কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সহস্রাধিক নারী ও শিশু নিখোঁজের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যাম্প এলাকায় মাইকিং করা হয়।
শুরুর দিকে এই অভিযোগ বেশি থাকলেও এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার পর নিখোঁজের সংখ্যা অনেকাংশেই কমে গেছে। শিশু ও নারী পাচার রুখতে কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে ২৭টি তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশ, কোথাও সেনাবাহিনী আবার কোথাও বিজিবি চৌকিতে দায়িত্ব পালন করছে।
জানা যায়, গত এক মাসে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দালাল চক্রের নানা প্রতারণার অভিযোগে অন্তত ২৫০ জনকে সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার ছাড়ার সময় অন্তত ২৮ হাজার জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ক্যাম্পে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্রোত নামার দুই সপ্তার মাথায় অন্তত অর্ধলাখ রোহিঙ্গাকে দালাল চক্র বিভিন্ন কৌশলে কক্সবাজার-ছাড়া করেছে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, ‘ছদ্মবেশে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার পথে উখিয়া থানা পুলিশ অন্তত সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। পরে তাদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে উখিয়া ছাড়তে চেয়েছিল।
তবে অনুসন্ধান চালিয়ে ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন পাচারকারীকে আটক করেছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ’ কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রথম দিকে পাচারকারী চক্র উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচার করার অপকৌশলও নিয়েছিল এই চক্র।
কিন্তু প্রশাসন তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পুলিশ, বিজিবির পাশাপাশি ছদ্মভাবে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিও কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে এসে যুক্ত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। এখন শিশু ও নারী পাচার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে আসছে।
সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফের অস্থায়ী ক্যাম্পের প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা যুবতী, নারী ও শিশু নিখোঁজ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২০০ জনকে উদ্ধার করে তাদের স্বজনদের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখনো নিখোঁজ সহস্রাধিক।
জানা যায়, উখিয়ার কুতুপালং, টিভি টাওয়ার পাহাড়, বালুখালী, মাইন্যার ঘোনা, তাজনিরমার খোলা, হাকিমপাড়া, থাইংখালী, তেল খোলাসহ অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারী-শিশু পাচারকারীদের ঘাঁটি ছিল। চক্রের অনেক সদস্যই ত্রাণ দেওয়ার নামে নামিদামি গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পগুলোয় আসত। সামান্য কিছু ত্রাণ বিতরণের নামে তারা নারী ও শিশু টার্গেট করত। তারা সঙ্গে নিয়ে আসত শাড়ি-গয়নাসহ শিশুদের পোশাক। সুবিধাজনক কোনো স্থান পেলে টার্গেট করা নারী ও শিশুকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ওইসব পোশাক পরাত।
একপর্যায়ে নিজের গাড়ি কিংবা মাইক্রোয় করে তাদের নিয়ে যেত। তবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই চক্রটি এখন ছিটকে পড়েছে। এখন আর কেউ সেভাবে ত্রাণও দিতে পারে না। কোনো প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় কাউকে যেতেও দেওয়া হয় না।
বেসরকারি সংস্থা হেলপ কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, পাচারকারীরা এখনো সক্রিয়। তারা সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সতর্কতায় তারা পেরে উঠছে না। এর পরও নিজেদের স্বজন পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজের নামে নারী-শিশু পাচার হচ্ছে।
জানা যায়, ‘নিখোঁজ সংবাদ’ প্রচার করতে মাইকিংসহ কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। কেউ হারিয়ে গেলেই কুতুপালং ক্যাম্পে বর্মি ভাষায় মাইকিং করা হয়। নিয়মিত মাইকিং করেন নজির আহমদ নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অন্তত চার-পাঁচ জন অল্পবয়সী নারী ও শিশুর নিখোঁজের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই সংবাদ আমরা মাইকে প্রচার করছি।’
উখিয়ার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ক্যাম্পভিত্তিক পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রতিনিয়ত মাইকিং করে নিখোঁজদের সন্ধান করছেন অভিভাবকরা। এতে বৃহত্তর রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন স্থানীয় অভিভাবকদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। ’
সম্প্রতি বালুখালী তেলিপাড়া অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রিত নার্গিস বেগম (২৫) ও তার ছেলে মো. রবিউল্লাহকে (৮) একটি চক্র প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচারের সময় কুমিল্লার সীমান্তবর্তী জামপুর গ্রাম থেকে তাদের আটক করে বিজিবি। পরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় সাধারণ ডায়েরি করে তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয় মা-ছেলেকে। উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কৌশলে প্রলোভনে ফেলে কিছু অসাধু চক্র দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো ভূমিকার কারণে এই চক্র হাতেনাতে গ্রেফতারও হচ্ছে। এখন অনেকাংশে পাচার কমে এসেছে। ’ সন্দেহভাজন কোনো লোককে ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেলে দ্রুত পুলিশ খবর দেওয়ার অনুরোধও জানান তিনি।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন