জোবায়ের আল মাহমুদ
লেখক
স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই বিশ্ববিখ্যাত সমসাময়িক পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং অনেক পরিচিত নাম হলেও বিজ্ঞানে মিচিও কাকু-র অবদান স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে অনেক বেশি।
মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। এ কারণে, বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু অনেক বেশি জনপ্রিয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই।
আলোচ্য প্রবন্ধে বড় এই দুই পদার্থ বিজ্ঞানীর ধর্ম বিষয়ক বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক।
স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেন, ‘দর্শন মরে গেছে’। অন্যস্থানে বলেন, ‘ধর্ম অকার্যকর, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’।
তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু বিজ্ঞানী মিচিও কাকু এই মতের সাথে একমত নন।
তিনি বলেন, ‘আমি প্রচুর ধর্ম ও দর্শনের বই পড়েছি’। সত্যকে কোনো ভাবেই কেবল বিজ্ঞানের খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ করা যায় না। এ কারণে স্বয়ং আইনস্টাইন নিজেও ধর্ম ও দর্শনের গুরুত্ব নিয়ে প্রচুর লেখা লিখেছিলেন।
পাঠ্যবইয়ে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হলো – “বিশ্বের যাবতীয় ভৌত বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যাচাই, নিয়মসিদ্ধ, বিধিবদ্ধ ও গবেষণালব্ধ পদ্ধতিতে যে জ্ঞান লাভ করা হয়, তাকে বিজ্ঞান বলে”।
বিজ্ঞানের এই সংজ্ঞাটিকে ভুল প্রমাণ করেন বিজ্ঞানী মিচিও কাকু। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞান প্রথমে স্বপ্ন দেখে, তারপর তা বাস্তবায়ন করার জন্যে চেষ্টা করে এবং সূত্র আবিষ্কার করে।
আইনস্টাইন স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি একটি সূত্র তৈরি করবেন, যা দিয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্য বোঝা যায়। কিন্তু তিনি তা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। অবশেষে আমরা এসে ‘স্ট্রিং তত্ত্ব’টি আবিষ্কার করেছি, যা দিয়ে স্রষ্টার কার্যক্রম সহজে বোঝা যায়’।
আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানী কাকু’ও মনে করেন– ‘ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি ও অর্থনীতির সাহায্যে বিজ্ঞানকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করা উচিত’। ধর্ম ও দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক বুঝানো জন্যে বিজ্ঞানী কাকু তার ‘Physics of the future’ বইয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। সেখান থেকে একটি অংশ হুবহু অনুবাদ তুলে দেয়া হলো।
“প্রযুক্তির ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বের প্রথম সারির একটি দেশ। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যে সঙ্কট তৈরি হবে, রোবটের সাহায্যে সেই সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্যে জাপান প্রচুর টাকা খরচ করছে।
জাপান বিশ্বের প্রধান রোবটের জাতি হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়। এর প্রথম কারণ হলো জাপানের শিন্তো ধর্ম। এই ধর্ম মতে, জড়বস্তুর মধ্যেও এক ধরণের আত্মা রয়েছে; এমন কি মেশিনেরও আত্মা আছে।
পশ্চিমা বিশ্বের শিশুরা সিনেমায় দেখে যে, রোবটেরা মানুষকে হত্যা করার জন্যে দৌড়াচ্ছে। তাই পশ্চিমা শিশুরা যখন রোবট দেখে তখন তাকে সন্ত্রাসী মনে করে ভয়ে চিৎকার শুরু করে। কিন্তু জাপানি শিশুরা মনে করে, রোবট তাদের মতই একটি আত্মা, রোবটেরাও খেলাধুলা করে এবং তারাও শান্তিপ্রিয়।
জাপানের বড় বড় দোকানগুলোতে কেউ যখন প্রবেশ করে, সচরাচর দেখতে পাবে, রোবট অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বিশ্বে ব্যবসায়িক যত রোবট আছে, তার ৩০ শতাংশই আছে জাপানে। জাপান রোবটকে ধ্বংসের নয়, বরং সাহায্যের প্রতীক মনে করে।” [সূত্র: মিচিও কাকু, ভবিষ্যতের পদার্থবিজ্ঞান, পৃষ্ঠা – ৪৮]
বিজ্ঞানী মিচিও কাকু তার এ বইটিতে অনেক স্থানেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, ধর্ম ও দর্শন এ দুটি বিষয় বিজ্ঞানের শত্রু নয়, বরং বন্ধু। ধর্ম ও দর্শনের সাহায্যে বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটে, অবনতি নয়। মিচিও কাকুর এই কথাগুলো আসলে আইনস্টাইনের কথার-ই প্রতিধ্বনি।
১৯৪১ সালে আইনস্টাইন তার “Science, philosophy and religion” নামক সম্মেলনের সর্বশেষ বাক্যে বলেছিলেন – ‘বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম পঙ্গু, এবং ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অন্ধ”। সুতরাং, বিজ্ঞানী হকিং যে বলেছিলেন, ‘ধর্ম ও দর্শনের আর কোনো প্রয়োজন নেই’; তা আসলে একটি অযৌক্তিক কথা।
২ – আল্লাহ সম্পর্কে স্টিফেন হকিং-এর ভ্রান্তি এবং মিচিও কাকু’র জবাব।
বিজ্ঞানী মিচিও কাকু তার বইয়ে একটি ঘটনাটি তুলে ধরেন। একবার, বিজ্ঞানী কাকু’কে স্টিফেন হকিং বললেন, ‘বিশ্বজগতে স্রষ্টার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, বিশ্বজগত চলে পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মে’।
বিজ্ঞানী কাকু তখন হকিং-কে বললেন, ‘আচ্ছা, বিজ্ঞানের সূত্র সৃষ্টি করলো কে? আমরা বিজ্ঞানীরা তো এ সূত্রগুলো তৈরি করি নাই, আমরা কেবল এ সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছি। তাহলে, সূত্রগুলো আসলো কোত্থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে হকিং বলেন, ‘আমি তা জানি না’।
২০১৪ সালে, Starmus Festival-এ স্টিফেন হকিং বলেন যে, ‘স্রষ্টা যা জানে, আমরাও বিজ্ঞানের মাধ্যমে তা জানতে পারি। কোনো কিছুই বিজ্ঞানের অজানা নয়’।
কিন্তু বিজ্ঞানী কাকু বলেন, বিজ্ঞান শত চেষ্টা করেও বিশ্বজগতের শতকরা ৫ ভাগও জানতে পারে না। বিশ্বজগতের বাকি ৯৫ ভাগেরও বেশি কিছু বিজ্ঞানের জানার বাইরে, এটা এক অদৃশ্য রহস্যের জগত।
নাসা বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ ও গণনা অনুযায়ী মহাবিশ্বের মোট শক্তির ৭৩% ই হলো অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি, মোট পদার্থের ২৩% হলো অদৃশ্য বস্তু বা ডার্ক ম্যাটার। এ ছাড়া বাকি ৩.৬% হলো মুক্ত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম, যা মহাজাগতিক ধূলিকণা।
মহাবিশ্বের আমরা যা কিছু দেখি, অর্থাৎ, আকাশ-বাতাস, সাগর-নদী, গ্রহ-নক্ষত্র সব মিলিয়ে হলো মহাবিশ্বের মাত্র ০.৪%। এই ০.৪% পদার্থ ও শক্তিকে জানার ও বোঝার ক্ষমতা আমাদের আছে। বাকি ৯৫ ভাগেরও বেশি কিছু আমাদের জানার অসাধ্য।
সুতরাং, স্টিফেন হকিং যে বলেছিলেন, মহাবিশ্বের সবকিছুই আমরা জেনে গেছি, এই কথাটি শতভাগ-ই ভুলো বলে নাসা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন।
স্টিফেন হকিং নিজেকে সবসময় একজন অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচয় দেন। কিন্তু মিচিও কাকু সবসময় বলেন, আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি, যেভাবে আইনস্টাইনও বিশ্বাস করতেন। আইনস্টাইন ছিলেন একজন ইহুদী।
ইহুদীরা যেহেতু তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পরিবর্তন করে ফেলেছে, তাই ইহুদী ধর্মে আইনস্টাইনের তেমন বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আইনস্টাইন সবসময় বলতেন আমি বৌদ্ধ ও স্পিনোজার স্রষ্টায় বিশ্বাস করি।
স্পিনোজা ইহুদী ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে মুসলিম দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত হন। স্পিনোজার দু’জন শিক্ষক মাইমোনাইড্স এবং এবিসেব্রন ছিলেন মুসলিম দার্শনিকদের ভক্ত। এ কারণে দেখা যায়, বিজ্ঞানী কাকু বৌদ্ধ ধর্মের কঠিন ধর্মীয় রীতিনীতি এবং খ্রিস্টান ধর্মের মানব-ঈশ্বরের ধারণা বাদ দিয়ে আইনস্টাইনের একত্ববাদী স্রষ্টায় বিশ্বাসী।
তিনি বলেন, যে স্রষ্টা বিশ্বজগতকে সুন্দর নিয়মে সাজিয়েছেন, আমি সেই স্রষ্টায় বিশ্বাসী।
বিজ্ঞানী মিচিও কাকু বলেন, একজন মানুষের ধর্ম বিশ্বাস বিজ্ঞান জানা বা না-জানার উপর নির্ভর করে না। একজন সাধারণ মানুষের মতই একজন বিজ্ঞানী বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী উভয়টি হতে পারে। কেউ বিজ্ঞান বুঝে বলে সে অবিশ্বাসী হয় ব্যাপারটা এমন না। কাকু তার ‘The Future of the Mind’ বইয়ে এ বিষয়টি নিয়ে অনেক উদাহরণ দেন। বই থেকে একটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো।
নিউরো বিজ্ঞানী মারিও বেয়াওরিগার্ড মানুষের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন। তার গবেষণাটির নাম - “The Spiritual Brain: A Neuroscientist's Case for the Existence of the Soul”।
পরবর্তীতে এই গবেষণাটি বিশ্বের সমস্ত নিউরো বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। বেয়াওরিগার্ড বিভিন্নভাবে প্রমাণ করে দেখান যে, মানুষের মন তার ব্রেইনের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং, মানুষের মন-ই তার ব্রেইন কাঠামোকে পরিবর্তন করে।
মানুষের বিশ্বাস গড়ে উঠে তার চতুঃপার্শ্বের পরিবেশের উপর নির্ভর করে। বৈজ্ঞানিক যুক্তি-অযুক্তির কারণে তার বিশ্বাস পরিবর্তন হয় না।
বিজ্ঞানের কারণে একজন বিশ্বাসী আরো বড় বিশ্বাসী হয়, এবং একজন অবিশ্বাসী আরো বড় অবিশ্বাসী হয়। বিজ্ঞান এখানে একটি প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। পদার্থ বিজ্ঞানী মিচিও কাকু তার ‘The Future of the Mind’ বইতে নিউরো বিজ্ঞানী বেয়াওরিগার্ড-এর এই মতটি সমর্থন করেন।
আলোচ্য আলোচনা থেকে প্রমাণিত, বিজ্ঞানের কারণে নয়, বরং পারিবারিক ও সামাজিক কারণে মানুষ বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী হয়ে থাকে। পারিবারিক ও সামাজিক কারণেই স্টিফেন হকিং অবিশ্বাসী হয়েছিল।
অন্যদিকে, বিজ্ঞানী মিচিও কাকু’র মত শত শত বিজ্ঞানী স্রষ্টায় বিশ্বাসী হবার কারণও হলো তার পরিবার ও সমাজ।