শেখ ফজলুল করীম মারুফ
আমি তখন মালিবাগ জামেয়ায় পড়ি। বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রচলন বেশ। হেদায়াতুন্নাহু জামাতের ছেলেরা বাংলা লিটলম্যাগ ‘ডাহুক’ বের করলো। একটা হইচই পড়ে গেলো। আমরা কাফিয়া জামাতে পড়ি। আমাদের জামাতের অনেকের সাহিত্য পাড়ায় সংযোগ ছিলো, অনেকের লেখার হাতও ছিলো। নিচের জামাতের ছেলেরা একটা পত্রিকা বের করলো আর আমাদের জানালোও না?!
আমরাও ‘উদ্ভাস’ নাম দিয়ে একটা লিটলম্যাগের প্রকাশনা শুরু করলাম। ওদের নাম ছিলো ‘ডাহুক’। ডাহুকে প্রকৃতি, মগ্নতা ও মানবীয় আবেগ ঘনিষ্ট লেখা বেশি বের হয়। উদ্ভাসে সমাজ ঘনিষ্ট লেখার প্রাধান্য থাকে।
একদিন গেলাম মালিবাগ জামেয়ার বিখ্যাত এক আরবি সাহিত্যিক শিক্ষকের সাক্ষাৎকার আনতে। আমার সাথে উস্তাদের ঘনিষ্টতা বেশ প্রসিদ্ধ ছিলো। আবার আমি যুগ্ন সম্পাদকও বটে। আমার ওপরেই দ্বায়িত্ব পড়লো সাক্ষাৎকার নেয়ার।
আমি রেকর্ডার-খাতা-কলম নিয়ে আয়োজন করে সাক্ষাৎকার নিতে গেছি তালতলায় উস্তাদজির বাসায়। তিনি উষ্ণ আপ্যায়ন করলেন। এক পর্যায়ে সাক্ষাৎকারের কথা তুললাম। উস্তাদজি গম্ভীর হয়ে গেলেন। প্রশ্নগুলো হাতে নিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড বকা শুরু করলেন।
আমরা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেলাম। বকার মুল লক্ষ্যই ছিলাম আমি। তাঁর সাথে যে ঘনিষ্টতা তাতেই এই বকায় আমার চোখে পানি এসে গেলো। কোনোমতে বেড়িয়ে এলাম।
আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। উস্তাদজি ডাহুক-উদ্ভাসের কার্যক্রমকে প্রশংসা করেছেন। লেখা-লেখিকে তিনি উৎসাহ দেন। আমার একটা আরবি গল্প তিনি নিজে সম্পাদনা করে আল কলমের শেষ পাতা জুড়ে ছেপেছেন।
তাহলে!?
রাতে আমি ঘুমাতে পারলাম না।
ফজর পড়তে গিয়ে দেখি হুজুর মসজিদে। তিনি সাধারনত নাস্তার পরে মাদ্রাসায় আসেন। নামাজ পড়ে রুমে আসতেই হুজুর ডেকে পাঠালেন।
আমার জীবনের বাঁক বদলে গেলো।
‘কালকে তোরে অনেক বকা দিছি না রেহ! মন খারাপ করছিস? আচ্ছা কর!
শোন, বর্তমান বিশ্বের সেরা সাহিত্যিক মনে করা হয় শেক্সপিয়ারকে। তোর কি মনে হয় তারচেয়ে ভালো সাহিত্যিক বিশ্বে আর জন্মায় নি? জন্মেছে। তারপরেও সে সেরা কারণ তার আদর্শ আজ বিজয়ী। ফররুখ হারিয়ে যাচ্ছে আর শামসুর রহমানরা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে কারণ ফররুখের আদর্শ আজ পরাজিত আর শামসুর রহমানদের আদর্শ জয়ী।
শোন মারুফ! তোর সাহিত্য টিকে থাকবে কিনা সেটা তোর সাহিত্যমানের চেয়েও বেশি নির্ভর করে তোর আদর্শ বিজয়ী কিনা তার উপর।
যারা পড়াশোনার বাহিরে আর কিছু করে না তারা ডাহুক-উদ্ভাস নিয়ে থাকুক। কিন্তু তুই কেনো? তোকে তো লেখক হিসেবে না বরং একজন বিপ্লবী হিসেবে দেখতে চাই। সেজন্যই কালকে তোরে বকা দিছি। বুঝলি আহাম্মক!!
যা! পড়াশোনা করবি আর সংগঠন করবি, যা!"
আমি সালাম দিয়ে চলে আসলাম। দারুল মায়ারিফ থেকেই রোজনামচা লিখতাম। সব ফেলে দিলাম। খিলগাঁও থানা ছাত্র আন্দোলনের কাজ শুরু করলাম। পরে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলাম।
এরপর থেকে আজ পর্যন্ত সংগঠনই জীবন আর প্রেম হয়ে আছে।