প্রবেশের সুযোগ দেয় এবং ফলাফল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ইউরোপের সব থেকে বড় নৃশংস গণহত্যা।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন ছাড়াও বিভিন্ন সময় ফাঁস হওয়া গোপন নথির তথ্য, সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার ও অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, পশ্চিমা শক্তির জ্ঞাতসারেই স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যা পরিচালিত হয়।
স্রেব্রেনিৎসা দখলের আগে থেকেই ম্লাদিচ হুমকিধমকি শুরু করে দিয়েছিলেন। সার্ব অ্যাসেম্বলিতে দেওয়া এক বক্তব্যে ম্লাদিচ বলেছিলেন, স্রেব্রেনিৎসাসহ আশপাশের এলাকা থেকে বসনীয় মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করাই তারা মূল উদ্দেশ্য। ম্লাদিচের এই বক্তব্য সমর্থন করে বসনীয় সার্ব নেতা রাদুভান কারাদজিচ বলেছিলেন, রক্তের সাগরে স্রেব্রেনিৎসা ভাসিয়ে দিয়ো।
(২০১৬ সালে হেগের আন্তর্জাতিক আদালত গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে কারাদজিচকে ৪০ বছর কারাদণ্ড দেন, সম্প্রতি বসনিয়ার আরেক কসাই বলে খ্যাত রাদকো ম্লাদিচ সাজা ঘোষণার সময় বিষপানে আত্মহত্যা করেন)
১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি মার্কিন কূটনৈতিক রবার্ট ফ্রসার ওয়াশিংটনে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে জানান, সার্ব নেতা মিলোসেভিচ নিরাপদ অঞ্চলগুলো তাদের (সার্ব) হাতে তুলে না দিলে শাস্তির পরিকল্পনা গ্রহণ করবে না।
ওই সময়কার মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা অ্যান্থনি লেইক রবার্ট ফ্রসারের প্রতিবেদন গ্রহণ করেন এবং ‘ইউএস পলিসি মেইকিং প্রিন্সিপাল কমিটি’ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীকে নিরাপদ অঞ্চল থেকে সরে আসার অনুরোধ জানায়। ফরাসি ও ব্রিটিশ সরকারও এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে বলে, দীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলগুলো আর নিরাপদ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এরপরই ম্লাদিচের বাহিনী স্রেব্রেনিৎসার দিকে অগ্রসর হয়।
ওই সময়কার ডাচ্ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফন ডার ভিন্ড পরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন জাতিসংঘ সার্ব বাহিনীকে ৩০০ লিটার পেট্রল দিয়েছিল বসনীয়দের মৃতদেহগুলো পরিবহন করে সুনির্দিষ্টস্থানে পুঁতে ফেলতে। গণহত্যা যখন পুরোদমে শেষ হয়, তখনই পশ্চিমা শক্তি মিলোসেভিচ ও ম্লাদিচের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসেন।
পরবর্তী সময়ে ফাঁস হওয়া মার্কিন গোপন নথি হতে দেখা যায় সিআইএ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই গণহত্যার দৃশ্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করে।
ম্লাদিচের সাজা ঘোষণার পর অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তবে এখানেই সব শেষ নয়। কয়েকজন অপরাধীর বিচার হয়েছে মাত্র। কিন্তু শান্তি স্থাপনের নামে যারা অনেকটা ইচ্ছা করেই স্রেব্রেনিৎসাবাসীকে বলি দিল, তাদের কী হবে? এখনো স্রেব্রেনিৎসার মোমোরিয়াল সমাধিক্ষেত্র ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। প্রতি গ্রীষ্মেই স্বজনহারাদের শোকের মাতম ওঠে।
সেখানে ৬ হাজার ৫০৪টি সমাধি আছে। ওই সময় নিখোঁজ হওয়া ৮ হাজার ৩৭২ জনের নাম লেখা আছে স্মৃতিস্তম্ভগুলোয়। এই পশ্চিমারই এখন ঘটা করে গণহত্যা দিবস পালন করেন। ম্লাদিচের বিচারের পাশাপাশি পশ্চিমাদের এই দ্বৈত চরিত্রেরও বিশ্লেষণ হওয়ার দরকার। পশ্চিমা শক্তির ভূমিকাও খতিয়ে দেখা উচিত।
প্রশ্ন উঠেছে, পশ্চিমারাও কি পরোক্ষে এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত? এমনকি জাতিসংঘও কি নয়? শুধু ম্লাদিচের সাজা দিয়েই কি জাতিসংঘ ও পশ্চিমাদের দায় শোধ হবে? হুর্টমানের ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, হেগের আদালতে জাতিসংঘ ও পশ্চিমাদের ভূমিকার কোনো মূল্যায়ন হবে না। তবে জনতার আদালতে বোধ করি কোনো কিছু বাকি থাকে না।
এখানে একটি মজার তথ্য দিয়ে শেষ করি। যে ডাচ্ বাহিনীর নির্লিপ্ততার কারণে ম্লাদিচ বাহিনী স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যা পরিচালনা করেছে, সেই ডাচ্ দেশেরই শহর হেগে ম্লাদিচের বিচার সম্পন্ন হলো। এটিই মনে হয় পশ্চিমা শক্তির দ্বৈত চরিত্রের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি