সাকিব মুসতানসির
আলেম ও বস্ত্র প্রকৌশলী
প্রযুক্তির উতকর্ষের যুগে মানুষ বন্দী হয়েছে প্রযুক্তির হাতেই। আটকা পড়েছে মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অন্তর্জালে। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর এক কোনের নিউজ পৌঁছে যাচ্ছে অপর কোনে মুহূর্তেই। বন্ধুত্ব হচ্ছে চেনা অচেনা জানা অজানা বন্ধুদের সাথে।
দিনের বড় একটা সময় মানুষ কাটাচ্ছে প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহারে বিশেষ করে কিশোর ও তরুণ সমাজ। আটকা পড়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, টেলিগ্রাম, ভাইবার, হোয়াটএপের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে।
ফলো, আপলোড, স্ট্যাটাস, লাইক-কমেন্ট, শেয়ারিং ম্যাসেজিং ইত্যাদি বর্তমানের কিশোর তরুণ থেকে শুরু করে মাঝ বয়েসি বেশ বড় সংখ্যক মানুষের নিত্য কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষ যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মানুষের সাথে। ফলে, যেমন বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ তেমনি একই হারে কমছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আদব লেহাজ, সম্মান স্নেহ।
বয়স ও সময়ের বাঁধনকে অতিক্রম করে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে কিশোর তরুণ যুবক সবাই মেতে উঠছে অযাচিত আক্রমণ, অসংলগ্ন কথাবার্তা, অহেতুক তর্কবিতর্ক, হিংসা-দ্বেষ ও গীবত-পরনিন্দায়।
বড় ছোট, ছাত্র শিক্ষক, আত্মীয়তার সম্পর্ক সব কিছুই খেলো হয়ে যাচ্ছে এই অন্তর্জালে এসে! এখানে সবাই নিজের প্রোফাইল ও স্ট্যাটাস আপডেট করতে এতোটাই মেতে থাকছি যে তার আচার আচরণ যে অন্য সদস্যদের কষ্টের কারণ হচ্ছে তা আমরা বুঝতেই পারছি না।
মুরুব্বীদের নির্দ্বিধায় কটাক্ষ করছি, সম্মানিতদের নিয়ে হাস্যরস করছি, বড়দের সাথে বেয়াদবি করছি, পরস্পরে পরনিন্দা চুগোলখুরি গালাগালি করছি, স্ল্যাং ল্যাঙ্গুয়েযে কথা বলছি, অযাচিত ছবি ভিডিও আপলোড করে মানুষের সামাজিক সম্ভ্রমহানি করছি প্রতিনিয়ত!
অন্তর্জালের এই স্বভাব সহজেই আমাদের কিশোর তরুণদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মাঝেও ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত হচ্ছে ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ছেলে-মেয়েরা হয়ে পড়ছে খিটখিটে মেজাজের! অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছে।
সহজ সাধারণ বিষয়েও পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছে, তর্কে জড়াচ্ছে সম্মানিত ও বড়দের সাথে, নষ্ট হচ্ছে সামাজিক বন্ধন, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক।
এখন সময় হয়েছে সব কিছুর লাগাম টেনে ধরার। একটা নিয়মের বন্ধনে সকলকে আবদ্ধ করার। আমাদের সুন্দর সমাজ পরিবারকে আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারিনা তাই আসুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাবহার করতে মেনে চলি কিছু নিয়ম কানুন-
অনলাইনে যোগাযোগের আদব
১. ভদ্র ও নম্র্ভাবে স্ট্যাটাস কমেন্ট করা। আপনার কথায় লেখায় আপনার ব্যাক্তিত্ব ফোটে উঠে তাই প্রতিটা শব্দ যেন ভেবে-চিন্তে লিখা হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা।
২. সত্য কথা বলা ও লেখা । ভুল ও উল্টা-পাল্টা তথ্য দেয়া সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর সদস্যদের অন্যতম অভ্যাস ! ফলে অধিকাংশ সময় মানুষ বিভ্রান্ত হয়।
৩. উত্তম কথা বলা ও লেখা । সকল কল্যাণ নিহিত আছে এতে।
৪. ধীর-স্থিরভাবে স্পষ্ট করে কথা বলা ও লেখা। বুদ্ধিমানরা তাই করে। তাড়াহুড়া করতে গেলে সব সময় নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্থ ও বিব্রত হতে হয়।
৫. কথা লাগানোর অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে । এক জায়গার কথা অন্য জায়গায় লাগানোর অভ্যাস ঝগড়া লাগাতে সাহায্য করে।
৬. নিজের ওজন বুঝে কথা বলা । ইচড়েপাকা আর বেয়াদবি মার্কা কমেন্ট করা আমাদের স্বভাব হয়েগেছে।অনেক সময় দেখা যায় হিফজ পড়া ছেলেও মুফতি সাহেবের সাথে কথা কাটাকাটি করছে!!
নিজের শিক্ষা, যোগ্যতা ও উপযুক্ততা বুঝে পাশাপাশি অপরের যোগ্যতা সামাজিক মর্জাদা মাথায় রেখে পোস্টে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে ।
৭. বেশি কথা বলার পরিণতি সব সময় খারাপ হয় ।
৮. অনর্থক কথা বলা ও লিখা থেকে বিরত থাকতে হবে । অনর্থক কথার কারনেই অনেতুক বাকবিতান্ডার সৃষ্টি হয় যার শেষ হয় পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্টের মাধ্যমে ।
৯. নিজের কথা ও চিন্তা-ভাবনাকেই সঠিক মনে না করা । সকল সমস্যার মূলে এটাই ।
১০. অহেতুক তর্ক না করা । যেখানে আরো বিস্তারিত জানার বা শিখার আছে সেখানেই যৌক্তিক ও দালিলিক তর্ক করা ইনসাফের সাথে।
১১. অশ্লীল স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও আপলোড ও কমেন্ট না করা ।
১২. আক্রমনাত্বক কমেন্ট/ স্ট্যটাস এড়িয়ে চলা ।
১৩. কোন বিষয় নিয়ে হাসি ঠাট্রায় মেতে না উঠা । ব্যাক্তিকে ও সমষ্টিকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠা অসুস্থতার লক্ষণ। এথেকে বেঁচে থাকা জরুরী। এসব কারণে সম্মানিত মানুষের অসম্মান হয়। পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়।
১৪. গীবত-পরনিন্দা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে মহামারী আকার ধারণ করেছে অথচ গীবতকারী হাদিসের ধমকিতে আছেন তা আমরা ভুলেই যাই ।
১৫. অন্যের সম্মানহানী হয় এমন স্ট্যটাস ও কমেন্ট থেকে নিজেকে বিরত রাখা । মানুষের সম্মানটাও একটা বড় আমানত।
১৬. কোন তথ্য যাচাই না করে সত্য মেনে না নেয়া।সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রচুর ফেক আইডি রয়েছে যাঁদের কাজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্তিকর তথ্য আপলোড করা।
আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং বিশ্বস্ত মাধ্যমে প্রতিটা তথ্য যাচাই-বাছাই করে তবেই বিশ্বাস করতে হবে।