মুহাম্মাদ শোয়াইব : শুধু মিয়ানমার নয়; পাঁচটি দেশ শরণার্থী সংকটে ভোগছে। অনেকের ধারণা যেসব দেশের গৃহযুদ্ধ চলছে শুধু সেসব দেশেই শরণার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু বাস্তবতা এরূপ নয়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের হিসাব আনুযায়ী বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা ৬৫.৩ মিলিয়ন। এটি একটি আনুমানিক হিসাব।
নিজ দেশে বসবাস বিপজ্জনক হয়ে উঠলে জীবন রক্ষার তাগিদেই কোনো দেশের জনগোষ্ঠী ভিন্নদেশে শরণ নিতে বাধ্য হয়। জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উগ্রতা, রাজনৈতিক আদর্শগত কারণ, সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি কারণে অনেক সময় নিজ দেশে বসবাস করা কঠিন হয়ে যায়। আর তখন মানুষ শরণার্থী হয় অন্য দেশে। বর্তমান বিশ্বে যেসব দেশ থেকে মানুষ অন্য দেশে শরণার্থী হচ্ছে তাদের সবার দেশত্যাগের প্রেক্ষাপট এক নয়। যেমন সিরিয়ার শরণার্থী আর মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যার প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
৩১ ডিসেম্বর, ২০০৫ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান, ইরাক, সিয়েরালিওন, মিয়ানমার, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ফিলিস্তিন বিশ্বের প্রধান শরণার্থী উৎসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শরণার্থী এসেছে দক্ষিণ সুদান থেকে, প্রায় ৫০ লাখ। জনসংখ্যা অনুপাতে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী রয়েছে আজারবাইজানে।
শরণার্থীদের আশ্রয়দান অবশ্যই মানবিক বিষয়। তবে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া অনেক সময় আশ্রয়দাতা দেশের জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধ, সংঘাত এবং নির্যাতনের কারণে ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ছয় কোটিতে পৌঁছেছে।’ বিষয়টি অবশ্যই উদ্বেগজনক।
বিপুল পরিমাণ মানুষ শরণার্থী হওয়ার পেছনে সিরিয়ার গৃহ যুদ্ধকে কারণ হিসেবে উপস্থাপন করলেও গত পাঁচ বছরে 15 টি যুদ্ধ হয়েছে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে। আর এসব যুদ্ধের কারণেও প্রচুর মানুষ শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। তবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী হয় মিয়ানমারে। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার থেকে আমাদের দেশে আসছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। নিবন্ধিত রোহিঙ্গার তুলনায় বহুগুণ বেশি রয়েছে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী। এমনিতেই বাংলাদেশ জনসংখ্যাবহুল দেশ। সেখানে এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আশ্রয়দান নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করছে।
অবশ্য তাদের কোনো কোনো দল নৌকায় করে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশেও পাড়ি জমাচ্ছে। সুতরাং শুধু মিয়ানমারই শরণার্থী সংকটের একমাত্র দেশ নয়। বরং অন্য আরও দেশ আছে যারা আমাদের চোখের বাইরে পড়ে আছে। অথচ সেখানকার পরিস্থিতিও ভয়াবহ। তবে পাঁচটি দেশ শরণার্থী সংকটে সর্বশীর্ষে রয়েছে।
1. গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র :
গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র আফ্রিকা মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। আয়তন তেইশ লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার চারশ ৯ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৮ কোটি। রাজধানীর নাম কিনসাসা। মুদ্রার নাম কঙ্গোনিজ ফ্রাঙ্ক। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র দ্বিতীয় স্থানে। কঙ্গোর প্রতিবেশী দেশগুলো হচ্ছে প্রজাতান্ত্রিক কঙ্গো, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ সুদান, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, তাঞ্জানিয়া, জাম্বিয়া ও অ্যাঙ্গোলা। আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে এ দেশটি আয়তনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও রাজনৈতিক হানাহানি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দুর্নীতি দেশটিকে দরিদ্র অবস্থায় রেখেছে। কোনোভাবেই তারা দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ১৮৭০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত দেশটি বেলজিয়ামের রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হত। পরবর্তী সময়ে এটি উপনিবেশের মর্যাদা পায়। দেশের প্রথম প্রেসিডেন্টের নাম ছিল প্যাট্রিক লুলুম্বা।
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো (ডিআরসি) এর নেতৃত্বে ১৯৬০ সালে বেলজিয়াম থেকে তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ও খনিজ সম্পদের এই দেশে সহিংসতা লেগেই আছে। যেন সহিংসতা গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের একটি প্রতীক।
1961 সালে কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়। আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 1965 সালে দেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে জ্যেষ্ঠ নেতা জোসেফ মোবুতু। মিস্টার মোবুতুর নেতৃত্বে দেশটি অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিকভাবে মোটামোটি স্থির অবস্থায় চলে আসে। তারপর থেকে দেশটি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নজরে পড়ে যায়। এরপর আর কোনোভাবেই দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি দেশটি।
1990-এর দশকের দিকে প্রতিবেশী রুয়ান্ডানের গণহত্যা কাঙ্গোতেও ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডান ও উগান্ডান সৈন্য বাহিনী সমর্থিত বিদ্রোহী নেতা লরেন্ট ডিজায়ার কাবিলার সহযোগিতায় প্রথম কঙ্গো যুদ্ধ (1996-97) শুরু হয়। এক পর্যায়ে প্রথম যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম কঙ্গো যুদ্ধ বন্ধের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রথম যুদ্ধের ভয়াবহতাকে হার মানিয়ে দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম কঙ্গো যুদ্ধের ইস্যুগুলোকে সামনে রেখেই গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রতিষ্ঠা বা খনিজ সম্পদের ওপর প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুদ্ধটি বাধে। স্বার্থের কাছে অন্ধ হয়ে ভাই ভাইয়ের রক্ত দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করার এ যেন এক পৈশাচিক উদাহরণ।
এ যুদ্ধে কমপক্ষে ৫৪ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। আর লাখ লাখ মানুষ নিজেদের সম্পদ-ঘরবাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়। লাখ লাখ গৃহহীন মানুষের এ যেন মৃত্যুর সঙ্গে লড়া। খাদ্য আর অপুষ্টিতে ভোগা নিরীহ মানুষগুলোকে দেখলে মনের অজান্তে ক্ষমতা কেন্দ্রিক এসব যুদ্ধকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা হবে। অফিসিয়াল হিসাব মতে, ২০০৩ সালের জুলাই মাসে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোয় অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এ যুদ্ধ থেমে যায়।
আধুনিক আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয় এ যুদ্ধকে। যুদ্ধ যে কতটা রক্তাক্ত, কতটা বিধ্বংসী হতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বয়ে বেড়াচ্ছে দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ।
এই ভয়াবহতম যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল আফ্রিকার সাতটি জাতি এবং সঙ্গে সমরাস্ত্রে সজ্জিত ২৫টি আর্মড গ্রুপ। এ যুদ্ধটিকে অনেকে গ্রেট ওয়ার অব আফ্রিকা বলে অভিহিত করে থাকে। দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধে (1998-2003) কাঙ্গো প্রথম যুদ্ধের হোতা কাবিলা নিহত হন।
১৯৯৪ সালে ভয়ঙ্কর এক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল রুয়ান্ডায়৷ জাতিসংঘের আদালত ওই হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে কিগালির সাবেক গভর্নর থারিচিসে রেনজাহোকে৷ 21 বছর আগের ওই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডে টুটসি এবং হুটু গোষ্ঠীর ৮ লাখের মতো মানুষ মারা যায়৷
মোটকথা, গত দুই দশক ধরে কঙ্গোর আভ্যন্তরীণ দুটি ভয়াবহ যুদ্ধ ও পার্শবর্তী রাষ্ট্রের গণহত্যার জেড় কঙ্গোতে প্রবেশের ফলে বার বার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে 2 মিলিয়নের বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে অন্যত্র চলে যায়। আর 5.4 মিলিয়নেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। যাদের মধ্যে 10 শতাংশেরও কম সৈনিক সরাসরি যুদ্ধে নিহত হয় বলে ধারাণা করা হয়। দেশের পূর্বাঞ্চলে এখন পর্যন্ত সহিংসতা চলমান। ইউএন এর এক হিসাব অনুযায়ী, অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ দেশের বাইরে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েক দশক ধরে চলমান সহিংসতার ফলে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয়েরই একটি শ্লথগতি চলে আসে।
2. মিয়ানমার :
রোহিঙ্গা মুসলিম। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সংখ্যালঘু। তাদের কোনো নাগরিকত্ব নেই বলে তারা রাষ্ট্রহীন, অনাকাঙ্খিত।তারা বসবাস করছে মিয়ানমারে। অষ্টম শতাব্দী থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের বসবাসের ইতিহাস আছে এই ভূখন্ডে। তারপরও তারা মিয়ানমার সরকারের কাছে নাগরিকত্বহীন।
আগে রাখাইনের নাম ছিল আরাকান। সেখানেই ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম গাদাগাদি করে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছিল। এ রাজ্যটি মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। বৌদ্ধ প্রধান দেশ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি না দিয়ে দমন-পীড়ন করে বের করে দিতে চাচ্ছে। অন্য কেউও তাদেরকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে। তাদেরকে বাঙালি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যায়িত করছে। এর ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বর্ণবাদী যুগের মতো অমানবিক পরিস্থিতির মুখে পড়েন। তাদের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা নেই। তাদের কোনো শিক্ষার অধিকার নেই। তাদেরকে মিয়ানমার থেকে বের করে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী তাদের ওপর যে বর্ণনাতীত নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতা চালাচ্ছে তা এক কথায় হায়েনার তান্ডব। তাদের দমন-পীড়ন যখন তীব্র আকার ধারণ তখন একটু কথাবার্তা হয়। কিন্তু আসল সমস্যার সমধান হয় না। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই অমানবিক আচরণে মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচি চরম অবহেলার পরিচয় দিচ্ছেন। এক সময় তাকে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবে দেখা হলেও এখন তিনি সমগ্র দুনিয়ার কাছে এক রক্তাচোষা প্রাণী ছাড়া আর কিছুই নয়। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সেনারা রাখাইনে গণধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ করছে। শিশুদেরকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিচ্ছে। এরপর তাদেরকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে নদীর পানিতে না হয় আগুনে। আর সুচি নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
২৫ শে আগস্ট শুরু হওয়া সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের পর মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে কমপক্ষে তিন লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে উপচে পড়া শিবিরগুলোতে আশ্রয় খুঁজছেন। দেশে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। গুলি করা হচ্ছে। তাই তিল ধারণের ঠাঁই নেই বাংলাদেশের এমন আশ্রয় শিবিরগুলোতে ছুটছেন তারা।তাদের অভিযানে কমপক্ষে 1000 মানুষ নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীদের দাবি এ সংখ্যাে আরও অনেক বেশি। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, রাখাইনে অবস্থানকারী আড়াই লাখ অধিবাসীর কাছে জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সি জরুরি ভিত্তিতে যে খাদ্য, পানি ও ওষুধ পৌঁছে দেয় তাদের সেই কার্যক্রম আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। ওইসব রোহিঙ্গার জন্য খাদ্য, পানি ও ওষুদের ভীষণ প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু মিয়ানমার জাতিসংঘের এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ায় নিহতের সংখ্যা অনেক বাড়ছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান নিষ্পেষন ও সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারিং অপারেশনস’, অত্যাচার, নির্যাতন আর বর্বরতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে ২০১৬ সালের অক্টোবরে এবং এবার বাণের স্রোতের মতো রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত কয়েকদিনে অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজার ও সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
3. মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র :
1960 সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাঁচটি অভ্যুত্থান ঘটনা ঘটেছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (সিএআর) এ। সর্বশেষ অভ্যুত্থান ঘটে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ আকস্মিকভাবে সিএআরের রাজধানী বাঙ্গি আক্রমণের মধ্য দিয়ে। তারা আক্রমণ করে তত্কালীন প্রেসিডেন্ট বোজিজিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়। এক্স সেলেকার নেতা জাতুদিয়া নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। ক্ষমতা দখলের পর থেকে এই দলটি সাধারণ জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অপহরণসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। তারা আর্মড ফোর্সের সদস্যদের নির্বিচারে হত্যা করে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মাইকেল জাতুদিয়া দলটির অবসান ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র-এ মুসলমানরা অমুসলিমদের হাতে গণহত্যার শিকার হচ্ছে।
দেশটিতে গণহত্যা আসন্ন- এমন হুঁশিয়ারির প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীরা দরিদ্র এই দেশটির মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। একদল খ্রিস্টান দাঙ্গাবাজ মুসলমানদের ভেড়ার মত জবাই করছে। সম্প্রতি সেখানে ফরাসি সেনা মোতায়েন করা সত্ত্বেও মুসলমানরা নিরাপত্তা পাচ্ছে না।নানা নিপীড়নের মুখে সেখানকার মুসলমানরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এই পর্যন্ত সেখানকার শরণাথীদের সংখ্যা দাড়িয়েছে চার লক্ষ সত্তর হাজার। মোট জনসংখ্যা হলো 5.5 মিলিয়ন।
4. ইরিত্রিয়া :
শরণার্থী সংকটে তৃতীয় দেশ ইরিত্রিয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইরিত্রিয়া ছাড়ছে হাজার হাজার মানুষ। ইউরোপে অভিবাসনের লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ইথিওপিয়ায় প্রবেশ করছেন তারা। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অত্যাচারী সরকারের হাত থেকে রেহাই পেতে ১৯৯১ সালে ইথিওপিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু এ দেশ ছাড়ার হিড়িক। বিশ্বের প্রকট শরণার্থী সংকটে পতিত সিরিয়া ও মিয়ানমারের পরই অবস্থান আফ্রিকার সিং অঞ্চলের এ দেশটির। প্রতিদিন ২০০-৩০০ মানুষ ভালোভাবে খেয়ে-পরে থাকার আশায় পাড়ি দিচ্ছে সীমান্ত।
হত্যা, নিপীড়ন, অত্যাচার আর আটকের আতংকে শুধু ২০১৪ সালেই প্রায় ৩৩ হাজার ইরিত্রীয় দেশ ছেড়েছে। প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়ার দেয়া আশ্রয় শিবিরে (শরণার্থী সংগঠন এআরআরএ) আশ্রয় নিয়েছে এসব মানুষ। এআরআরএর কর্মকর্তা সালেহ তাকলেমারিয়ম বলেন, দিনকে দিন এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইরিত্রিয়া স্বাধীনতার পর থেকে কখনও স্থিতিশীলতার মুখ দেখেনি। অর্থ ও সম্পদের দৈন্যদশায় অসহায় হয়ে পড়েছে নাগরিক। এর ওপর সামরিক বাহিনীতে যোগদান প্রত্যেক নরনারীর জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করেও সংসার চালানোর মতো পারিশ্রমিক মেলে না তাদের। ১৯৯৮-২০০০ সাল পর্যন্ত আদ্দিস-আবাবা ও আসমাআরার মধ্যে সীমান্ত যুদ্ধ হলে ঘোরতর শত্রুতার জন্ম নেয় দেশটির মধ্যে। ফলে ইরিত্রিয়ায় পালাতে গিয়ে একরকম প্রাণ হাতে রেখে পাড়ি দিতে হয় সীমান্ত। কেননা বন্দুকের নিশানায় পড়লে আর রক্ষা নেই। এত ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়া মানুষগুলোর পরবর্তী লক্ষ্য ইউরোপ, কারও আবার যুক্তরাষ্ট্র।
5. কলম্বিয়া :
কলম্বিয়া দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। কয়েক যুগ যাবত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী মাদক চোরাকারবারী চক্রের প্রভাবে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। যদিও দেশটির গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার ইতিহাস পুরনো, তা সত্ত্বেও দেশটিতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রেণীবৈষম্যমূলক একটি সমাজ বিদ্যমান।
২০শ শতকের মধ্যভাগে গৃহযুদ্ধ কলম্বিয়ার সমাজব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বামপন্থী গেরিলা ও আধা-সামরিক বাহিনী এবং কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে দেশের গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ২১শ শতকের শুরুতে এসেও সহিংসতা কলম্বীয় নাগরিকদের জীবনের নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা ছিল।
দীর্ঘ ৫০ বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানে ফার্ক গেরিলাদের সঙ্গে কলম্বিয়া সরকারের করা ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি গণভোটে প্রত্যাখ্যাত হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা চেষ্টার কারিগর হিসেবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস।
কলম্বিয়ায় প্রায় পাঁচ দশক ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। অতি বামপন্থী ফার্ক গেরিলারা দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে লিপ্ত। এতে প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৬০ লাখের বেশি মানুষ। বিভিন্ন সময় ফার্ক গেরিলাদের সঙ্গে সরকারের শান্তি আলোচনা শুরু হলেও ফলপ্রসূ হয়নি।
সর্বশেষ চার বছরের আলোচনার পর গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর দ্য রেভল্যুশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়ার (ফার্ক) নেতা টিমোশেনকো ও কলম্বিয়ার মধ্য ডানপন্থী সরকারের প্রধান হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস ওই শান্তিচুক্তিতে সই করেন। পরে সেই চুক্তি নিয়ে জনগণের মতামত চেয়ে গণভোটের আয়োজন করেছিলেন সান্তোস। গণভোটে সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ফলে শান্তিপ্রক্রিয়ার বিষয়টি আবার মুখ থুবড়ে পড়ল।
কয়েক যুগ যাবত সরকারি বাহিনী ও ফার্ক বাহিনীর সঙ্গে চলমান গৃহ যুদ্ধের ফলে 6.9 মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অন্য দেশে শরণ নিতে বাধ্য হয়।
সূত্র : সাসা পোস্ট