পঞ্চদশ শতাব্দী শেষ হতে না হতেই মুসলমানদের হাত থেকে উন্দুলুস হারিয়ে যায়। উন্দুলুসে প্রায় এক হাজার বছর মুসলমানরা বড় দাপটের সঙ্গে শাসন চালিয়েছেন। তারা তো সেখানে কেবল শাসনই চালাননি, বরং উলূমে ইসলাম, জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নানাবিধ শাস্ত্রেও দুনিয়ার নেতা বনে গিয়েছিলেন। আজব ব্যাপার হল, যেদিন থেকে মুসলমানদের রাজনৈতিক পতন শুরু হয় ইউরোপে উন্নতির উর্ধ্বগমনের সূচনাও ঘটে সেদিন থেকেই। উন্দুলুসে পতনের ধারা বেয়ে গোটা দুনিয়ায় মুসলমানরা পতনের দিকে ধাবিত হতে থাকে। আর এর পর-পরই উন্নয়নের নানা চিহ্ন প্রকাশ হতে থাকে ইউরোপে। এর আগের ইউরোপ তো ছিল মূর্খতার কালো অন্ধকার আর নিকষ আঁধারে ডুবন্ত।
উন্দুলুস পতনের প্রায় ১০০ বছর পরই ইউরোপ একটি বড় মাপের জাগতিক সাফল্য অর্জন করে। একদিকে তারা আমেরিকা আবিষ্কার করে, অপরদিকে ভাস্কো ডি গামা সন্ধান পেয়ে যায় হিন্দুস্তানের নৌ-পথ। কিছু কিছু ঘটনা দেখতে ছোট মনে হয়। কিন্তু সেগুলোর প্রভাব চলতে থাকে কয়েক শতাব্দি পর্যন্ত। দৃশ্যত এ দুটি ঘটনাও ছিল ছোট। কিন্তু ছোট্ট এ ঘটনা দুটিই পুরো দুনিয়ার ইতিহাস ও ভূগোলটাকে বদলে দিয়েছে। বিভিন্ন জাতির মাঝে নিয়ে এসেছে পরিবর্তন ও বিপ্লব। ইউরোপে শিল্প-উন্নয়নের সূচনা হয়। নতুন বিজ্ঞান ও নতুন প্রযুক্তি গতি লাভ করে। অথচ এর বড় অংশই অস্তিত্বে এসেছে উলামায়ে উন্দুলুসের কর্মপ্রয়াস ও কর্মফলের ‘খোসাবাছাই’ প্রক্রিয়ায়। উলামায়ে উন্দুলুসের সেসব গ্রন্থ আমাদের হাতে কমই এসেছে। ইউরোপ সে সব কাজে লাগিয়েছে। এর পরই ইউরোপের চিন্তাজগতে এসেছে দ্রুত গতিশীল নানা পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে। গতিময় নানা পরিবর্তন এসেছে তাদের রাজনৈতিক অঙ্গনেও। বৃটেনে এসেছে শিল্পবিপ্লব-সে বিপ্লব সঙ্গে নিয়ে এসেছে আরও অগণিত প্রসঙ্গ ও বিষয়। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ফরাসী বিপ্লব এনেছে সুদূর প্রসারী আরও কিছু পরিবর্তন। বৃটেনের শিল্পবিপ্লব আর ফ্রান্সের রাজনৈতিক বিপ্লব-এ দুটি ছিল এমনই অভিঘাত যা গোটা পৃথিবীরই জীবনের ধারা বদলে দিয়েছে।
আমরা মুসলমান। বিশেষভাবে ইলমে দ্বীনের সঙ্গে যুক্ত। এ কারণেই এখন যে যুগটি আমরা অতিক্রম করছি, আমাদের সামনে এ পর্যায়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ, দ্বীনী ঐতিহ্য, আকায়েদ ও ইসলামী ফিকহের ময়দানে সেসব প্রসঙ্গের সমাধান ও উত্তর সন্ধান করা, এই বিপ্লবগুলো যেসব প্রসঙ্গ ও মাসআলা তৈরি করে দিয়ে গেছে।
‘খোলাসা’ হিসেবে এতটুকু আরজ করতে চাই যে, বড় বড় কয়েকটি ময়দান খুলে গেছে। এ ময়দানগুলোতে পূর্ণ যোগ্যতা নিয়ে আলেমদের নিমগ্ন হওয়া প্রয়োজন। এটি অবশ্য পরিস্থিতির পরিহাস যে, এই বড় ময়দানগুলো সামনে এসেছে এমন একটি পরিবেশে, যখন মুসলমানরা তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে পতনমুখি যুগটা অতিবাহিত করছিল। আমাদের আসলাফদের যুগগুলো ছিল অন্য রকম। ইমামে আযম আবু হানিফা (রাহ.) ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের যুগটি ছিল আমাদের ইতিহাসের উর্ধ্বগামী যুগ। গ্রীক দর্শনের সয়লাব এসেছিল। আলেমগণ তাতে দক্ষতা অর্জন করে সে সবের জবাব দিয়েছিলেন। নতুন নতুন রাষ্ট্র গঠন হয়েছে। নতুন সব বিজয়ের ঘটনা ঘটেছে। ফিকহী মাসায়েলেও নতুন বহু ক্ষেত্র তখন সামনে এসেছে। সেসবের সমাধান পেশ করতে যুগের
কিংবদন্তীতুল্য সব ব্যক্তিত্ব মওজুদ ছিলেন। ফকীহ ছিলেন, মুজতাহিদ ছিলেন। আবু মনসুর মাতুরিদী (রাহ.), ফখরুদ্দীন রাযী (রাহ.) আর ইমাম গাযালী (রাহ.)-এর মতো আল্লাহওয়ালা চিন্তানায়ক ছিলেন।
আর এখন অবস্থা এই যে, পরিবর্তনের ডামাডোল সম্ভবত সর্বগ্রাসী। জিজ্ঞাসা, সংকট ও মাসআলা অনেক প্রসারিত ও জটিল। কিন্তু উম্মত অতিবাহিত করছে তার পতনের যুগ। আলেমদের মাঝেও নেই সেই মনন, যোগ্যতা ও সামর্থ্য। সে যুগের ইখলাস ও তাকওয়া এখন নেই। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এই দ্বীন কায়েম রাখবেন। ইনশাআল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত তা কায়েম থাকবেও। তাই প্রতি যুগেই উম্মতের মাঝে এমন সব ব্যক্তিত্ব জন্ম নেবেন যারা এসব জিজ্ঞাসা ও মাসআলার ইসলামী সমাধান জাতির সামনে পেশ করে যাবেন।
বর্তমানে পাঁচটি বড় অঙ্গন রয়েছে, যেখানে কাজ করা প্রয়োজন। একটি হচ্ছে চিন্তা ও দর্শনের অঙ্গন। যখন গ্রীক দর্শন অনূদিত হয়ে মুসলমানদের সামনে এসেছিল, এসেছিল বস্ত্ততান্ত্রিক দর্শন আর ধর্মশূন্য মতবাদ সঙ্গে নিয়ে, তখন উলামায়ে ইসলাম সেই দর্শন আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। রপ্ত করে নিয়েছিলেন তার যুক্তি-উপস্থাপন পদ্ধতি। সে দর্শন আর যুক্তিপদ্ধতি ব্যবহার করেই তারা ওই মতবাদের হাতিয়ার এবং অবিশ্বাসী দর্শনের ভিত গুড়ো গুড়ো করে দিয়েছিলেন।
আমাদের বুযুর্গগণ এক মহা কীর্তি আঞ্জাম দিয়েছিলেন। দর্শনের নামে এ জাতীয় চ্যালেঞ্জ এখনও বিদ্যমান। এর আওতায় যে সব চিন্তাগত ভ্রষ্টতার উৎপত্তি, তার শেকড়ে আপনি দেখবেন বস্ত্ততান্ত্রিক দর্শনের অস্তিত্ব। এর একটি অঙ্গন আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের ওপর আঘাত-উন্মুখ। তাই আজকের উলামায়ে ইসলামের একটি দায়িত্ব হচ্ছে, আধুনিক দর্শন যেসব নতুন প্রশ্ন ও সংশয় ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের মাঝে ঢুকিয়ে দিতে চায় তার যথাযথ জবাব দেওয়া। সে জাবাব দিতে হবে এমনভাবে যেভাবে দিয়েছেন আমাদের আসলাফ (পূর্ববর্তী মনীষীরা)। সে দর্শন আত্মস্থ করতে হবে। তা রপ্ত করে দক্ষ হতে হবে এবং সে যুক্তি-পদ্ধতির অস্ত্র দিয়েই ওই দর্শনের ভিত ধসিয়ে ইসলামী আকীদার সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
দ্বিতীয় অঙ্গনটি অর্থনৈতিক। বৃটেনের শিল্প-বিপ্লবের পর এ অঙ্গনে গতি ক্ষিপ্রতা লাভ করেছে। এভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুটি বড় মতবাদ ও দুটি বড় পদ্ধতি পৃথিবীর সামনে এসেছে। দুনিয়া এ দুটি মতবাদ ও পদ্ধতির অবয়ব দেখেছে এবং এগুলোর বাস্তবতা পরখ করেছে। এর একটি হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। অপরটি এর ঠিক বিপরীত-সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
ইসলামে বিশ্বাসী মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, এ কথাটি তুলে ধরা যে, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে ইসলামের
মীমাংসা বা সিদ্ধান্ত কী? ইসলামের অর্থব্যবস্থাটাই বা কী? অর্থব্যবস্থার মাসআলাটিকে এ যুগে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা বা চিন্তা-প্রসঙ্গ মনে করা হয়। এ বিষয়টি ফিকহী ময়দানেও অসংখ্য জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে। এটি এমনসব জটিল ও দুরূহ জিজ্ঞাসা তৈরি করেছে যে, তা সমাধানের জন্য প্রয়োজন বহু পরিশ্রমের। আলহামদুলিল্লাহ এ অঙ্গনে কাজ হচ্ছে। কাজ হচ্ছে অন্যান্য অঙ্গনেও। দর্শনের অঙ্গনে কাজ হচ্ছে। অর্থনৈতিক অঙ্গনেও উলামায়ে ইসলাম কাজ করেছেন ও করছেন। তবে এখনও করার মতো অনেক কিছু বাকি
রয়ে গেছে।
আরেকটি অঙ্গন রাজনীতির। রাজনীতিতে নতুন নতুন মতাদর্শ সামনে এসেছে। সামনে এসেছে রাষ্ট্রব্যবস্থার নতুন ধরণা। এ কারণে উঠে এসেছে নতুন সব জিজ্ঞাসাও। এ ক্ষেত্রে উলামায়ে ইসলামের ওপর দায়িত্ব পড়েছে ইসলামের অবস্থান পরিষ্কার করার। তাদের জানাতে হবে-কোনটি ইসলামী রাজনীতি এবং কোনটি কাফের ও অবিশ্বাসীদের রাজনীতি? তাদের বলতে হবে, গণতন্ত্র কিংবা অন্য কোনো নামে চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে ইসলামের পার্থক্যটা আসলে বা কী?
অরেকটি অঙ্গন চিকিৎসা বিষয়ক। চিকিৎসার ময়দানে নিত্য নতুন উদ্ভাবন একটি বিপ্লব নিয়ে এসেছে। এ কারণে অসংখ্য ফিকহী মাসআলার জন্ম হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ বিষয়টি সব ফকীহ ও ফতোয়াচর্চাকারীদের জন্য এখন নতুন একটি চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। কেননা প্রশ্ন আসছে-বলুন, অমুক বিষয়টি জায়েয নাকি না-জায়েয? অমুক চিকিৎসা-পদ্ধতিটি বৈধ নাকি অবৈধ? আলহামদুলিল্লাহ এ অঙ্গনেও আলেমসমাজ কাজ করে যাচ্ছেন। গোটা ইসলামী জগতের ফকীহ ও ফতোয়াচর্চাকারীগণ এসব মাসআলায় মনোনিবেশ করেছেন। কিন্তু সংখ্যায় ও পরিমাণে এ ক্ষেত্রে যতটা লেগে থাকার প্রয়োজন, ততটা নিমগ্ন হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। যে পরিমাণ সময় এ ক্ষেত্রে দেওয়া দরকার, ততটাও দেওয়া সম্ভব হয়নি।
অপর অঙ্গনটি হচ্ছে আইন-কানুনের। এটিতো এমনই একটি অঙ্গন যার সূচনাই হয়েছে মুসলমানদের হাতে। আইন-কানুনকে ফিকহের অবয়বে সবার আগে যে ধারায় ও পদ্ধতিতে সংকলন ও সমন্বয় করা হয়েছে-এর আগে এর কোনো নজির দুনিয়ার ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে এরপর আইন একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র ও জ্ঞানশাখায় পরিণত হয়েছে। এখন ইউরোপই এর ইমাম বনে গেছে। এ অঙ্গনেও আলহামদুলিল্লাহ উলামায়ে ইসলাম কাজ করেছেন এবং করছেন। তবে এখনও বহু শূন্যস্থান রয়ে গেছে।
এই পাঁচটি বড় অঙ্গন এখন সামনে। এক. নতুন দর্শন থেকে উদ্ভূত জিজ্ঞাসা। দুই. অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে আসা জিজ্ঞাসা। তিন. রাজনৈতিক পথ-মত থেকে তৈরি হওয়া প্রশ্ন। চার. চিকিৎসার নানা উপায় থেকে জন্ম নেওয়া মাসআলা। পাঁচ. আইন-কানুনের ক্ষেত্রে বিরাজমান বিভিন্ন জিজ্ঞাসা। এই পাঁচটি অঙ্গনে কাজ করা প্রয়োজন। আর ঘটনা হল, এর প্রতিটি অঙ্গনে বেশ কিছু ব্যক্তির পুরো জীবনটা ওয়াকফ করে দিলে অঙ্গনগুলোতে সাফল্য আসবে। এক্ষেত্রে তাখাসসুসাত (বিশেষায়িত জ্ঞানচর্চা) প্রয়োজন। কিছু মানুষকে একটি অঙ্গনের জন্য, অপর কিছু মানুষকে অন্য অঙ্গনের জন্য নিজেদের পুরো জীবনকে ওয়াকফ করে দিতে হবে। তবেই এই পাঁচ অঙ্গনের জিজ্ঞাসা ও মাসআলাসমূহ সমাধানের ক্ষেত্রে সঠিক হক আদায় হওয়া সম্ভব হতে পারে।
[‘ইসলাম আওর সিয়াসি নযরিয়্যাত’ গ্রন্থের শুরুতে ভূমিকামূলক একটি লিখিত বক্তব্য থেকে অনূদিত। অনুবাদ : শরীফ মুহাম্মদ] সূত্র- আল-কাউসার